24/05/2025
"আমি জানি আপনি বিবাহিতা, আপনার স্বামী আছে, তবুও কথাটা বলছি৷ আমার মনে হচ্ছে আপনি খুবই নিঃসঙ্গ বোধ করছেন। আপনার কি একজন সঙ্গী প্রয়োজন?"
মেসেজটা দিকে কয়েক পলক চেয়ে রইল অনন্যা। ধীরেসুস্থে মোবাইলটা তুলে নিয়ে উত্তর দিল, "কেন মনে হলো আমি নিঃসঙ্গ?"
"প্রায় রাতেই দেখি জেগে বসে থাকেন অনলাইনে।"
"হতে পারে কাজ করছি, কিংবা আমার কোনো বিজনেস আছে, হতে পারে না? ধরেই নিলেন আমি নিঃসঙ্গ?"
"আমার ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী।"
"আচ্ছা, যদি নিঃসঙ্গ হয়ে থাকি তাহলে কী করবেন?"
"আপনার একাকীত্ব দূর করার চেষ্টা করব।"
"কিভাবে?"
"কথা বলে, পাশে থেকে।"
"তাই? আপনি কি আনম্যারিড?"
"না, আমার স্ত্রী আছে, একটা মেয়ে আছে।"
"তাহলে আপনি এত রাতে অনলাইনে কী করছেন?"
"দেখুন, জাজমেন্টাল হবেন না। আমি কিন্তু আপনাকে জাজ করিনি, বরং সাহায্য করতে চেয়েছি। আমার স্ত্রী বাপের বাড়ি গেছে। আমার একা লাগছিল বলে অনলাইনে আসা। আপনাকেও প্রায়ই জেগে থাকতে দেখি বলে একটু সুখ দুঃখের কথা শেয়ার করতে এলাম।"
হাসল অনন্যা। হাসির ইমো পাঠালো। তারপর লিখল, "জানেন, বিয়ের পরপর আমার স্বামীর সাথে আমার দারুণ একটা সম্পর্ক ছিল! কী ভীষণ মিষ্টি ছিল সময়গুলো! আমাকে সে ‘মেঘকন্যা’ ডাকত। আমার চোখের দিকে চেয়ে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা। আমার হাতের রান্না ছাড়া এক বেলা বাইরে খেতে পারত না। আমাকে জড়িয়ে না ধরে ঘুমাতে পারত না। এজন্য আমাকে বাপের বাড়িও যেতে দিতে চাইত না।"
"আর এখন?"
"এখন সে আমাকে ভুলে গেছে।"
"মানে?"
"মানে সিম্পলি ভুলে গেছে। আমি শুধু তার ছেলেমেয়ের মা। আমাকে সংসার চালানোর টাকা দিতে হবে, অসুখ হলে ডাক্তার দেখাতে হবে এটুকু দায়িত্ব সে হাসিমুখে পালন করে। আর কিছু বাকি নেই আমাদের মাঝে।"
"কেন এমন হলো?"
"কারন তার জীবনে অন্য কেউ এসেছে। এখন তাকেই ভালো লাগে। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, অন্য কারো জন্য জায়গা ছেড়ে দেবার সময় তার একবারো তার মেঘকন্যার কথা মনে হয়নি। মানুষের ভালোবাসা এত ঠুনকো কেমন করে হয় বলতে পারেন? কিছু মানুষকে তো দেখি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসছে, আমার কপালে সামান্য মিথ্যে ভালোবাসা, কিংবা বিয়ের পরের সামান্য রোমান্টিক সময়ই বরাদ্দ ছিল বোধহয়।"
"অন্য কেউ জীবনে আসার মানে তো এটা নয় যে সে আপনাকে ভালোবাসে না।"
"আপনি আপনার স্ত্রীকে ভালোবাসেন?"
"অবশ্যই।"
"তাহলে তার অনুপস্থিতিতে আমার একাকীত্ব দূর করতে এলেন যে? পুরুষ মানুষের মনে আসলে অনেক জায়গা থাকে তাই না?"
"আপনিও আমার মেসেজের উত্তর দিয়েছেন, কথা বলছেন, কিন্তু দোষ দিচ্ছেন আমার। আমি আমার পার্টনারের দোষ বলতে বসিনি, আপনি বসেছেন।"
"আপনি আমার দুঃখের কথা শুনতে চেয়েছেন বলেই বলছি। এটা ছাড়া আমার আর তো কোনো দুঃখ নেই। বাকি সব দিক থেকে পরিপূর্ণ আমি। কিন্তু জানেন, এই একটা কারনে হাসিখুশি মানুষ হাসতে ভুলে যেতে পারে, জীবনটা বিস্বাদ মনে হয়। যখন সে অন্য নারীর সাথে সময় কাটায়, আমি ব্যাপারটা কল্পনা করি, আমার মনে হয় আমার ভেতর স্লো পয়জনিং হচ্ছে। আমি বুঝি বেশিদিন বাঁচব না। মন মরে গেলে মানুষ কতদিন বাঁচে? বেশিদিন বাঁচা উচিত নয় তাই না?"
"আপনি তাকে ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন?"
"চাইলেই কি ছেড়ে দেয়াই যায়? আমার ছেলেমেয়েদের কী হবে? ওরা চমৎকার একটা জীবনযাপন করছে। ওদের মানসিক স্বাস্থ্যের খুব যত্ন নিয়েছি আমি ছোটো থেকেই। ওদের কাছে ওদের মা বাবা আইডিয়াল কাপল। এখন যদি তাদের বিচ্ছেদ হয় তাহলে ওরা কী পরিমাণে আঘাত পাবে কল্পনা করা যায় না। ওদের বাবা পরকীয়া করার সময় ওদের কথা ভাবেনি৷ এখন যদি আমিও না ভাবি, শুধুই নিজের দিকটা ভাবি, তাহলে ওদের সাথে কতটা ইনজাস্টিস হবে ভাবা যায়? এজন্য ওদের পৃথিবীতে এনেছি বলুন?"
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ নিরবতার পর লেখা হলো,
"আপনি নিজেও নাহয় আরেকটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ুন। যে লয়্যাল না তার সাথে লয়্যাল থাকার কোনো প্রয়োজন আছে?"
অনন্যা আবারও কিছুক্ষণ হাসল। তারপর লিখল, "এত সহজ নয়। আমি আমার স্বামীকে ভালোবাসি৷ এতকিছুর পরেও ভালোবাসি৷ কেন বাসি জানি না। বোধহয় ভালোবাসার অভ্যাস হয়ে গেছে। সবাই চাইলেই চিট করতে পারে না।"
"তাহলে জীবনের কাছে কি আপনার কোনো এক্সপেক্টেশন নেই?"
"আছে তো! এই যেমন ধরুন আমি এখনো রোজ আশায় থাকি সে অফিস থেকে ফিরে হাসিমুখে একটু গল্প করবে। বেশি না, ধরুন দশ মিনিট। তারপর ফোন চাপুক, আমি মেনে নেব। ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমার কপালে একটা চুমু খাক। একবার মেঘকন্যা বলে ডাক দিক!"
"খুব বেশি ব্যক্তিগত কথা বলে ফেলছেন না?"
"আপনাকে একেবারেই চিনি না জানি না বলে বলতে পারছি। এসব আমি কাউকে শেয়ার করতে পারি না। পরিচিত কেউ বা খুব কাছের বান্ধবীকেও শেয়ার করা সম্ভব নয়। সবাই আমার স্বামীকে ভীষণ রেসপেক্ট করে। আমি তার সম্মান কোথাও কমাতে চাই না।"
"আপনার স্বামী এখন কোথায়?"
"হয়তো তার প্রেমিকাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে কোথাও।"
"কী বলছেন এসব!"
"আমি শিওর আপনার স্ত্রীও আপনাকে বিশ্বাস করেন। রাত বিরাতে মহিলাদের মেসেজ দেয়ার কথাটা তিনি জানলে নিশ্চয়ই পছন্দ করবেন না। তাকে ভালোবেসে থাকলে এসব ছেড়ে দিন। ভালো থাকুন।"
লোকটা কিছু একটা লিখছিল। অনন্যা উত্তরের অপেক্ষা করল না৷ ব্লক করে দিল। সে কেন এই লোকটাকে এসব বলল জানে না। বলে এখন নিজেরই লজ্জা লাগছে। কান্নাও পাচ্ছে।
আজ রাহাত বাড়িতে নেই। বলেছে অফিসে প্রচন্ড কাজের চাপ৷ রাতে থাকতে হবে। অনন্যা বোকা নয়। সে জানে কোথায় থাকবে সে। তার মাঝে মাঝে সহ্যের বাঁধ ভেঙে যেতে চায়। ইচ্ছে করে দু-চোখ যেদিকে যায় চলে যেতে৷
**********
রাহাত মোবাইল হাতে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে বারান্দায়। বেডরুম থেকে একটা নারীকণ্ঠ ডাকছে তাকে, "তুমি কি সারারাত বারান্দায় বসে থাকবে? সকালে আমাদের অফিস যেতে হবে মনে আছে? কাল তো তোমাকে পাবো না৷ একটু কাছে এসে থাকো না!"
রাহাত কিছু বলল না৷ অফিস কলিগের সাথে তার এই সম্পর্কের কথা সে লুকিয়ে রেখেছিল সবার কাছেই। তার ধারণাও ছিল না অনন্যা কথাটা জানে।
আজ প্রেমিকার সাথে একান্তে সময় কাটাবার পর ঘুম আসছিল না বলে বারান্দায় এসে বসেছিল। অনন্যাকে অনলাইনে দেখে একটু অবাক হয়ে, কিংবা বলা যায় সন্দেহ থেকেই ফেক আইডি দিয়ে মেসেজ করেছিল তাকে। দেখতে চেয়েছিল অনন্যা কেমন রেসপন্স করে। যা করেছে তা সে আশা করেনি।
আচ্ছা, সে এতদিনেও কেন এটা বুঝতে পারল না যে অনন্যাকে সে বহুদিন মেঘকন্যা বলে ডাকেনি? অনন্যা তার সাথে এত কষ্টে আছে এটা সে সত্যিই জানত না। সে তো ভেবেছিল তার প্রেম পরকীয়ার কথা অনন্যা কোনোদিন ধরতেই পারবে না। তার মনেও হয়নি সে ওকে ঠকাচ্ছে। বরং মনে হয়েছে একটাই জীবন, একটু উপভোগ করলে দোষ কী? তার মানে তো এটা নয় যে সে অনন্যাকে ভালোবাসে না৷ কিন্তু ভালোবাসলে সে কি তাকে ঠকাতে পারত? আর যদি ভালো নাই বাসে, তাহলে এখন খারাপ লাগছে কেন?
এভাবে নিজের কাছে ধরা পড়ায় অদ্ভুত লাগছে তার৷ এখন অনন্যার সামনে কেমন করে যাবে সে? অনন্যা জানে না সে তার কাছেই তার কথা বলেছে।
বেডরুম থেকে বেরিয়ে এলো মেয়েটা। রাহাতের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, "কী ঘুমানোর ইচ্ছে নেই?"
রাহাত ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "বাসায় একটু সমস্যা হয়েছে। আমাকে যেতে হবে।"
"কী হয়েছে?" অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মেয়েটা।
"পরে বলব।"
রাহাত জামাকাপড় পরে বেরিয়ে পড়ল। রাতের মাত্র দুটো বাজে। এত রাতে বাসায় যাবার প্রশ্নই আসে না৷ সে বেরিয়ে এসেছে সেখানে থাকতে পারছিল না বলে।
এখানে ওখানে ঘুরে রাতটা কাটাল সে। খুব ভোরে অনন্যাকে ফোন করল সে।
অনন্যা সারারাত ঘুমায়নি। মাত্র চোখ লেগেছিল, ফোনের শব্দে জেগে উঠল সে।
"হ্যালো।"
ওপাশ থেকে ভেসে এলো রাহাতের গলা, "মেঘকন্যা, আমার একটা ভুল হয়ে গেছে। অনেক বড় ভুল। তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে?"
(সমাপ্ত)
#আয়নার_ওধারে
সুমাইয়া আমান নিতু