15/09/2025
তারিখটা হলো ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।সেদিন ভোর ছয়টায় হঠাৎ আমার মোবাইলে একটি কল আসলো।
আমার স্কুল জীবনের শিক্ষক অর্থাত আমার স্যার আমাকে ফোন দিছে।স্যারের নাম শাহজাহান সোহেল।তো স্যার কল দিয়েই একটানা বলা শুরু করছে,
'আরে সোহাগ তুমি এত বড় বেইমান!তুমি ভালো হয়ে গেছো অথচ আমারে জানাইলাও না'(উল্লেখ্য,সোহাগ আমার ডাকনাম)।
যাইহোক আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম।আমি খারাপই ছিলাম কবে স্যারের কাছে বুঝতে পারছিলাম না।স্যার ফোনে একটানা বকা দিয়েই যাচ্ছেন।আর এদিকে অনেকটা সময় আমি হতভম্ব হয়ে রইলাম।
আমার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দেখে আমাকে 'ফেল করা ছাত্র' ভেবে কোন স্যারই আমাকে বাসায় এসে পড়াতে রাজি হননি।এটা ২০০৪ সালের ঘটনা।তখন আমি এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
আমার বাবা ছিলেন পরিসংখ্যান কর্মকর্তা।বাবার চাকরির সুবাদে আমরা তখন থাকি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলায়।
আমি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী।হাঁটাচলা করতে পারি না একদমই।আমার শারীরিক পরিস্থিতি এতোটাই ভঙ্গুর ছিলো যে তা দেখে কোন শিক্ষকই প্রাইভেট টিউটর হিসেবে আমার দায়িত্ব নিতে চাননি।তাদের ধারনা ছিলো,শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত এই ছেলেটি পড়াশোনায় তেমন ভালো করবে না।
একমাত্র ঐ শাহজাহান স্যারই জোনাকির আলোর মত আমার জীবনে এসেছেন।স্যার বিনা সংকোচে আমার প্রাইভেট টিউটর হিসেবে দায়িত্ব নেন।
তিনি আমাকে নিজের আপন ভাইয়ের চোখে দেখতেন।অনেক সময় স্যার নিজে আমাকে কোলে করে নিয়ে পরীক্ষার হলে গিয়েছেন।তার কাছে এক জীবনে আমার অনেক জীবনের ঋণ।
আর সেই স্যার কি না আজ আমাকে ভুল বুঝে এসব বলছেন! আমি স্যারকে বললাম,
'আমি কি অপরাধ করলাম বলবেন তো স্যার?আমি কি কোন বেয়াদবি করেছি?স্যার যদি ভুল করি তো আপনার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবো'
স্যার বললেন,জীবনে কতবার কইছি তুমি ভালো হইয়া যাবা,হাঁটতে পারবা।এখন তুমি হাঁটতে পারো অথচ আমারে একটাবার কইলা না,অথচ তোমারে নিয়া বইসা আমি শবে বরাতের রাতে কান্না করছি'!
আমি স্যারকে বললাম,কসম করে বলছি আমি এখনো হাঁটতে পারি না,বাসায় এসে দেখে যান!
স্যার বললেন,'
'ওরে বদ আমি নিজের চোখে তোমারে হাঁটতে দেখছি,আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করছে।আমার দোয়া মিস হয় নাই,মনে আছে ২০০৫ সালে শবে বরাতের রাইতে আমি কইছিলাম?'
আমার মনে পড়লো,২০০৫ সালের শবে বরাতের রাতে স্যার আমাকে নিয়ে নামাজে বসেছিলেন।আমাকে নামাজ,দোয়ার বিভিন্ন নিয়ম বুঝিয়ে দিয়েছেন।আমার পরিস্কার মনে আছে স্যার বলেছিলেন,
'ডাক্তার কইছে তুমি জীবনে হাঁটতে পারবা না,আল্লাহ তো কয় নাই!সুতরাং আইজ সারা রাইত আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করো,আমিও করি'
আমি বলেছিলাম,এতে কি লাভ হবে? জবাবে স্যার বলেছিলেন,
'মানুষের মন অতি ছোট,চাইলেও দেয় না আর আল্লাহ হইলো দয়ার সাগর,চাইলেই দিয়া দেয়,কাজেই যা চাওয়ার তার কাছে চাইবা...'
এসব কথা মনে করতে করতেই এক সময় স্যার অভিমানে ফোন কেটে দিলেন।সাথে সাথে তিনি কলব্যাক করে বললেন,আমি ফেসবুকে সব দেখছি সোহাগ!
এ কথা শুনে এবার আমিই স্যারের ফোন কেটে দিলাম।
আমার আর ঘটনা বুঝতে বাকি রইলো না যে আসলে কি হয়েছে...
আমার সহজ সরল স্যার প্রযুক্তি বিষয়ে সামান্যই বোঝেন।এমনকি উনার ফেসবুক একাউন্টও আমি খুলে দিয়েছি।হাতধরে বুঝিয়ে দিয়েছি আপনি এভাবে অমুক তমুকের ছবি,ভিডিও ফেসবুক প্রফাইলে দেখবেন।
নিশ্চিত আজ তিনি ফেসবুকে আমার এআই জেনারেটেড ভিডিও দেখেছেন আর ভেবেছেন সোহাগ এখন হাঁটতে পারে।আমি সম্প্রতি এআই প্রযুক্তির সাহায্যে কিছু ভিডিও বানিয়েছি।ভিডিওগুলোতে আমি দেখিয়েছি যে আমি সুস্থ মানুষের মত হাঁটছি।সেই সব ভিডিও আমি নিজের ফেসবুক প্রফাইলে প্রকাশ করি।
আমি আর স্যারকে কলব্যাক করিনি।আমি চাই স্যার তার বহুদিনের দোয়া অবশেষে কবুল হয়েছে ভেবে নিয়ে আমার জন্য নতুন কোন দোয়া করুন।
এই ঘটনার পর আমি খুব চেষ্টা করছি নতুন একটি এআই জেনারেটেড ভিডিও বানাতে।এখানে আমি দেখাবো,আমি আমার একমাত্র মেয়ে সোহাকে কোলে নিয়ে বাংলাদেশের গ্রামের কোন পথে হেঁটে যাচ্ছি।কিন্তু সেই কাল্পনিক ভিডিওটা আমি কিছুতেই বানাতে পারলাম না।
সোহার আম্মু বললো,তুমি তো খুব বাস্তববাদী মানুষ,তো হঠাৎ করে বদলে গিয়ে কাল্পনিক ছবি,ভিডিও বানাচ্ছো কেন? তুমি কি বদলে গেছো?
আমি বললাম,
'স্বাভাবিক একটা বিষয় তবুও ভাবতে সবার অবাক লাগে;ঠিক এমন করেই বদলায় সব,যেমনটা তুমি চাওনি আগে।'
অনেকটা হতাশ হয়ে আমি ১১ সেপ্টেম্বর রাতে হু হু করে কাঁদতে লাগলাম।আমার স্ত্রী বললো,কাল্পনিক একটা ভিডিও বানাতে পারোনি বলে কান্নার কি হলো?
আমি তাকে বললাম,
'আমি তো জানি আমি কোনদিনই সোহাকে কোলে নিয়ে ঘুরতে পারবো না।কিন্তু আমি চাই সোহাকে কোলে করে নিয়ে হাঁটার ভিডিও আমার স্যার দেখুক!'
সোহার আম্মু বললো,এতে কি লাভ কি হবে?
আমি এবার হাসি দিয়ে বললাম এরপর নিশ্চিত স্যার আমাকে ঝাড়ি দিয়ে বলবে,
'সোহাগ,তুমি তোমার মেয়েরে কোলে কইরা নিয়া ঘুরতে গেলা তাও আমারে সঙ্গে নিলা না?'
আমি চাই এই পৃথিবীর অনন্ত একটি মানুষ ক্ষনিক সময়ের জন্য জানুক সোহাগ এখন হাঁটতে পারে,তার মেয়েকে কোলে নিয়ে যেখানে খুশী বেড়াতে যেতে পারে।পোস্টে দেয়া ছবিতে আমার মেয়ে সোহা।
আমার খুব জানার আগ্রহ আমার হাঁটতে চলা জীবনের জন্য স্যার যে দোয়া করেছেন,সেটি কবুল হয়েছে ভেবে এরপর তিনি আল্লাহর কাছে কি মোনাজাত করেছেন?
স্যার কি বলেছেন,আল্লাহ তোমার দরবারে লাখো লাখো শুকরিয়া যে সোহাগ এখন হাঁটতে পারে,সোহাকে কোলে করে নিয়ে বেড়াতে পারে...
তার এই কথা সাত আসমানের কতদূর পর্যন্ত পৌঁছাবে?
মনে মনে বললাম,
ক্ষমা করে দেবেন শ্রদ্ধেয় শাহজাহান সোহেল স্যার।
কত কথা হয় না বলা,রয়ে যায় কেবল শব্দ শোক;
জীবন চেনে মুক্তো ঝিনুক,মৃত্যু চেনে আপন লোক...
কত কথা বলার ছিলো তবুও চুপ হয়ে গেছি কবে,
কত স্বপ্ন ছিলো,জানি সত্যি নয়,তবু আমারই রবে...
১১ সেপ্টেম্বর ভোররাতে এসব ভাবতে ভাবতেই ফজরের আযান কানে এলো।নামাজ পড়তে যাবো এমন সময় সোহা ঘুম থেকে উঠে আমার বুকে হাত দিচ্ছে।আধো আধো বুলিতে সোহা কি বলছে জানি না।
তবে এটা জানি বুকের ঠিক যেখানে সোহা হাত দিয়েছে সেখানেই তাকে নিয়ে আমার অসংখ্য স্বপ্ন জমা আছে।
হয়তো সোহা বলছে,
'বাবা,তোমার স্বপ্নগুলো কুয়াশা,ভীষণ ঝাপসা এবং অধরা;
আমি সেখানে ভোরের আলো,আমায় জড়িয়ে ধরে ওরা...'
©