17/09/2025
আমার একমাত্র আপুর বিয়ে যখন প্রায় ঠিকঠাক তখনি আমি ছেলে পক্ষের সবার সামনে গিয়ে বললাম,
- আমার আপু লুবনার আগে ও একটি বিয়ে হয়েছে। আপনারা হয়তো জানতেন না, তাই সবাইকে জানিয়ে রাখলাম।
আমার কথা শুনে ছেলে প*ক্ষের সবাই চোখ বড় বড় করে তাকাল। ছেলের মা দ্রুত গলায় বললো,
- এতো বড় একটি ঘটনা আমাদের কাছে গোপন রেখেছিল ? কতো বড় সাহস! বিয়ে দেওয়া মেয়েকে এসেছে আবার বিয়ে দিতে। আমার ছেলেটার কি কোন মূল্য নেই ?
আমি সহজ গলায় বললাম,
- যার সাথে আপুর বিয়ে হয়েছিল এখন কোন ধরণের সম্পর্ক নেই। ছয় মাস হলো ডিভোর্স হয়েছে।
ছেলের বাবা বললো,
- এসেছিলাম ভালো দেখে একটা মেয়েকে বিয়ে করিয়ে নিয়ে যাবো। এই রকম ডিভোর্সী মেয়েকে বিয়ে করাতে আসি নাই। এই তোমরা সবাই এখনো বসে আছো কেন ? উঠো সবাই, এই বাড়িতে এক মিনিট থাকলে এক মিনিটের সময়টাই লস হবে।
ছেলে পক্ষের সবাই সোফা থেকে উঠে যাচ্ছে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম - ডিভোর্সী মেয়ে মানেই কি খুব খারাপ ? আপু কি ভালো মেয়ে নয় ?
ছেলে পক্ষের সবাই চলে যাওয়ার পর আপুর রুমের কাছে গিয়ে দেখি দরজা বন্ধ করে রেখেছে। নিঃশব্দে দরজার কাছে মাথাটি লাগাতেই ভেতর থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দটা তীক্ষ্ণ ধা*রালো ছু*রির মতো হৃদয়ে আ*ঘাত করলো।
পেছন থেকে আসা পায়ের শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি মা প্রচণ্ড জেদ নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে কিছু বুঝে উঠার আগেই ঠাস করে আমার গালে একটি চ'ড় বসিয়ে দিলো। এতো জোরে চ*ড় মা*রলো সাথে সাথে আমার পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। মাকে কিছু বলার আগেই আমাকে কঠিন গলায় বললো,
- লুবনার আগে ও একবার বিয়ে হয়েছে এই ঘটনাটি সবাই জেনে ফেলেছে বলেই তো বাসা পরিবর্তণ করে এতো দূরে আসলাম। বাসা পাল্টিয়ে এতো দূরে এসে কি লাভ হলো ? কে বলেছে সবার সামনে গিয়ে পুরোনো সত্যিটা বলে দিতে ? শুনি কে বলেছে ? তর বোন লুবনাকে বিয়ে দিতে হবে তো, নাকি হবে না ?
আমি প্রচণ্ড ব্য'থায় গালে হাত দিয়ে শীতল গলায় বললাম,
- সত্যিটা কেন ঢেকে রাখবো, যেটা সত্যি সেটা আমি বলবই। ছেলে পক্ষ যদি বিয়ে করতে হয় সত্যিটা জেনেই করবে।
মা আফসোসের সুরে বললো,
- এই রকম একটা ছেলেকে শুধু তর কারণে হাতছাড়া করতে হলো। ছেলে ইটালিয়ান প্রবাসী, বিয়ের পর লুবনাকে সহ ইটালি নিয়ে যেতো। একটা কথা মনে রাখবি, এই যুগে সত্যি কথার দাম নাই। এই যুগে মিথ্যা না বললে এগিয়ে যাওয়াটা খুব কষ্টের।
•
ভার্সিটি থেকে পড়াশুনা শেষ করে এখন একদমই বেকার বসে আছি। একটি মেসে উঠে চাকুরীর ইন্টারভিউ প্রিপারেশন নিচ্ছি আর বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছি। কয়েকটা রেজাল্ট আটকে আছে। যে কয়েকটার রেজাল্ট দিয়েছে কোথা ও চান্স আসছে না।
কোথা ও চাকুরি হচ্ছে না দেখে আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আকবর সাহেব আমাকে সিভি নিয়ে কুমিল্লায় যেতে বললো। প্রাইভেট ফার্ম, বেতন অনেক ভালো। চাকুরীতে যে সুযোগ সুবিধা দিবে তাতে করে অনেক ভালো ভাবেই চলা যাবে। সিভি নিয়ে রিসিপশন রুমে ঢুকার পর আমাকে ইন্টারভিউ রুমে পাঠানো হলো। কম্পানির ইন্টারভিউ নেওয়া কর্মকর্তা সিভি দেখে কয়েকটি প্রশ্ন করার পর বললো,
- শুনেছি তুমি আকবর সাহেবের আপন ভাগিনা। চাকুরীর অভিজ্ঞতা ও নাকি আছে এক বছরের। যেহেতু ভাগিনা তাহলে চাকুরীর নিয়ম কানুন নিশ্চয় আকবর সাহেব সবই বলেছে।
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
- আকবর সাহেব তাহলে মিথ্যা বলেছে, আমি ওনার ভাগিনা নই। সম্পর্কের দিক দিয়ে ওনি আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এতটুকুই। এখনো কোথাও জব শুরু করি নাই, চাকুরীর অভিজ্ঞতা আসবে কোথা থেকে ?
কর্মকর্তা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো। দ্রুত গলায় বললো,
- আকবর সাহেবের এতো বড় একটি মিথ্যা কথা বলার কি দরকার ছিল ? আমাকে বলছিল, তুমি তার একমাত্র বোনের ছেলে।
- স্যার, তাহলে হয়তো অন্য কারো কথা বলেছে। আমার কথা নয়।
- ঠিক আছে, তাহলে তুমি এখন আসতে পারো।
সিভি হাতে নিয়ে বাসায় আসার পর বাবা সবকিছু শুনে ধমক দিয়ে বললো,
- জীবনে চলার পথে একটু আধটু মিথ্যা বলতেই হয়। তুই আকবর হোসেনের ভাগিনা এটা মেনে নিলে কি সমস্যা হতো ? তুই এতো বোকা কেন, এখনকার যুগে চাকুরি হাতে পেলে মানুষ একটা কেন হাজারটা মিথ্যা বলতে পারে।
আমি জবাব দিলাম না, মাথা নিচু করে বারান্দায় চলে আসলাম।
•
বাড়ি থেকে মেসে আসার পর ক্লান্ত শরীরে বিছানায় শুয়ার কিছুক্ষণ পরেই রুমের দরজায় কে যেন টোকা দিলো। উঠে দরজা খুলে দেখলাম মাঝ বয়সী একজন পুরুষ সাথে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে বললো,
- এটা কি আবিরের রুম ?
- জ্বী আন্টি, এটাই আবিরের রুম। আমি তার রুমমেট। আবির বেশীরভাগ সময় রুমের বাইরে থাকে, এখনো বাইরেই আছে।
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে বললো,
- তুমি আবিরের রুমমেট, তুমি নিশ্চয় সবকিছু জানো। আবির নামের ছেলেটাকে আমার মেয়ে বিয়ে করতে চাচ্ছে। মেয়েটাকে কোন ভাবেই বোঝাতে পারছি না। আচ্ছা বল তো আবির ছেলেটা কেমন ?
আমি সহজ গলায় বললাম,
- আন্টি আপনার মেয়েকে বলবেন সাবধান হয়ে যেতে। আবির ছেলেটার আপনার মেয়ের মতো আরো অনেকের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। প্রায় সময় আবির সারারাত একটার পর একটা মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলে।
আন্টি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো। থমথমে গলায় বললো,
- বলছো কি এসব ? মেয়েটার কপালটাই খারাপ, নয়তো এই রকম চরিত্রহীন একটা ছেলেকে নিয়ে বিয়ের স্বপ্ন দেখতো না।
আন্টির কপাল বেয়ে ফোটা ফোটা ঘাম পড়ছে। আমি রুমের ভেতরে এসে বসতে বললাম। আন্টি বসলো না। বিষণ্ণ মনে বাসায় ফিরে গেলো।
সন্ধ্যার একটু পর পরই মোবাইলে অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে ফোন আসলো। ফোনটি রিসিভ করতেই কর্কশ গলায় মেয়ে কণ্ঠে আমাকে বললো,
- আপনি এই কাজটি কিভাবে করতে পারলেন ?
- কোন কাজটি ?
- ঠিক আছে আগে পরিচয় দিচ্ছি। আমি আবিবের গার্লফ্রেন্ড। আজকে আবিরের কাছে বাবা- মা দু'জনকে পাঠিয়েছিলাম দেখে আসতে। আবিরকে পায়নি, আপনাকে পেয়েছে। আপনি মায়ের কাছে আবিরের নামে যে নোংরা কথাগুলো বলেছেন বলার কারণে এখন আবিরকে আমি হারাতে বসেছি।
আমি সহজ গলায় বললাম,
- নোং*রা কথা বলতে যাবো কেন ? যা সত্যি তাই বললাম। তুমি আবিরের প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছো বলেই সত্যিটা বুঝতে পারছো না।
- আপনি এসব কথা বলে মায়ের মতো আমাকে বোঝাতে পারবেন না। আমি আর আবির ঠিক করেছি আজ রাতেই পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো।
মেয়েটার পা*গলামি দেখে ফোনটা কেটে দিলাম। ফোনটা টেবিলে রেখে ভাবলাম - পা*গলামি করে নেওয়া সিদ্ধান্ত ভবি*ষ্যতকে অ*ন্ধকার করে দিবে নাতো ?
•
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গলো মায়ের ফোনে। এতো সকালে মা কখনোই ফোন দেয় না। আজ দিয়েছে কেন ভাবতে ভাবতে ফোনটি রিসিভ করতেই মা বললো,
- শুনছিস কি হয়েছে ?
- না বললে কিভাবে শুনবো ?
মা জোরালো গলায় বললো,
- তর বোন লুবনাকে যে ছেলেটার সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম সেই ছেলেটা পাশের গলিতে থাকা রেশমার মেয়েকে বিয়ে করেছে। রেশমার মেয়েটার দুঃখী কপাল, নয়তো কি বিয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসতে হয়।
আমি শীতল গলায় বললাম,
- বলছো কি এসব, চলে আসতে হবে কেন ?
মা গলার স্বর নরম করে বললো,
- ছেলেটা প্রতিদিন রাতে মদ গাঁজা খেয়ে ঘরে আসে। ঘরে ঢুকে বৌয়ের গায়ে হাত তুলে। তুই বল, যেই ঘরে স্বামী মনের মতো হয় না। সেই ঘরে কিভাবে থাকবে।
মায়ের মুখে এসব কথা শুনে শরীরে একটি শীতল বাতাস বয়ে গেলো। মাকে কি বলা যায় ভাবতেই মা বললো,
- তুই এখনি বাড়ি চলে আস, আজ তর খালাত ভাই হাবীব আমাদের বাড়িতে আসবে। লুবনাকে নাকি তার ভীষণ পছন্দ, হাবীব মাত্রই তো গতমাসে চাকুরি নিলো। চাকুরীর একমাস না যেতেই তর খালাকে দিয়ে ফোন দিয়ে বললো, লুবনাকে বিয়ে করতে চায়।
লুবনার একবার বিয়ে হয়েছে, এটা জেনে ও হাবীব ভাইয়া আপুকে বিয়ে করতে চাচ্ছে শুনে মনটা আনন্দে ভরে গেলো। আমি ফোনটা কানের কাছে রেখেই বুঝতে পারছি আজকে মা নিজে ও অনেক আনন্দিত।
সময়টা যেন দ্রুত কেটে যাচ্ছে। বাড়ি আসার জন্য তাড়াহুড়ো করে বাসে উঠে ও দশটা বেজে গেলো। বাসে উঠার পর পরই মোবাইলে মেসেজ বেজে উঠেছে। মেসেজ চেক করতেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলাম। যখন মেসেজটা পড়ছি চোখ ভিজে উঠেছে আনন্দ অশ্রুতে। মেসেজে জানানো হয়েছে, সরকারি চাকুরীর জন্য দেওয়া ইন্টারভিউতে আমি চান্স পেয়েছি।
সূর্য ডুবে গিয়ে নতুন দিনকে আলোকিত করার প্রস্তুতি নেয়। মাঝখানে কেটে যায় অনেক সময়। হাবীব ভাইয়ার সাথে লুবনার ধূম ধাম করে বিয়ে হয়েছে। আজকে মাসের এক তারিখ ছিল, আজই চাকুরীতে এসে জয়েন করেছি। জয়েন করার প্রথম দিনটা একই সাথে ব্যস্ততা আর আনন্দে কেটেছে। অফিস থেকে ফিরে এসে রুমে ঢুকার পর পরই মোবাইলে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে রিং বেজে উঠলো। নাম্বারটি সেইভ করা না থাকলে ও কেমন যেনো পরিচিত লাগছে। ফোনটি রিসিভ করতেই কণ্ঠটি শুনে বুঝতে পারলাম এটা আমার এক সময়ের রুমমেট আবিরের গার্লফ্রেন্ড। মেয়েটা আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে বললো,
- ভাইয়া আপনি সেদিন ভুল কিছু বলেন নাই। আপনাকে বলেছিলাম দু'জনে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো। শেষ পর্যন্ত বাবা-মা রাজি না থাকায় ঠিকই দু'জনে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছি। আবির সম্পর্কে সবকিছু জানতে পারি আমাদের বিয়ের পর!
আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম,
- কি জানতে পেরেছ ?
মেয়েটা সাথে সাথে চোখের পানি ফেলে বরফ শীতল গলায় বললো,
- আবির আমাকে ঠকিয়েছে। আমাকে ছাড়া ও সে আরো দুটি বিয়ে করেছে। বিয়ে করা সেই দুটি মেয়ের সাথে সে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। অথচ দু'দিন পর আমাকে আমার বাড়ি দিয়ে এসে আর কোন খোঁজ নিচ্ছে না। ভাইয়া, সেদিন আপনার কথাগুলো নোংরা হলে ও বিশ্বাস করা উচিত ছিল।
আমি আত্মবিশ্বাসী গলায় বললাম,
- সত্যি কথা যতোই নোংরা মনে হউক তা বুঝার চেষ্টা করা উচিত। মিথ্যার তৈরি হয় সাময়িক সুখের জন্য, সত্যের তৈরি দীর্ঘস্থায়ী সুখের জন্য। দীর্ঘস্থায়ী সুখ শুধু তাদের কাছেই ধরা দেয় যারা সত্যের আশ্রয়ে এগিয়ে যায়।
মেয়েটা কি যেনো বলে যাচ্ছে, আবিরের নাম বলে শব্দ করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলার কারণে কি বলছে ফোনে কিছুই বুঝতে পারছি না।
ফোনটা রেখে ড্রয়িং রুমে গেলাম। মা টেবিলে প্লেট বিছিয়ে গরম ভাত নিয়ে এসেছে। খাওয়ার টেবিলে বাবাকে না দেখে বললাম,
- মা আজকে বাবা কোথায় গেছে ?
- তর বাবা লুবনার শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গেছে। শুন একটা কথা বলার ছিল ?
আমি দ্রুত গলায় বললাম,
- মা কি বলবে বলে ফেলো।
মা প্লেটে ভাত দিয়ে দিলো। তারপর খুব কাছে এসে বললো,
- অনেকদিন পর তরে একা পেয়েছি। সব সময় ঘরে কেউ না কেউ থাকেই তাই কথাটি জিজ্ঞাসা করা হয় না। আচ্ছা বলতো, সেদিন তর গালে অনেক জোরে একটি চড় বসিয়ে দিয়েছিলাম। তুই কি মায়ের প্রতি রাগ করে আছিস।
মায়ের কথা শুনে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে কোমল গলায় বললাম,
- মা মানে মমতাময়ী। শুধু আমি কেন ? মমতাময়ী মায়ের সাথে পৃথিবীর কোন সন্তানেরই রাগ করে থাকা সম্ভব নয়।
কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মা ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে ফেললো। মাথা নিচু করে মা তার আনন্দময় হাসি লুকানোর চেষ্টা করছে। মাকে চেষ্টায় সফল হতে দিচ্ছি না, একটু পর পর চোখ ঘুরিয়ে মায়ের সেই আনন্দ মাখা হাসি দেখার চেষ্টা করছি।
দীর্ঘস্থায়ী সুখ
Collected