08/07/2025
রিজিক তো আল্লাহর হাতে – এই বিশ্বাস বাস্তবে কীভাবে বদলে দেয় জীবন?
"وَمَا مِن دَابَّةٍ فِي ٱلأَرْضِ إِلَّا عَلَى ٱللَّهِ رِزْقُهَا"
“পৃথিবীতে চলাফেরা করে এমন কোনো জীব নেই যার রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহ গ্রহণ করেননি।”
— (সূরা হুদ, আয়াত ৬)
মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় যে উদ্বেগগুলোর একটি, তা হলো রিজিক — অর্থাৎ জীবিকা, উপার্জন, খাবার, নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ। মানুষ দুশ্চিন্তা করে, নিজের এবং সন্তানের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকে। চাকরি পাব কি না, ব্যবসা চলবে কি না, টাকা আসবে কি না — এসব ভাবনা মানুষের মনকে ভারাক্রান্ত করে রাখে।
কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আমাদের কুরআনে এবং হাদীসে বহুবার আশ্বস্ত করেছেন — রিজিকের দায়িত্ব একমাত্র তাঁর উপর। শুধু এই একটি বিশ্বাস যদি কেউ হৃদয়ে গেঁথে নেয়, তাহলে তার চিন্তা, চরিত্র, লেনদেন, সম্পর্ক, মনোভাব — সবকিছু বদলে যেতে পারে।
চলুন দেখা যাক — এই বিশ্বাস বাস্তব জীবনে কীভাবে বদলে দেয় আমাদের জীবন:
---
🟩 ১. দুশ্চিন্তা কমে, হৃদয়ে প্রশান্তি আসে
যখন কেউ বিশ্বাস করে যে রিজিক আমার হাতে নয়, আল্লাহর হাতে — তখন সে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হতে থাকে।
সে ভাবে না:
“আজ কত টাকা আয় করলাম?”
“কাল যদি কাজ না থাকে?”
“অমুক আমাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে!”
বরং সে ভাবে:
👉 “আমার চেষ্টা করা দায়িত্ব, ফলাফল আল্লাহর হাতে।”
👉 “আমি চেষ্টা করবো হালাল পথে, বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা।”
এই চিন্তা মানসিক শান্তি ও আত্মবিশ্বাস দেয়। রাতের ঘুম হয় গভীর, কারণ সে জানে— রিজিকের মালিক জেগে আছেন।
---
🟩 ২. হালাল-হারামের পার্থক্য স্পষ্ট হয়
যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে, “রিজিক তো আল্লাহ দেন”, সে কোনোদিন হারাম পথে রিজিক খোঁজে না।
কারণ সে জানে —
🔹 ঘুষ খেয়ে লাভ নেই, আল্লাহ দিচ্ছেন না
🔹 সুদ খেয়ে আয় বাড়ে না, বরং বরকত কমে
🔹 চুরি, প্রতারণা করে মানুষকে ঠকালে রিজিক আসে না, পাপ আসে
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“একজন ব্যক্তি দীর্ঘ সফরে থাকে, তার চুল অগোছালো ও ধুলিময়; সে আকাশের দিকে হাত তুলে বলে: ‘হে আমার রব! হে আমার রব!’ অথচ তার খাওয়া হারাম, পান করা হারাম, পোশাক হারাম এবং হারাম উপার্জনে লালিত-পালিত হয়েছে। তবে তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে?”
— (সহীহ মুসলিম)
👉 তাই একজন মু’মিন মানুষ রিজিকের মালিক হিসেবে আল্লাহকে মানলে, সে হারাম পথকে পরিহার করে।
---
🟩 ৩. হিংসা-অহংকার দূর হয়
যে জানে, “এই মানুষটা বেশি কামায় করছে, কারণ আল্লাহ তাকে দিচ্ছেন”— সে আর হিংসা করে না।
সে ভাবে না: “ওর যা আছে, আমার নেই কেন?”
বরং ভাবে:
🔹 “আমার রিজিক আমি পাবই ইনশাআল্লাহ।”
🔹 “আমি চেষ্টা করি, বাকিটা আল্লাহর তাওফিক।”
আবার, যে বেশি উপার্জন করে, সে অহংকারও করে না। সে ভাবে না, “সব আমি নিজের যোগ্যতায় করছি।”
কারণ সে জানে —
“আমার দাতভর্তি খাবারও আল্লাহ না চাইলে গলার নিচে যাবে না!”
---
🟩 ৪. সবর (ধৈর্য) ও তাওয়াক্কুল (ভরসা) তৈরি হয়
রিজিক নিয়ে পরীক্ষা হতে পারে। দেরিতে আসতে পারে, কম হতে পারে, কষ্টসাধ্য হতে পারে। কিন্তু যারা রিজিকের মালিক হিসেবে আল্লাহকে চিনে, তারা ধৈর্য ধরে, আশা হারায় না।
🌿 কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য উপায় বের করে দেন এবং তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না। যে আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনি তার জন্য যথেষ্ট।”
— (সূরা আত-তালাক, আয়াত ২-৩)
এই আয়াত শুধু পড়ার জন্য নয়, হৃদয়ে গেঁথে নেওয়ার জন্য।
---
🟩 ৫. সুখের সংজ্ঞা বদলে যায়
যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তার কাছে রিজিক মানে শুধু টাকা নয়।
রিজিক মানে—
ভালো স্বাস্থ্য
ভালো পরিবার
সময়মতো খাবার
শান্তি
ঈমান
দোয়ার সুযোগ
প্রিয়জনের ভালোবাসা
👉 তাই সে ছোট জিনিসেও শোকর করে।
👉 বড় কিছু না পেলেও মন খারাপ করে না।
---
🟩 ৬. উন্নতি হয় আত্মিকভাবে এবং আখিরাতে
রিজিকের প্রতি আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা মানে শুধু দুনিয়ার সুবিধা নয় — বরং আখিরাতের সফলতা।
🔹 সে হালাল রিজিক খায়, তাই দোয়া কবুল হয়
🔹 সে অন্যের হক মারে না, তাই গোনাহ কমে
🔹 সে সব সময় আল্লাহর উপর নির্ভর করে, ফলে গুনাহ থেকে বাঁচে
🔹 সে দুনিয়াকে নয়, আল্লাহকে বেশি গুরুত্ব দেয়
---
🟩 ৭. পরিবার, সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা কমে
অনেক বাবা-মা সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা করেন — “সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে?”
কিন্তু যারা আল্লাহর উপর ভরসা করেন, তারা সন্তানদের জন্য চিন্তা করেন, কিন্তু ভয় পান না।
কারণ তারা বিশ্বাস করেন—
👉 “যেমন আমাকে রিজিক দিয়েছেন, তেমন আমার সন্তানকেও দেবেন।”
👉 “আমি শুধু হালাল উপার্জনের ব্যবস্থা করবো, বাকিটা আল্লাহর রহমত।”
---
🌸 রিজিকের জন্য আমাদের করণীয় কী?
✅ ১. হালাল পথে চেষ্টা
✅ ২. সময়মতো নামায
✅ ৩. বেশি বেশি ইস্তিগফার
✅ ৪. মা-বাবার খিদমত
✅ ৫. অন্যের হক আদায়
✅ ৬. নিয়ত ঠিক রাখা — “আল্লাহর জন্য উপার্জন করছি”
---
🤲 দোয়া:
اللَّهُمَّ اكْفِنِي بِحَلالِكَ عَنْ حَرَامِكَ، وَأَغْنِنِي بِفَضْلِكَ عَمَّنْ سِوَاكَ
"হে আল্লাহ! আপনি আমাকে হালালের মাধ্যমে হারাম থেকে বাঁচান, এবং আপনার অনুগ্রহে আমাকে আপনার বাদে অন্যের মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে মুক্ত করুন।"
---
✨ উপসংহার:
"রিজিক তো আল্লাহর হাতে" — এই বিশ্বাস মানুষকে শুধু ধৈর্যশীল নয়, বরং সাহসী, আত্মবিশ্বাসী, সংযমী ও সফল করে তোলে।
তাই আসুন আমরা নিজেরা এবং আমাদের পরিবারকে এই বিশ্বাসে গড়ে তুলি:
"রিজিকের মালিক মানুষ নয়, কোম্পানি নয়, সরকার নয় – একমাত্র আল্লাহ!"