01/04/2025
বাবার স্বপ্ন
রাতের নীরবতা ভেঙে টুংটাং শব্দে হঠাৎ ঘড়ির কাঁটা জানান দিলো মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। জানালার ওপাশে পূর্ণিমার চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে, আর সেই আলোয় আবছা দেখা যাচ্ছে সালাম চাচার ক্লান্ত মুখ। ঘরের এক কোণে বসে তিনি মৃদু হাসছেন, সামনে ছোট্ট ছেলেটি ঘুমিয়ে আছে, মাথায় আলতো করে হাত রাখলেন তিনি।
সালাম চাচা একজন দরিদ্র কৃষক। সারাদিন মাঠে কাজ করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফেরেন, কিন্তু ছেলের মুখ দেখলেই সমস্ত কষ্ট ভুলে যান। ছোট্ট রাকিব তার নয়নের মণি। রাকিব যখন জন্ম নেয়, তখন থেকেই তিনি নানা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ছেলেকে পড়াশোনা করিয়ে বড় করবেন, ডাক্তার বানাবেন কিংবা ইঞ্জিনিয়ার। যে কাজ তিনি করতে পারেননি, সেই স্বপ্নটুকু ছেলের চোখে দেখতে চান।
একদিন বিকেলে রাকিব বাবার কাছে এসে বলল, "বাবা, আমার খুব ইচ্ছে আমি বড় হয়ে বড় একজন মানুষ হবো।"
সালাম চাচা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "তুই তো আমার গর্বরে বাবা! আমি জানি তুই অনেক বড় হবি। কিন্তু তার জন্য তো পড়াশোনা করতে হবে, তাই না?"
রাকিব হেসে মাথা নাড়ল, "হ্যাঁ বাবা, আমি একদম ভালো করে পড়ব।"
কিন্তু দারিদ্র্য যে বড় কঠিন বাস্তবতা। ফসল ভালো না হলে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে যায়, ছেলের পড়াশোনার খরচ তো বহুদূর! তবুও সালাম চাচা নিজের চাহিদাগুলো কমিয়ে ছেলের বই, খাতা আর টিউশনের ব্যবস্থা করলেন। একেকদিন হয়তো নিজের জন্য ভালো খাবারও জোগাড় করতে পারেন না, কিন্তু রাকিবের বইয়ের টাকাটা ঠিকই জোগাড় করেন।
দিন যেতে থাকে, রাকিব বড় হতে থাকে। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো সে, স্কুলের সেরা ছাত্রদের একজন। শিক্ষকরা বলে, "ছেলেটির মধ্যে অসাধারণ প্রতিভা আছে, সুযোগ দিলে অনেক বড় হতে পারবে।"
এসএসসি পরীক্ষার ফল বের হলো, রাকিব জিপিএ-৫ পেলো! পুরো গ্রামে যেন আনন্দের বন্যা। কিন্তু আনন্দের মাঝেই সালাম চাচার মনে একটা চিন্তা ভর করল—ছেলের উচ্চশিক্ষার খরচ কীভাবে বহন করবেন? তবে তিনি দমে গেলেন না। নিজের শেষ সম্বল জমিটুকু বন্ধক রেখে ছেলেকে ভালো কলেজে ভর্তি করালেন।
রাকিব বুঝতে পারত বাবার কষ্ট। একদিন বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, "বাবা, তোমার স্বপ্ন আমি পূরণ করব। আমি প্রতিজ্ঞা করছি।"
বাবা শুধু ছেলেকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, কিছু বললেন না। তার চোখে আনন্দের জল চিকচিক করছিল।
সময় গড়িয়ে যায়, রাকিব এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বাবার কষ্ট কমানোর জন্য সে টিউশনি শুরু করে, পড়াশোনার খরচ নিজেই চালানোর চেষ্টা করে। একদিন বাড়ি ফিরে বাবাকে বলল, "বাবা, তোমাকে আর এত কষ্ট করতে হবে না। এবার থেকে আমি নিজেই নিজের খরচ চালাতে পারব।"
সালাম চাচা বিস্ময়ে তাকালেন ছেলের দিকে। যেন নিজের জীবনের সব স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে! কিন্তু শরীর যে আর আগের মতো চলে না, বয়সের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন তিনি।
কয়েক বছর পর রাকিব বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করল, মেধার জোরে ভালো চাকরিও পেলো। বাবার জন্য শহরে একটা ছোট্ট বাড়ি নিলো। বাবাকে শহরে এনে বলল, "বাবা, এতদিন তোমার কষ্ট দেখেছি, এবার আমি তোমার পাশে থাকব।"
সালাম চাচা চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। ছেলের সাফল্যে তিনি গর্বিত, আনন্দে বুকটা ভরে উঠল।
একদিন ছেলের অফিসে গিয়ে দেখলেন, সবাই তাকে সম্মান করে, ভালোবাসে। সেদিন তিনি জানালার পাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে শহরের আলো-আঁধারির দিকে তাকিয়ে ভাবলেন—পরিশ্রম বৃথা যায় না, স্বপ্ন সত্যি হয়।
সেই রাতে পূর্ণিমার আলোয় সালাম চাচার চোখে শান্তির ঘুম নেমে এল। ছেলেকে ঘুমন্ত দেখে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "তুই আমার গর্ব, রাকিব। তোর জন্য আমার সব স্বপ্ন পূরণ হলো।"
রাকিব ঘুমের মধ্যেই মৃদু হাসল, যেন বাবার মনের কথা বুঝতে পেরেছে। এক বাবা তার সন্তানকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখে, তার চেয়েও সুন্দর বাস্তবতা হতে পারে না।
Labib Hasan Lifestyle.