19/06/2020
নিরীহ মানুষকে ঠকিয়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ
আবাসন প্রতিষ্ঠানের নামে কথিত ব্যবসা খুলে একটি চক্র প্রায় ১৪ হাজার নিরীহ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কমপক্ষে তিনশ কোটি টাকা। তাদের মূল টার্গেট ছিল বিভিন্ন বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অধিক লাভের আশায় অনেকে জীবনের শেষ সম্বল তুলে দিচ্ছেন তাদের হাতেই।
সঙ্ঘবদ্ধ এই প্রতারক চক্রটি বনানী ও উত্তরাতে ‘পূর্বাচল মডেল স্যাটেলাইট টাউন লিঃ’, ‘মেগা স্যাটেলাইট সিটি লিঃ’ ও ‘মেগা ট্রান্সপোর্ট লিঃ’ নামে কয়েকটি ভুয়া কোম্পানি ২০১৮ সালের জুলাই থেকে পরিচালনা শুরু করে। তারা ১৬ মাসে টাকা দ্বিগুণ ও এক কাঠা জমি কিনলে এক কাঠা জমি ফ্রী এবং মেগা ট্রান্সপোর্টে লিঃ-এ একক বা যৌথভাবে টাকা বিনিয়োগ করে এসি বাসের মালিকানা গ্রহন করলে আকর্ষনীয় হারে মুনাফা প্রদান করা হবে বলে ঘোষণা দেন।
পূর্বাচল মডেল স্যাটেলাইট টাউন লিঃ ও মেগা স্যাটেলাইট সিটি লিঃ-এর কর্তৃপক্ষ ঘোষনা দেন যে, তাদের কোম্পানিটি ২০৫৩ বিঘা জমি নিয়ে গঠিত হবে এবং বর্তমানে তাদের ১,৭০০ বিঘা নিজস্ব জমি আছে। তারা তাদের প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের সাথে যৌথ সহযোগিতায় একটি স্যাটেলাইট স্থাপন করবেন। এইজন্য তারা বাংলাদেশ সরকারকে ইতিমধ্যে ১০ বিঘা জমি প্রদান করেছেন, যা সম্পুর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। তারা আরও ঘোষনা দেন যে, তাদের প্রকল্পে ভারত সরকারের সাথে যৌথ সহযোগিতায় একটি অত্যাধুনিক হাসপাতাল তৈরী হবে এবং জাপানের সাথে যৌথ সহযোগিতায় একটি ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্লান্ট ও একটি পানি পরিশোধন প্লান্ট স্থাপন করবেন। পরবর্তিতে খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, ঐ প্রকল্পে তাদের নিজস্ব ১০ বিঘা জমিও নাই এবং ঘোষিত ঐ সকল প্রকল্পের কোন ভিত্তি নাই।
'আমাদের সময়'-এর সাংবাদিক হাবিব রহমান সরেজমিন অনুসন্ধান করে গত ২২ আগষ্ট ২০১৯ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তিনি সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে দেখেন যে, নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জের আগলা, বাঘপাড়া, ও রাহেলা গ্রাম তিনটিতে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছেন কথিত এই আবাসন প্রতিষ্ঠানটি। পরিচয় গোপন করে জমির ক্রেতা হিসেবে এই প্রতিবেদক সেখানে গেলে গ্রামের মানুষ জড়ো হন। তারা জানান, জমি না কিনে মালিকের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছেন পূর্বাচল মডেল স্যাটেলাইট টাউন লীঃ ও মেগা স্যাটেলাইট সিটি লিঃ। সামান্য কিছু জমি কিনেছেন। বছর ভিত্তিক নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ভাড়া পরিশোধ করেন তারা। গ্রামের জলাশয়, খালেও সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে জমি কেনার কথা জানানো হলে গ্রামের বয়স্ক ব্যক্তিরা এক প্রকার ক্ষেপে যান। তারা এই প্রতিবেদককে বলেন, আপনারা জমি কেনার জায়গা পান না। এই বাটপারদের কাছ থেকে জমি কিনবেন? ওদের জমি আছে এখানে কতটুকু? ঢাকায় তারা ১ হাজার ৭০০ বিঘা জমি এখানে কেনার কথা প্রচার করলেও তারা উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, এখানে তাদের বড় জোর ২০ বিঘা জমি আছে?
বনানীর ই ব্লকের রোড-১৯/এ, হাউজ- ২২ (তৃতীয় তলা) প্রতিষ্ঠানটির করপোরেট অফিস ছিল । তাছাড়া ১৯, প্রিয় প্রাঙ্গন টাওয়ার (৫ তলা) রোড-১৭ ঠিকানায় তাদের আরও একটা অফিস ছিল। উত্তরাতে সেক্টর-৪, রোড-৫, হাউজ-৯ এ তাদের একটি অফিস ছিল। গত দেড় বছরে প্রায় ১৪,০০০ নিরীহ লোকের কাছ থেকে প্রায় ৩০০ (তিন শত) কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এই প্রতারক চক্রটি গত ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে আছে। এখন কোন বিনিয়োগকারী কোন মুনাফা বা আসল টাকা পাচ্ছে না এবং কর্তৃপক্ষ কারও সাথে যোগাযোগ করেন না এবং সবাই মোবাইল ফোন বন্দ রেখেছেন।
প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন হাসিবুল ইসলাম-জয়, চেয়ারম্যান ছিলেন মো ওয়াহেদুল ইসলাম রানা, পরিচালক (অর্থ) রেজাউল করিম ও তার স্ত্রী ডিএমডি পিংকি আক্তার, অনরারী ক্যাপ্টেন আব্দুর রহমান মেগা স্যাটেলাইট সিটি লীঃ-এর সিইও হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ফয়েজ নুরী, জাকির হোসেন, জাহাঙ্গির আলম, বিল্লাল হোসেন, এমদাদ হোসেন ও মোঃ কামাল পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন । সালাহউদ্দিন আহমেদ উত্তরা কর্পোরেট অফিসের সিইও হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সালেহ আহমেদ মিয়া লীডার ও দুবাই কর্পোরেট অফিসের ইনচার্জ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের মধ্যে হাসিবুল ইসলাম-জয় ছাড়া বাকি সবাই এর আগে বিভিন্ন সময় আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে বন্ধ হয়ে যাওয়া জিজিএন, গ্লোবাল নিউওয়ে, লাইফওয়ে বাংলাদেশ, ব্রাইট ফিউচার-এর মতো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ছিলেন। প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের সবার বিরুদ্ধেই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দুদকের চেয়ারম্যান এবং র্যাব মহাপরিচালকের কাছে আকুল আবেদন এই যে, বিষয়টি সঠিকভাবে তদন্তপূর্বক এই অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত নিরীহ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা আত্মসাতকারীদের খুঁজে বের করে সমুচিত শাস্তি নিশ্চিতকরণ এবং নিরীহ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা ফেরত প্রদান করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করার জন্য সবিনয় অনুরোধ করা হল।