12/02/2021
তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহ অর্থ হল বিচার (হুকুম) এবং আইন প্রণয়ণের (তাশরী’) অধিকার শুধুমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার। আধিপত্য , রাজত্ব , সার্বভৌমত্ব এবং সৃষ্টির বিষয়াবলী নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যেমন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কোন শরীক নেই , তেমনি ভাবে বিচার (হুকুম) এবং আইন প্রণয়ণের (তাশরী’) ক্ষেত্রেও আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কোন শরীক নেই।
এটি তাওহীদের এমন একটি শ্রেনী যা উলামাদের অনেকে আলাদা নামকরণ করেছেন ঠিকই কিন্তু এর সার বক্তব্য লুকিয়ে আছে তাওহীদের মৌলিক তিন প্রকারের মাঝেই। এর বিশ্বাসের মধ্যে এমন বিষয় আছে যা তাওহীদুল উলূহিয়্যাহর ভেতরে পরে, এ বিশ্বাসের ভেতরে এমন বিষয় আছে যা তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহর ভেতরে পরে, আবার এর মধ্যে এমন বিষয় আছে যা তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাতের ভেতরেও পরে।
যেমন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন –
“... আল্লাহ ছাড়া কারও বিধান দেবার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে , তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করো না। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।” [সূরা আল আন’আমঃ ৪০]
এবং তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন-
“... আল্লাহ বিচার করেন, আর তাঁর বিচারকে (হুকুম) পশ্চাতে নিক্ষেপ করার কেউ নেই।” [সূরা আর-রা’দঃ ৪১]
এবং তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন-
“.. তিনি নিজ হুকুম ও বিধানের [ফী হুকমিহি] কর্তৃত্বে কাউকে শরীক করেন না।” [সূর আল-কাহফঃ ২৬]
এবং তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন-
“তারা কি জাহেলী যুগের বিচার- ফয়সালা কামনা করে ? আল্লাহ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্যে উত্তম ফয়সালাকারী কে ?” [ সূরা আল-মায়’ইদা ঃ ৫০]
এবং আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন,
“তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর না কেন – ওর মীমাংসাতো (হুকুম) আল্লাহ্রই নিকট।” [সূরা আশ-শূরাঃ ১০]
আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন-
“... যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর , তোমরাও মুশরিক হয়ে যাবে।” [সূরা আল আন’আমঃ ১২১]
এছাড়াও অন্য আরও সুস্পষ্ট (মুহকাম) আয়াতের দ্বারা তাওহীদের এ শ্রেণীটি (অর্থাৎ তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহ) প্রমাণিত , সুতরাং তাওহীদুল রুবূবিয়্যাহ, উলূহিয়্যাহ ও আসমা ওয়াস সিফাতের পূর্নাঙ্গ বিশ্বাসের মতোই তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহতে বিশ্বাস করা ব্যতীত কারো ঈমান সম্পূর্ণ হবে না।
এছাড়া রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সহিহ হাদিসে আছে - “নিশ্চয় আল্লাহ্ হচ্ছেন আল-হাকাম (বিচারক) , এবং হুকুম (বিধান , আইন প্রণয়ন) হল তাঁর অধিকার।” [আবু দাউদঃ ৪৯৫৫ , আন-নাসাঈ ৮/২২৬]
যখন আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তা ব্যাতীত কুফর ও তাগুতের সংবিধান দিয়ে শাসনের শিরক উম্মাহর মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহর কথা বলা ,এবং এর আবশ্যকতার দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করা দরকারী হয়ে পড়ে। এবং লোকেদের কাছে এও সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় যে , তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহর উপর বিশ্বাস আবশ্যক এবং একে বাদ দিয়ে তাওহীদুল ‘উলুহিয়্যাহর- বিশ্বাস করা সম্ভব না।
কেননা তিনি সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন –
“...অতএব, তোমরা মানুষকে ভয় করো না এবং আমাকে ভয় কর এবং আমার আয়াত সমূহের বিনিময়ে স্বল্পমূল্যে গ্রহণ করো না, যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের।” [সূরা আল-মায়েদাঃ ৪৪]
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন –
ইসলামের বন্ধনগুলো একটির পর একটি খুলে আসবে। যখনই একট বন্ধন খুলে আসবে, লোকেরা তার পরেরটিকে আঁকড়ে ধরবে। সর্বপ্রথম যে বন্ধন খুলে যাবে তা হবে শাসন (আল হুকুম), এবং সর্বশেষটি হল সালাত। [মুসনাদের আহমাদ, আল মু’জাম আল-কাবির আত-তাবারানি, সাহিহ ইবন হিব্বান]
সাইয়েদ কুতুব শহীদ (রহ.) তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহর ব্যাপারে বলেন, “আল্লাহ্র নিকট সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের একটি হল হাকিমিয়্যাহ। যখনই কেউ কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের জন্য আইন প্রণয়ন করে, তখনই সে নিজেকে আল্লাহর বদলে এমন আরেক প্রভুর ভূমিকাতে বসিয়ে নেয় যার আইনের আনুগত্য ও অনুসরণ করা হয়। আর যারা এই আইন প্রণেতা বা আইন প্রণেতাগণের আনুগত্য করে, তারা আল্লাহ্র গোলামের পরিবর্তে আইন প্রণেতাদের গোলামে পরিণত হয়। তারা অনুসরণ করে আইন প্রণেতাদের সৃষ্ট দ্বীনের, আল্লাহর দ্বীন ইসলামের না। জেনে রাখুন আমার প্রিয় ভাইরা, এটা আক্বিদার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। এটা হল উলুহিয়্যাহ (একমাত্র আল্লাহ্কে ইলাহ/উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করা) এবং ‘উবুদিয়্যাহর (একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব) প্রশ্ন। এটা হল ঈমান ও কুফরের প্রশ্ন। জাহিলিয়্যাহ এবং ঈমানের প্রশ্ন। জাহিলিয়্যাহ কোন নির্দিষ্ট সময় বা যুগ না, জাহিলিয়্যাহ হল একটি অবস্থা।“ [ফী যিলাল ইল ক্বুর’আন]
ইবনে কুদামা আল হাম্বালী (রহ.) বলেন,
“মুসলিমের আইন (শারীয়াহ) দ্বারা শাসিত প্রতিটি দার (ঘর, ভূমি, অঞ্চল) হল দারুল ইসলাম এবং কুফর আইন দ্বারা শাসিত প্রতিটি দার হল দারুল কুফর, আর এই দুই ধরনের নিবাস ছাড়া আর কোন শ্রেণীবিভাগের উল্লেখ নেই।“ [আল আদাব উশ-শারীয়াহ ওয়াল মিনাহ লিল-মার’ইয়াহ]
যে মহান প্রতিপালক ঘুম থেকে ওঠার পর পুনরায় ঘুমাবার আগ পর্যন্ত ব্যক্তির প্রতিটি জাগ্রত মুহূর্তের ব্যাপারে, তাঁর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের ﷺ সুন্নাহর মাধ্যমে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সুবহানু ওতা'আলা বিচার ফায়সালা, অপরাধ ও অপরাধীর শাস্তি, অর্থনৈতিক লেনদেনের নিয়ম, রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার নিয়ম, মুসলিমদের সাথে অন্যান্য জাতি ও সম্প্রদায়সমূহের সম্পর্ক কি রকম হবে – এ সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারে আমাদের কোন নির্দেশনা দিবেন না; এমনটা হতে পারেনা। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মের সাথে ইসলামের মৌলিক পার্থক্য তো এটাই যে, তাদের ধর্মে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় বিধান, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, বিচার ব্যবস্থা শুন্য, আর ইসলাম এসব বিধান নিয়েই পরিপূর্ণ।
আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের ﷺ সুন্নাহ থেকে এ সত্য সুস্পষ্ট যে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় – জীবনের সকল ক্ষেত্রেই আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট নিয়ম ঠিক করে দিয়েছেন। এ সব কিছু নিয়েই দ্বীন ইসলাম। সম্পূর্ণ ও সর্বোত্তম জীবনবিধান। যাতে অবকাশ নেই কোন রকম সংযোজন ও বিয়োজনের। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাঁর কিতাবে বলেছেন –
“আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। [ সূরা আল-মায়েদাঃ ৩]
সুতরাং কারো আল্লাহকে ইবাদাতের একমাত্র যোগ্য সত্ত্বা স্বীকার করার পাশাপাশি কবর পূজা, মাজার পূজা যেভাবে তাওহীফ পরিপন্থী, তেমনি আল্লাহর আইনের পরিবর্তের মানব রচিত আইন দ্বারা শাসন করা, কিংবা শাসনকে হারাম মনে না করা তাওহীদ পরিপন্থী বিশ্বাস ও কাজ। এই কিতাবে যেভাবে সালাত, সাওম, হজ্জের বিধানের বর্ণনা দেয়া আছে, তেমনি মিরাস, ব্যবসার চুক্তি, চোরের হাত কাটা, জেনাকারীর বেত্রাঘাত প্রয়োগের হুকুমও আছে। নিশ্চয় এসব অস্বীকারের দ্বারা শিরক হবে, আর তা হবে শিরকের মাঝে সবচেয়ে বড় শিরক এবং এর থেকে তাওবা না করলে বান্দার চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়া আল্লাহর ওয়াদাকে বাস্তবায়ন করাবে।
কেননা, আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন-
“... যদি তোমরা তাদের আনুগত্য কর , তোমরাও মুশরিক হয়ে যাবে।” [সূরা আল আন’আমঃ ১২১]
সুতরাং তাওহীদুল হাকিমিয়্যাহর মূল শিক্ষা তথা বিচারের এবং হুকুমের একচ্ছত্র অধিকার হলো মহান আল্লাহ তা'আলার। এক্ষেত্রে গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম, সেক্যুলারিজম সহ সকল মানব মতবাদ তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিকভাবে ভাবে হারাম এবং এর সহযোগীতা করা এবং হারাম জেনেও এসব মতবাদের সাথে সম্পৃক্ততা থাকা হলো বড় শিরক।