27/08/2023
“আম্মা, আব্বারে বইলো, আইজ একটু মাংস আনতে। ম্যালা দিন হইলো মাংস খাই না। আনতে বলবা তো, আম্মা?”
রুগ্ন মেয়ের ভাঙা কণ্ঠের আবদারে মরিয়ম বিবির ব্যস্ত কর্মরত হাতটা থেমে গেল। চোখ ঝাপসা হলো নোনা জলে। রঙচটা খয়েরী রঙের নরম শাড়ির আঁচল খানা দিয়ে সে চোখ মুছলো আলগোছে। হাত থেকে পড়ে যাওয়া ঝাড়ুটা তুলে নিলেন আবার নতুন উদ্যমে। ঘর ঝাঁট দিতে দিতে কৃত্রিম ব্যস্ততা দেখিয়ে বললেন,
“তোর আব্বা আসতে আসতে রাইত হয়, ময়না। তহন তো বাজার খোলা পায় না। নাহয় কবেই আনতো।”
“রাসেলের আব্বাও তো রাইতে আহে, আম্মা। অর আব্বা তো মাংস পায়, তাইলে আমাগো আব্বা পায় না ক্যান?”
মেয়ের প্রশ্নে নির্বাক থাকে মা। এবার আর সাজাতে পারে না মনগড়া উত্তর। কেবল বুক চিরে হাহাকার করে উঠে দারিদ্রতা। দ্রব্য মূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির বাজারে ময়নার মাংস খাওয়ার শখ যে পূর্ণতা পাবে না, সে কথা অসহায় মা গোপনে রাখে। অসুস্থ সন্তানের আবদার পূরণ করতে না পেরে হাউমাউ করে কাঁদে মায়ের অন্তর। ব্যাথা দমিয়ে রাখতে না পেরে কৃত্রিম ক্রোধ দেখায় মা। শুয়ে থাকা অসুস্থ মেয়েটার গালে লাগিয়ে দেয় দু-চারটে চড়। মুখ ঝামটি মেরে বলে,
“এত খাম খাম কেন থাকব তোর? খালি এডা খাবি, ওডা খাবি। সংসারের অবস্থা দেহছ না? ভাতই পাই না খাইতে তোর মাংস লাগবো। তোর বাপ সারাডা দিন রিকশা নিয়া গাধার মতো খাঁটে। তাও তোগো খিদা মিটে না রে মুখ পুরী? এত ক্ষুধা তোর?”
সাত বছরের ময়না ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ডাগর ডাগর আঁখি যুগল যেন ধারণ করে বর্ষার থৈথৈ করা নদীতে। কী যেন হয় মেয়েটার! কাঁদে না সে। কেবল নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলে,
“রাগ কইরো না, আম্মা। আর কমু না। ডাক্তার তো কইছে আমি আর বেশিদিন বাঁচুম না, তাই একটু ভালা-মন্দ খাইতে চাই। এত স্বাধের জনম আম্মা, ভালা খানা না খাইয়া মইরা যাইতে মন চায় না। কিন্তু আইজ কসম কাটলাম, আর কোনোদিনও মাংসের কথা কমু না। কেবল আল্লাহর কাছে একটা দোয়া রাইখো আম্মা— আমি আবার যদি জন্ম নিই, তাইলে যেন অনেক বড়োলোকের ঘরে জন্ম নিই। যারা খাইতে চাইলে আমারে মারব না।”
ময়নার কথা থামতেই মায়ের বুক নিরবে নিভৃতে কে যেন ছুরি দিয়ে ক্ষত করে দিয়ে যায়! মরিয়ম বিবি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে তার অবুঝ ময়নার পানে। যে ময়নার চোখে প্রগাঢ় অভিমান। বাবা-মা কেন গরীব, সেই অভিযোগ যেন ময়নার কণ্ঠে। খাটের ওপর থেকে কেঁদে উঠে মরিয়মের ছ'মাসের নবজাতক মেয়ে আশা। হয়তো মা-বাবার দারিদ্রতা নিয়ে তারও অভিযোগ! হয়তো সেও এই ঘরে এসেছে বলে হা-হুতাশ করছে এভাবে! কথা বলতে পারলে হয়তো ময়নার মতন সে-ও বলত 'এ মায়ের গর্ভে যেন পরেরজন্মে তার আর জন্ম না হয়।' তাচ্ছিল্যের হাসি মরিয়ম বিবির বুক চিরে বেরিয়ে এলো। গরীব বলে তার মা শব্দটার ভার এত অবহেলায় ভাসছে! হাহ্!
_
আজ ময়নাদের ঘরে মাংস রান্না হয়েছে। চারদিকে ম-ম করছে সেই ঘ্রাণ। ময়নার গায়ে আজ চকচকে নতুন জামা। ঠোঁটে লেপটে আছে বহু কাঙ্খিত প্রাপ্তির হাসি। অসুস্থ ময়নার এই অগাধ আনন্দ দেখে মরিয়ম বিবিরও ঠোঁটে হাসি তবে বুকের অন্তরালে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের স্রোত। হাসান আলীও প্রাত্যহিক দিনের তুলনায় আজ দ্রুত ফিরেছেন বাড়ি। বলা যায় মরিয়ম বিবির তাড়নায়ই দ্রুত বাড়ি ফেরা।
স্বামীকে ফিরতে দেখেই তাড়া দিল মরিয়ম বিবি। হাত-মুখ ধোয়ার পানি এগিয়ে দিলো। দ্রুতই পরিস্কার হতে সাহায্য করল। তারপর মেয়ে ময়না ও স্বামীকে খেতে বসালেন। বহু দিনের স্বাধ মিটিয়ে মেয়ে আর স্বামীর পাতে বড়ো মাছের টুকরো দিলেন, মাংস দিলেন বাটি ভোরে। হাসান আলী তাজ্জব এই খাবার দেখে। অস্ফুটস্বরে শুধালেন,
“বিবি, ঘরে রেশন আনার টেকাই আমার কাছে নাই, তুই এত কিছু আনলি কেমনে?”
“চুপ কইরা কয়ডা ভালা-মন্দ খান দেহি। এত বুঝতে হইবো না আপনার। খান।”
হাসান আলী আর কথা বাড়ালেন না। বাড়াতে চাইলেনও না বোধকরি। বহুদিন যাবত ভালো খাবার যে তারও পেটে পড়েনি। মনটা কেবল তীর্থের কাকের মতন ভেতর ভেতর হা-হুতাশ করতো দু-মুঠো ভালো খাবারের জন্য। ময়নাও আনন্দে খেতে খেতে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল। মাথা নেড়ে নেড়ে বলল,
“আম্মা, পরেরজন্মেও আমি তোমার ঘরে আইতে চাই। তোমার মতন কেউ হয় না, আম্মা। কেউ না।”
মরিয়ম বিবির দু’চোখ ভোরে বেরিয়ে আসে অশ্রুর স্রোত। কিন্তু সে গিলে নেয় সেই কান্না। মায়ের মন প্রার্থনা করে বলে— “আল্লাহ্, এরপর কাকের জন্ম দিও তবুও গরীব মানুষ কইরা পাঠাইও না। গরীব হইলে যে তোমার এই দুনিয়ায় দাম নাই, আল্লাহ্। দাম নাই। আমার সন্তানগোরে তুমি ভালা রাইখ। আর কেউ না জানুক, তুমি তো জানো, আমার যে ভেতরডা শেষ।”
মায়ের প্রার্থনা কেউ শুনে না কেবল অন্তর্যামী ছাড়া। গলির মোড়ের নিঃসন্তান কুকুরটা আর্তনাদ করে উঠে। সাথে সাথে থেমে যায় ময়নার হাসি। লুটিয়ে পড়ে খাবার পাতেই। শ্বাস নেয় না আর সে! তার বহু কাঙ্খিত ইচ্ছে পূরণ হতেই মা-বাবাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায় দূরে, বহুদূরে।
সেদিনই দেশীয় সংবাদপত্রে ছাপে একটি অত্যাশ্চর্যিত ছবি। পথের ধারে পোস্টার টাঙিয়ে ছয়মাসের বাচ্চাকে বিক্রি করছেন মা। বাচ্চার মূল্য খুবই সামান্য। একটু মাছ-মাংসের বদলেই বিক্রি করেছে বাচ্চা।
উচ্চমানের মানুষেরা সে খবর দেখে বহু প্রলাপ বিলাপ করল। কেউ বলল 'কী শখ!' কেউবা বলল 'কী ক্ষুধা!' কেউবা বলল ‘মায়ের লোভ’। অথচ কেউ মায়ের ভালোবাসা আর বিসর্জনের গল্প জানল না।
[সমাপ্ত]
গল্প: #বিসর্জিত_ভালোবাসা
©মম সাহা