12/06/2025
জামালপুর সদরের লক্ষ্মীরচর: ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন?
ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর জেলার সদর উপজেলাধীন একটি ঐতিহাসিক ও সমৃদ্ধ জনপদ লক্ষ্মীরচর গ্রাম। এটি শুধু একটি গ্রামই নয়, এটি ৩নং লক্ষ্মীরচর ইউনিয়নের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্রও বটে। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত এই গ্রামটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, উর্বর কৃষিভূমি এবং শিক্ষাদীক্ষার প্রসারে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিচিতি
জামালপুর সদর উপজেলা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে লক্ষ্মীরচর ইউনিয়নের প্রাণকেন্দ্রে এই গ্রামটির অবস্থান। লক্ষ্মীরচর ইউনিয়নটি ২৩টি গ্রাম নিয়ে গঠিত, যার মোট আয়তন ১০.৪৩ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ২৮,৬৮৬ জন। এর পশ্চিমে জামালপুর পৌরসভা ও শরিফপুর ইউনিয়ন, উত্তরে শেরপুর সদরের ঘুঘুরাকান্দি ইউনিয়ন, পূর্বে তুলশীরচর ইউনিয়ন এবং দক্ষিণে রানাগাছা ইউনিয়ন অবস্থিত। লক্ষ্মীরচর গ্রামটি ইউনিয়নের ২ ও ৩ নং ওয়ার্ডের একটি বড় অংশ জুড়ে বিস্তৃত।
শিক্ষাব্যবস্থা: জ্ঞানের আলোয় আলোকিত জনপদ
লক্ষ্মীরচর গ্রাম এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
বিদ্যালয়:
এই ইউনিয়নে মোট ৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৪টি কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। লক্ষ্মীরচর গ্রামের মধ্যেই লক্ষ্মীরচর উত্তর পাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবস্থিত, যা ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গ্রামের শিশুদের শিক্ষাদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য ইউনিয়নে মোট ৩টি উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পার্শ্ববর্তী বারুয়ামারী গ্রামে অবস্থিত বারুয়ামারী জহুরা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয় এবং ছোলেমা আহমদ বালিকা বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়গুলো লক্ষ্মীরচরসহ পুরো ইউনিয়নের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক শিক্ষার চাহিদা পূরণ করে আসছে।
মাদ্রাসা:
ইসলামিক শিক্ষার প্রসারেও লক্ষ্মীরচর পিছিয়ে নেই। পুরো ইউনিয়নে মোট ৩টি মাদ্রাসা রয়েছে, যেখানে গ্রামের শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়।
ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান
লক্ষ্মীরচর গ্রামে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সামাজিক বন্ধন অত্যন্ত সুদৃঢ়। এই ইউনিয়নে মোট ৫৮টি মসজিদ, ৯টি ঈদগাহ মাঠ এবং ১টি মন্দির রয়েছে। গ্রামের বিভিন্ন পাড়ায়, যেমন— লক্ষ্মীরচর উত্তর পাড়া, পাগল পাড়া, মাতাল বাড়ি, ডাঙ্গা তলা এবং ফকির বাড়িতে একাধিক জামে মসজিদ রয়েছে, যা গ্রামবাসীদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু।
এছাড়াও, ইউনিয়নে ৫টি হাট-বাজার, ২টি ডাকঘর, ১টি ব্যাংক এবং ৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে, যা গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা ও স্বাস্থ্যসেবা পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
অর্থনীতি ও যোগাযোগ
লক্ষ্মীরচর গ্রামের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক। ব্রহ্মপুত্র নদের উর্বর পলিমাটির কারণে এখানে ধান, পাট, এবং বিভিন্ন ধরনের সবজি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। গ্রামের প্রধান যানবাহন হিসেবে রিকশা, ভ্যান এবং ইঞ্জিনচালিত স্থানীয় যানবাহন (বড়বটি) ব্যবহৃত হয়।
কৃতি ব্যক্তিত্ব ও ঐতিহ্য
লক্ষ্মীরচর ইউনিয়ন কৃতি সন্তানের জন্ম দিয়েছে। এই ইউনিয়নের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হলেন বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী আলহাজ্ব রেজাউল করিম হীরা এবং বিশিষ্ট শিল্পপতি শেখ মো: আনোয়ার হোসাইন। এছাড়াও, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ শাহ্জাহান আলী-র নাম সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করা হয়।
গ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান হলো চরপাড়া কারবালা মেলার মাঠ, যা এই অঞ্চলের মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মিলনক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত।
এক কথায়, জামালপুর সদরের লক্ষ্মীরচর গ্রামটি শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষি ও সামাজিক অবকাঠামোতে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং আদর্শ গ্রাম হিসেবে নিজ মহিমায় উজ্জ্বল। MD Ashik ©ছবি