16/01/2025
পাঠ্য বইয়ে 'আদিবাসী' শব্দের বিতর্কিত প্রচ্ছদ: শিক্ষা ব্যবস্থার অসচেতনতা নাকি উদ্দেশ্যমূলক পদক্ষেপ?
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা জাতি গঠনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। পাঠ্যপুস্তক শুধু শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি তাদের মানসিকতা, মূল্যবোধ, এবং সামাজিক চেতনা গড়ে তুলতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয় পত্র বইয়ে 'আদিবাসী' শব্দের ব্যবহারে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। নবম-দশম শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয় পত্রের প্রচ্ছদে একটি বৃক্ষের বিভিন্ন পাতায় বিভিন্ন ধর্মের নাম লেখা হলেও একটি পাতায় ধর্মের নাম না লিখে লিখা হয়েছে ‘আদিবাসী’। প্রশ্ন হল ‘আদিবাসী’ কি কোনো ধর্মের নাম? যেহেতু বৃক্ষের অন্যান্য পাতায় নির্দিষ্ট ধর্মের নাম লেখা হলেও একটি পাতায় ধর্মের নাম না লিখে আদিবাসী নামক বিতর্কিত শব্দ লেখা হয়েছে সুতরাং স্পষ্ট যে এটা নির্দিষ্ট স্বার্থান্বেষী মহলের কঠোর চক্রান্তের অংশ। এই শব্দটি ব্যবহার নিয়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পর্যায়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এর পেছনের কারণ, প্রভাব, এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হলো।
'আদিবাসী' শব্দটি মূলত সেই সমস্ত জনগোষ্ঠীকে নির্দেশ করে, যারা একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বেই বসবাস করছিল। আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী, আদিবাসী জনগোষ্ঠী হলো এমন গোষ্ঠী, যারা তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, এবং ঐতিহ্য বজায় রেখে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকে বাস করছে।
বাংলাদেশে 'আদিবাসী' শব্দটি রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, এবং ইতিহাস রক্ষার কথা বলা হলেও 'আদিবাসী' শব্দের কোনো স্বীকৃতি নেই। সরকারিভাবে 'আদিবাসী' শব্দটির পরিবর্তে 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী', 'উপজাতি', বা 'মার্জিনালাইজড কমিউনিটি' শব্দগুলো ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নবম-দশম শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয় পত্র বইয়ের ২০২৫ সালের সংস্করণে 'আদিবাসী' শব্দের অন্তর্ভুক্তি নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই মনে করছেন, এটি সাংবিধানিক এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর।
'আদিবাসী' শব্দ ব্যবহারের পেছনে সম্ভাব্য কারণ
১. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং চাপ: জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশে বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীসহ কিছু সম্প্রদায়কে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আসছে। ফলে এই শব্দটি ব্যবহার করা আন্তর্জাতিক মহলের চাপের ফল হতে পারে।
২. অসচেতনতা এবং পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের গাফিলতি:
বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অনেক সময়েই ভাষাগত অসচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। এটি তেমনই একটি উদাহরণ হতে পারে, যেখানে শব্দটির প্রকৃত বিতর্ক এবং এর সাংবিধানিক অবস্থান বিবেচনায় আনা হয়নি।
৩. সামাজিক বিভাজনের রাজনৈতিক প্রভাব: 'আদিবাসী' শব্দটি ব্যবহার করে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হয়তো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে খুশি করার চেষ্টা করেছে। এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে।
পাঠ্যপুস্তকে এই শব্দ ব্যবহারের প্রভাব
১. শিক্ষার্থীদের মানসিকতা ও মূল্যবোধে প্রভাব:
পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। 'আদিবাসী' শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। তারা হয়তো ধরে নেবে, বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি রয়েছে, যা বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
২. জাতীয় ঐক্যের ওপর প্রভাব: বাংলাদেশ একটি বহু জাতিগোষ্ঠীর দেশ। এই ধরনের শব্দ ব্যবহার জাতীয় ঐক্যের বিপরীতে বিভাজনের বীজ বপন করতে পারে।
৩. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং জাতীয় স্বার্থ: আন্তর্জাতিক মহলের চাপের প্রভাব পাঠ্যপুস্তকে স্থান দেওয়া হলে, এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
প্রতিবাদের যৌক্তিকতা
১. সংবিধানের পরিপন্থী:
বাংলাদেশের সংবিধানে 'আদিবাসী' শব্দ ব্যবহার না করার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা সংবিধানের প্রতি অবজ্ঞার শামিল।
২. আঞ্চলিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি:
শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির পাশাপাশি এটি আঞ্চলিক সংঘাতকে উসকে দিতে পারে।
৩. জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি:
আন্তর্জাতিক মহল বা দেশবিরোধী শক্তি এই শব্দটি ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করতে পারে।
দেশপ্রেমিক নাগরিকদের দাবি
১. ভাষাগত শুদ্ধতা এবং সংবিধান-সম্মত শব্দের ব্যবহার: উক্ত পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়ার পূর্বেই সংস্করণ তথা 'আদিবাসী' শব্দের পরিবর্তে 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী' বা 'উপজাতি' শব্দ ব্যবহার করতে হবে।
২. পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা প্রক্রিয়া:
প্রতিটি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের আগে একটি বিশেষজ্ঞ দল দ্বারা যাচাই করতে হবে, যাতে বিতর্কিত বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া যায়।
৩. শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধি:
শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংবিধান এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে পাঠ্যপুস্তকে আলাদা অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
২০২৫ শিক্ষাবর্ষে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয় পত্র বইয়ে 'আদিবাসী' শব্দের অন্তর্ভুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এটি কেবল শিক্ষাব্যবস্থার অসচেতনতার ফল নয়; বরং এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। তবে এ ধরনের শব্দের অন্তর্ভুক্তি জাতীয় ঐক্য এবং সংবিধানের প্রতি সম্মানের পরিপন্থী। আর সংবিধান পরিপন্থী, দেশবিরোধী ও রাষ্ট্রদ্রোহী শব্দ বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকের প্রচ্ছদে স্থান পাবে তা কখনোই বরদাস্ত করবে না দেশ প্রেমিক বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ।