04/12/2025
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীঃ গোয়াইনঘাট যুদ্ধ (৪ ডিসেম্বর ১৯৭১)
১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে (৪ ডিসেম্বর) সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধে সফলতা অর্জন করে। বৃহত্তর সিলেট ও দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আশুগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য সিলেট-তামাবিল সড়কটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম। ভারত সীমান্ত থেকে দক্ষিণ দিকে জাফলং-সিলেটের মধ্যবর্তী স্থানে গোয়াইন নদীর তীরবর্তী গোয়াইনঘাট ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি শক্তঘাঁটি। চূড়ান্ত যুদ্ধের আগেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী কোম্পানীগঞ্জ থেকে সরে এসেছিল। সেখান থেকে তারা গোয়াইনঘাটে এসে তাদের প্রতিরক্ষা মজবুত করে তুলেছিল। গোয়াইনঘাট থেকে ১০ মাইল দক্ষিণে সিলেট বিমানবন্দরের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্যই গোয়াইনঘাট, নন্দীরগাঁ, কোম্পানীগঞ্জ এবং সালুটিকর ফেরিঘাট পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজ আয়ত্তে রাখে। গোয়াইনঘাট হাতছাড়া হওয়ার অর্থই ছিল সিলেটের পতন এবং শহরের চতুর্দিকের প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে যাওয়া। গোয়াইনঘাট থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাধানগর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে রসদ সরবরাহ পাঠাত।
এমতাবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে গোয়াইনঘাট দখল ক্রমশই অনিবার্য হয়ে ওঠে। মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে মিত্র বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়নকে সঙ্গে নিয়ে গোয়াইনঘাটের ওপর আঘাত হানে। গোয়াইনঘাটের প্রথম যুদ্ধ পরিকল্পনামাফিক কার্যকর করা না গেলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, তাতে তাদের মনোবল ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। গোয়াইনঘাটে অবস্থানরত পাকিস্তানি ৩০ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অপারগতা প্রকাশ করে ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়। অবশেষে পায়ে হেঁটেই তারা সিলেটের দিকে ফিরে যায়। আক্রমণের এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডি কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নবী ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি 'এ' ও 'ডি' কোম্পানি এবং গণবাহিনীর ১টি কোম্পানির সমন্বয়ে মূল আক্রমণ দল গঠন করেন। অতঃপর, ৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ০৪:৩০ মিনিটে আক্রমণের সময় নির্ধারিত হয়।
পরিকল্পনা অনুসারে ৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ৩ টার পর মুক্তিবাহিনী তাঁদের নিজ নিজ অবস্থান গ্রহণ করে। সেই রাত ছিল ঘন কুয়াশায় আবৃত। ক্যাপ্টেন নবী ভোর ৪টার মধ্যে সকল কোম্পানির মধ্যে সমন্বয়সাধন করে নদীর পশ্চিমপাড়ে একটি গাছের আড়ালে অবস্থান নেন। ভোর সাড়ে ৪টায় দক্ষিণপ্রান্ত থেকে সিগন্যাল পিস্তলের সবুজ ফায়ার সংকেতের সঙ্গে আক্রমণ শুরু হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরাও পালটা ফায়ার শুরু করে। সুদৃঢ় বাংকার থেকে তারা প্রচণ্ড প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। তবুও কিছুক্ষণের মধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যদের ভারী অস্ত্র, মর্টার, এমজি ইত্যাদি মুক্তিবাহিনীর রিকয়েললেস রাইফেলের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায়। এতে তাদের ফায়ার পাওয়ার অর্ধেক কমে যায়। ক্যাপ্টেন নূরুন্নবী সংকেত দিয়ে 'ডি' কোম্পানিকে নদী অতিক্রম করে আক্রমণের নির্দেশ দেন।
অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ২০টি নৌকায় কোনো বাধা ছাড়াই অভিযানিক দলটি নদী পার হয়ে পাকিস্তানিদের অবস্থানে পৌঁছে যায়। ইতোমধ্যে আঁধার ফিকে হয়ে আসে, পাকিস্তানি সৈন্যদের গোলাগুলির পরিমাণও কমে আসে। ভোর পৌনে ৬টায় হঠাৎ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলির দিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পাকিস্তানি সেনারা তখন সারিবদ্ধ হয়ে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছু হটা শুরু করে। মুক্তিবাহিনী মর্টার দিয়ে পলায়নরত পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে এবং একপর্যায়ে 'ডি' কোম্পানি সাফল্যের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান দখল করে নেয়। পাকিস্তানি সেনারা রণে ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন করে। মুক্তিবাহিনীর চমৎকার পরিকল্পনা, সাহস এবং বীরত্বের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সকল প্রতিরোধ। পরে দলে দলে অসংখ্য রাজাকারও মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এভাবে ৪ ডিসেম্বরে গোয়াইনঘাট মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে।