21/05/2025
জ্যৈষ্ঠ মাসের ঠিক এমনই এক দিনে, আমি আর আকিব বেরিয়ে পড়েছিলাম এক গন্তব্যহীন সাইকেল যাত্রায়। কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না—শুধু পথের ডাক আর দুটো চাকা। হবিগঞ্জ শহর ছাড়িয়ে আমরা পৌঁছাই প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের টঙ্গীর হাটে। সেখান থেকে আরও ৩–৪ কিলোমিটার কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে পৌঁছে যাই এক পুরোনো বাগানবাড়িতে।
বাগানবাড়িটিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে সারি সারি আমগাছ—কমপক্ষে কুড়িটির মতো। ঝিরঝিরে হাওয়া, কাঁচা আমের টক গন্ধ আর দূরের কোথাও পাখির ডাক মিলিয়ে চারপাশটা এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে উঠেছিল। বাড়িটিতে মালিকপক্ষের কেউ ছিলেন না, ছিলেন কেবল একজন পাহারাদার। কিছু কথাবার্তায় তাঁকে ম্যানেজ করতেই মুহূর্তে আমরা আম পাড়ার উৎসবে মেতে উঠি।
সেদিনটা ছিল নিখাদ আনন্দের—প্রকৃতির ছোঁয়ায় ভরা, একেবারে নির্ভেজাল প্রশান্তির দিন।
সেই স্মৃতির রেশ ধরেই এবার আকিব আবার বায়না ধরল—“চল, আবার ঐখানে যাই!”
ছেলেটা ছিল একেবারে নাছোড়বান্দা। আমি বললাম, “ঠিক আছে, তবে পরীক্ষার পর।”
কিন্তু নগর অর্থনীতি পরীক্ষার আগেই হঠাৎ পাওয়া চার দিনের ছুটিতে একঘেয়েমিতে মনটা হাঁসফাঁস করছিল। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম—এই শুক্রবারেই আবার ছুটে যাওয়া যাবে সেখানে।
তবে এবার আকিবকে আমি কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছিলাম। মজার ব্যাপার হলো, ছেলেটা একে একে সব শর্তই পূরণ করে ফেলল!
ঐ দিন দুপুর গড়িয়ে সাড়ে তিনটার দিকে আমরা যাত্রা শুরু করি। রওনা দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশে ঘন মেঘের আনাগোনা শুরু হয়। আগের রাতেই বৃষ্টি হয়েছিল, তাই কাঁচা মাটির রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে যাওয়া ছিল একেবারেই বোকামি।
তবু, আমরা শেষটা দেখতে চাইলাম।
ভেজা, কর্দমাক্ত, পিচ্ছিল সেই রাস্তায় সাইকেল চালানো ছিল ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ। একটু সামনে এগোতেই হঠাৎ আমি সাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে যাই।
তবে ভাগ্যক্রমে তেমন কোনো ব্যথা পাইনি। কাদা-মাখা হাত, গা ধুয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবার সাইকেল চালাতে শুরু করলাম। কিছুদূর এগোতেই আমরা পৌঁছে যাই আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে—বাগানবাড়িতে।
কিন্তু গিয়ে দেখি, সেই চিরচেনা রূপ আর নেই।
চারদিকে গড়ে উঠেছে উঁচু ইটের প্রাচীর। আগের সেই উন্মুক্ততা, সেই অবাধ প্রবেশের আনন্দ—সব যেন এখন অতীত। সামনের ফটকে বড়সড় তালা ঝুলছে।
বাগানবাড়ির ভেতরটা দেখা যায় না, কেবল বাইরের নিঃস্তব্ধতা টের পাওয়া যায়। গাছগুলো কোথাও চাপা পড়ে গেছে ইট-বালুর আড়ালে, কোথাও হয়তো কেটে ফেলা হয়েছে।
আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
অতীতের প্রাণবন্ততা আর বর্তমানের এই নীরব সীমাবদ্ধতার মাঝে একটা ভারী হাওয়া বইতে লাগল।
চোখাচোখি হতেই দুজনেই হেসে উঠলাম হঠাৎ। তখন আমরা নিজেদেরই বলছিলাম,
“কাঁচা আম টক, কাঁচা আম টক!”
শুধু আমের স্বাদ নয়, জীবনের কত কিছুই যে টক লাগে—ঠিক যেমন আজকের ফিরে আসাটা।
ফিরতি পথে অপেক্ষা করছিল আরেকটা ভয়ানক অভিজ্ঞতা।
আকাশ তখন আরও বেশি গোমড়া মুখ করে উঠেছে। মেঘে ঘনঘটা, দূরে বজ্রপাতের গর্জন কানে বাজছে। যেহেতু আমাদের ফেরার পথের শুরুটা ছিল ৩–৪ কিলোমিটার কাঁচা মাটির রাস্তা, তাই আমরা ঠিক করলাম—যেভাবেই হোক, বৃষ্টি পড়ার আগেই পিচ রাস্তায় উঠে যেতে হবে।
তড়িঘড়ি করে সাইকেল চালাতে লাগলাম। কাদা আর ভেজা রাস্তায় প্যাডেল চালানো তখন রীতিমতো যুদ্ধ।
আমাদের শরীরজুড়ে তখন উত্তেজনা, ভয় আর বৃষ্টির সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার একরকম লড়াই।
কিন্তু বিধি বাম।
তীরে এসে তরী ডোবার মতো, ঠিক পিচ রাস্তার কাছাকাছি আসতেই শুরু হলো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি।
গায়ে, মুখে, চোখে বৃষ্টির ঝাপটা পড়তে লাগল। চারপাশে অন্ধকার আর বজ্রের গর্জন মিলেমিশে এক অদ্ভুত দৃশ্য তৈরি করল।
পিচ রাস্তায় উঠতে পারলেও ভিজে কাপড় আর কাঁদামাখা সাইকেলে আমরা তখন ক্লান্ত, কিন্তু তৃপ্ত দুই অভিযাত্রী।
এদিকে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ভিজেই যখন গিয়েছি, সাইকেল চালিয়েই যাব। তবে একটা সমস্যা—আমাদের চশমা।
চশমাধারীদের এক বিরাট শত্রু হলো বৃষ্টি। কারণ, চশমা ঘোলাটে হয়ে যায়। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হলো। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে চশমা ঝাপসা হওয়ায় কিছুক্ষণ সাইকেল চালিয়ে থামতে বাধ্য হলাম।
পাশেই ছিল রজবপুর মসজিদ। মসজিদের অজুখানায় গিয়ে আশ্রয় নিই আমরা।
ইমাম সাহেব ছিলেন অসাধারণ ভদ্রলোক। তিনি আমাদের দেখে ছুটে এসে বললেন,
“উনার রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারি।”
কিন্তু আমাদের শরীর তখন পুরোপুরি ভেজা—তাঁকে কষ্ট দিতে চাইনি।
পরবর্তীতে কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থামলে আমরা হবিগঞ্জের দিকে রওনা দিলাম।
জীবনের প্রতিটি যাত্রাই আমাদের কিছু না কিছু শেখায়।
সেদিন আমরা শুধু কাঁচা আম নয়, অনুভব করেছি স্মৃতির স্বাদ, সময়ের রূপান্তর, আর প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন।
একটা জায়গা বদলে গেলে শুধু জায়গাটাই বদলায় না—বদলে যায় সেখানে জড়ানো অনুভূতির রংও।
তবু, ভেজা শরীর আর কাদা-মাখা সাইকেল নিয়ে ফিরে আসা দুই ক্লান্ত অভিযাত্রীর মনে একটাই কথা বাজছিল—
“আবার কোথাও, হঠাৎ করেই, হয়তো বেরিয়ে পড়া হবে—গন্তব্যহীন, কিন্তু স্মৃতিময় এক যাত্রায়।”
তামিম মাহমুদ চৌধুরী
২'রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ