16/09/2025
আমার চেয়ে ষোল বছরের ছোট একটা মেয়েকে, বিয়ে করে নিয়ে এলাম। উপায় ছিলো না, আম্মার এই মেয়েকেই পছন্দ।
মেয়েটি সবে ক্লাস নাইনে উঠেছে। তাকে পছন্দ করার প্রথম কারণ, সে মারাত্মক সুন্দরী দ্বিতীয় কারণ মেয়েটির বাবা মা বেঁচে নেই। ওর প্রতি নাকি আম্মার মায়া জন্মে গেছে। একবার দেখেই এই মায়া কেমন করে জন্মালো, সেটাই এক বিস্ময়।
একটা সুন্দরী মেয়ে খুঁজতে খুঁজতে আমার বয়স তিরিশ হলো। অবশেষে পছন্দসই মেয়ে পাওয়া গেলো, তবে বয়সের বিস্তর ফারাক।
আমার আম্মার গায়ের রং কালো। আমিও মায়ের কাছ থেকে পাওয়া কালো রং নিয়েই জন্মেছি।এই রংয়ের জন্য, আম্মা একসময় নানাভাবে হেনস্থা হয়েছেন। অনেক পাত্র আম্মাকে দেখে দেখে, বাতিল করে দিয়েছে। বিয়ের পরেও আম্মাকে অনেক ধৈর্য্য পরীক্ষা দিতে হয়েছে।যে কোনো শাড়ি, জামাকাপড় বা সাজ পোশাক শখ করে করতে গেলেই, শ্বশুরবাড়ি থেকে শুনতে হয়েছে,
__ এইটা তোমারে মানাইবো না বৌমা।অন্য কিছু পরো।
আমি ছেলে হয়েও বেশ কয়েকবার পাত্রীপক্ষের কাছে রিজেক্টেড হয়েছি, কালো রংয়ের জন্য।
আম্মার তাই একটাই চাওয়া, ছেলের বউ হবে ধবধবে ফর্সা।যেন, আমার ছেলেমেয়ে ফর্সা হয়ে জন্ম নেয়।
আম্মা বলেন,
__শোনো বাবা সেলিম, যারা বলে কালোই জগতের আলো...তারা আসলে কালো মানুষগুলারে দয়ার চোখে দেখে।তারা নিজেরাও এই কথা বিশ্বাস করে না।বিয়া করতে গেলে, তারাও সাদা চামড়া খোঁজে। কালো হওয়ার বহুৎ যন্ত্রণা। আমি চাইনা, তোমার পোলা মাইয়া সেই যন্ত্রণা ভোগ করুক।
__কিন্তু আম্মা, ছেলেমেয়ে যদি আমার গায়ের রং পায়, তখন কি করবেন?
আম্মা মুখ গম্ভীর করে বলেন,
__আমি চেষ্টা করছি,সেই সান্ত্বনা তো থাকবো।
ক্লাস নাইনে পড়ুয়া আমার বউটি গতকাল আমাদের বাড়িতে এসেছে। এখানে আসার পর থেকে, বিছানার এক কোনায় বসে নাকি সুরে কেঁদে যাচ্ছে। একেবারের জন্য উঠে বাথরুমেও যায় নি।এই বাচ্চা মেয়ের সাথে কি সংসার করবো বুঝতে পারছি না।আগে তো একে পেলে পুষে বড় করতে হবে।
অফিস থেকে একসপ্তাহ ছুটি নিয়েছিলাম। শুক্র শনি মিলিয়ে নয়দিন। তিনদিন পরেই অফিস শুরু করলাম। অফিসের সবাই আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করছে। অনেকরকম গল্প বানিয়ে কোনোমতে সামাল দিয়েছি।
সপ্তাহ খানেক লাগলো নূরির স্বাভাবিক হতে। আমার স্ত্রীর নাম নূরি। রাতে সে আম্মার সাথে ঘুমানো শুরু করেছে।আমিই পাঠিয়েছি অবশ্য।
আম্মা ওকে শাড়ির বদলে সালোয়ার কামিজ পরতে বলেছে।এতেই নূরি খুব খুশি। বাচ্চা মেয়ে একটা, নিজেকেই সামলাতে পারে না,শাড়ি কোথা থেকে সামাল দিবে।
সেদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে দেখি, আম্মা নূরির চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দুটা বেনি দুলিয়ে নূরি আমার জন্য চা নিয়ে এলো। ওকে দেখে মনে হচ্ছে, এক্ষুনি স্কুলে যাবে।
আম্মাকে বললাম,
__নূরিকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেই? বাসার এতো কাছে স্কুল।
পরদিনই আম্মা নিজে গিয়ে নূরিকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন ।আব্বা মারা যাবার পর, আম্মা মানসিকভাবে ভীষণ দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন।একা একা হাঁটাচলা, ঘরের কাজ করার মতো মনের জোর পেতেন না। বয়সের আগেই হঠাৎ করে বুড়িয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু কি এক মন্ত্রবলে, আম্মা যেন নতুন একটা জীবন ফিরে পেলেন।নূরির জন্য স্কুলের জামাকাপড় কেনা, তার পড়ার টেবিল সেট করা, সময়মতো পড়তে বসানো, নূরির খাওয়া দাওয়া, স্কুলের টিফিন... কোনো কিছুতেই আম্মার ক্লান্তি নেই। সকাল সন্ধ্যা দুইবেলা নূরির চুল আঁচড়ে, সুন্দর করে বেঁধে দেন আম্মা।
শুধু তাই নয়, একেক দিন দেখি নূরিকে আম্মা মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন।
নূরিও কম যায় না। সারাদিন আম্মার সাথে লেপ্টে থাকে। আম্মা রাঁধলে, সে কেটেকুটে দেয়। দুজন একসাথে চা খায়, একসাথে বাজারে যায়। আম্মার হাত পা মালিশ করে দেয়।নখ কেটে দেয়।
আত্মীয় স্বজন সবাই হা হয়ে গেছে। শাশুড়ি বৌমার এমন সম্পর্ক, ওরা জন্মে দেখেনি।
আমার দুইবোন একেকবার বেড়াতে এসে, আম্মার উপর অভিমান করে করে চলে যায় । তাদের মা তাদের চেয়ে বেশি ভাইয়ের বউকে ভালোবাসে...সরাসরি অভিযোগ না করলেও, কেন যেন ঠিক মেনে নিতে পারে না।
দেখতে দেখতে নূরি বড় হয়েছে। ভালো ফলাফল করে এস এস সি পাশ করেছে। আম্মা শহরে এবং গ্রামের বাড়িতে দুই জায়গায় ঘটা করে ,বৌমার পাশের নিমন্ত্রণ খাইয়েছে।
কলেজে ভর্তি হবার কিছুদিনের মধ্যেই ,নূরির শরীরে আরেকটা প্রানের জন্ম হয়। আম্মা আনন্দে দিশাহারা হয়ে উঠেন।
আম্মার পরম যত্নে দশমাস পার করে, ফুটফুটে এক ছেলের জন্ম হয় আমাদের।
আম্মার ব্যস্ততা আরো বেড়ে যায়। একদিকে নূরি আরেকদিকে তার ছেলে। কাকে রেখে কাকে দেখবেন।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়,নূরি আমাদের পরিবারের জন্য একরাশ সুখ আর আনন্দ নিয়ে এসেছে। ছোট্ট এই মেয়েটির হাত ধরে, আম্মা নতুন করে বেঁচে উঠেছেন।
আমি মুগ্ধ হয়ে, আম্মা আর নূরির মধ্যেকার শক্ত বাঁধন দেখি।
আম্মার আগ্রহে নূরির এইচএসসিও শেষ হয়।
এইচএসসির রেজাল্ট নিতে গিয়ে নূরি অ'জ্ঞান হয়ে যায়।ওর এতো ভালো রেজাল্টের খবর কাউকে জানানোর আগে, আম্মা ছুটলেন হাসপাতালে।
না ,ভয় পাওয়ার মতো কিছু হয়নি।নূরি আবারো মা হবে। একদিকে ভালো রেজাল্ট, আরেকদিকে নতুন মেহমান আসার সুখবর... আমাদের পরিবারে সুখের বন্যা নেমে এলো।
আম্মা দিনরাত দোয়া করতে লাগলেন, একটা ফুটফুটে নাতনির জন্য।যে হবে ঠিক নূরির মতো দেখতে।
জীবনে অনেক অপূর্ণতা ছিল আম্মার, আল্লাহ নতুন করে আর কোনো আশা অপূর্ণ রাখলেন না।
ঠিক সময়ে আম্মার নাতনির জন্ম হলো।
নূরির লেখাপড়া সে বছর বন্ধ ছিল। আম্মা বললেন, এতো ভালো রেজাল্ট করেছে যখন, তখন লেখা পড়াটা আর কিছুদিন চলুক।
তবে, সুখের বা দুঃখের দিন...কোনটাই চিরস্থায়ী নয়।আমাদের সুখের দিন শেষ হয়ে এসেছিল।
আম্মার শরীরে বাসা বাঁধলো মরনব্যাধী ক্যান্সার।নূরিকে কিছুতেই অনার্সে ভর্তি করানো গেলো না। আম্মাকে এক মূহুর্তের জন্য চোখের আড়াল করতে রাজি না সে।
আম্মাকে যখন হাসপাতালে থাকতে হতো, ওখানে সবাই ভাবতো নূরি আম্মার মেয়ে ।ছেলের বউ শুনলেই সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতো।আর আম্মা তাঁর দূর্বল হাতে নূরির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো।
নূরির একনিষ্ঠ সেবায়, ক্যান্সারের সাথে কঠিন লড়াই করেও আরো একযুগ বেঁচে ছিলেন আম্মা।
মাঝে মাঝে মনে হতো, যমদূতের সাথে লড়াই করে করে ,আম্মার প্রানটা ছিনিয়ে নিয়ে আসছে নূরি।এই লড়াই যারা দেখেছে ,তারাই কেবল বুঝতে পারবে।
তবে,মৃত্যু তো আমাদের জীবনে অনিবার্য। কতদিন আর তাকে আটকে রাখা যায়!
আম্মা আমাদের ছেড়ে,নূরিকে ছেড়ে অনন্ত জীবনের পথে যাত্রা করলেন।
সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার।
নূরি রোজা রেখেছিল। ইফতারের আগে, আম্মার মাথার কাছে বসে দোয়া পড়ছিল। আম্মার হাতটা আমি ধরে রেখেছিলাম। ঠিক তখনই নিঃশব্দে...পরম শান্তিতে, আম্মা বিদায় নিলেন। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ,ঘটনাটা ঘটে গেলো।
আম্মার দা*ফনে একদিন দেরি হবে। ছোটবোনটা পরিবার নিয়ে লন্ডনে আছে, ওর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। রাতে আম্মার প্রাণ*হীন শরীরটা, হাসপাতালের হিমঘরের বাক্সে রাখা হলো।
নূরিকে ঘরে আটকে রাখতে পারলাম না...নিয়ে এলাম, আম্মাকে কোথায় রাখা হয়েছে, দেখানোর জন্য।
হিমঘরে মর*দেহ রাখার জন্য অনেকগূলো শীতল ড্রয়ারের মতো বাক্স,পাশাপাশি রাখা।যে বাক্সগুলোতে কাউকে রাখা হয়েছে, সেগুলোর উপরে লাল বাতি জ্বলছে আর যেগুলো খালি সেগুলোর উপর সবুজ বাতি।
আম্মাকে যেখানে রাখা, ঠিক তার পাশের বাক্সটির উপর সবুজ বাতি জ্বলছে।
নূরি বললো,
__দেখো, আম্মার পাশের বক্সটা খালি।
মুখে যদিও আর কিছু বলেনি, তবে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম...ও বলছে,
"পাশের বাক্সটাতে যদি আমি থাকতাম, আম্মার কষ্ট কম হতো।"
আমার বুকটা কেঁপে উঠলো।
নূরিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলাম।
আমি তখনো ভাবতে পারি নি, নূরি আর আম্মার বন্ধন এতোটাই মজবুত... আমার পক্ষে নূরিকে আটকে রাখা সম্ভব হবে না।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পথে, আমাদের গাড়িকে ধা*ক্কা দিলো আরেকটা গাড়ি । গাড়ির কিছু হলো না, অন্য কারো কিছু হলো না, শুধু নূরির মাথায় প্রচন্ড আ*ঘা%ত পেলো।
আম্মাকে নিয়ে ছুটোছুটি করে ও ভীষণ ক্লান্ত ছিল। গাড়ির পিছনের সিটের জানালায় কাচে মাথাটা এলিয়ে দিয়েছিলো ।আর ঠিক সেখানেই আঘাতটা লেগেছে ।হাসপাতালে নেয়ার আগেই নূরি চলে গেলো।
নিজের দুই সন্তান, স্বামী, সংসার কোনোকিছুর মায়া নূরিকে আটকে রাখতে পারলো না।
এই পৃথিবীতে কতো যে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে!
আম্মার পাশের সেই খালি হিমায়িত বক্সে, নূরির জায়গা হলো।
বোনটা আসার পর, দুজনের দাফন হলো। আম্মা আর নূরিকে পাশাপাশি শোয়ানো হলো।
দুই সন্তানের দায়িত্ব আমার কাঁধে দিয়ে, স্বার্থপরের মতো আম্মা আর নূরি একসাথে বিদায় নিলো।
নূরিকে প্রথম দেখেই, কেন আম্মার মায়া পড়ে গিয়েছিল এতো... সেটা এতো বছর পরে পরিস্কার হলো আমার কাছে।
কল্পনার চোখে আমি এখনো পরিস্কার দেখতে পাই... আম্মা নূরির চুলে তেল দিয়ে, পরিপাটি বেনী করে দিয়েছে।বেনী দুলিয়ে দুলিয়ে আম্মার পায়ের কাছে বসে, পরম যত্নে নখ কেটে দিচ্ছে নূরি। গল্প করতে করতে হেসে গড়িয়ে পড়ছে দুজন।
হয়তো এখানে নয়, দূরের কোনো পৃথিবীতে।