01/06/2025
চাঁদরাতের আড়ালে
(হারিয়ে যাওয়া শৈশব, খুঁজে ফেরা ঈদের সকাল)
"ঈদের এখনো দশ দিন বাকি, যা চুপচাপ পড়তে বস!"
মায়ের এই কথাটাই ছিল আমাদের ঈদের দিন গোনার শুরু।
বাইরে তখন রোদের ঝিলিক, পাড়ার মেয়েরা দল বেঁধে মার্কেটে ছুটছে—
কারও হাতে লাল রঙের ওড়না, কেউ আবার চুড়ির দোকানে রঙ বাছছে।
আর আমি?
আমি জানালার পাশে বসে গুনছিলাম—আর কতদিন বাকি ঈদের?
অভিমান হতো খুব।
মন বলত, “মা কেন বোঝে না? আমি ঈদের জন্য অপেক্ষা করছি, পড়ার জন্য না!”
নতুন জামা কখন কিনবো? মেহেদি কবে লাগাবো?
চুড়ির সাথে কোন ক্লিপটা সবচেয়ে বেশি মিলবে?
তবুও দিন কেটে যেত গুনতে গুনতে।
একদিন বিকেলে হঠাৎ ছাদ থেকে কারো চিৎকার—
“চাঁদ উঠেছে! চাঁদ উঠেছে!” 🌙✨
এই একটি বাক্যে যেন পুরো পাড়ায় আনন্দের ঢেউ উঠে যেত।
বাড়ির বাতিগুলো হঠাৎ করেই উজ্জ্বল হয়ে উঠত,
মা ছুটে যেতেন সেমাই ভিজাতে,
আর আমি ছুটে যেতাম ছাদে—রুপালি চাঁদটাকে একবার দেখে নিতে,
যে চাঁদটাকে নিয়ে এতদিন ধরে আমি স্বপ্ন বুনেছি।
রান্নাঘর থেকে ভেসে আসত পোলাওয়ের চাল ধোয়ার শব্দ,
মশলার ঘ্রাণ, আর মায়ের চুলে লেগে থাকা সেমাইয়ের দুধের গন্ধ। 🍚
আমার ছোট্ট দায়িত্ব ছিল—
নতুন জামাটা আলমারির ওপরের তাকে লুকিয়ে রাখা,
রাতের বেলা সেটাকে বিছানার পাশে রেখে চুপচাপ তাকিয়ে থাকা,
আর মনে মনে বলা—
“কাল আমি সবথেকে সুন্দর দেখাবো!” 👗
চাঁদরাত মানেই ছিল—
চুড়ির ঝনঝন, হাতে মেহেদির লাল রঙ,
চাচিদের ঘরে গিয়ে ডিজাইন বেছে বেছে মেহেদি লাগানো,
আর জানালা পেরিয়ে বান্ধবীদের বলা—
"তোরটা কী রঙের? আমারটা সিলভার জড়ির!" 💅
ছোট ভাইবোনেরা কেউ পেটি বাজি ফাটাত,
কেউ আবার আঙুলে মোমবাতি নিয়ে বারান্দা জুড়ে ছোটাছুটি করত।
চুপি চুপি পকেটে ‘চকলেট বোম’ ভরে রাখার মধ্যেও ছিল আলাদা এক থ্রিল! 🧨
ঈদের সকাল যেন এক জাদুর মতো আসত।
মা ফজরের আজানের আগেই টেনে তুলতেন—
"তাড়াতাড়ি ওঠ, ঈদের নামাজের আগে গোসল কর, জামা পর!"
আমি অর্ধেক ঘুমে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে চুল শুকাতাম।
নতুন জামা পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতাম—
“এই আমি না, এ তো ঈদের রাণী!” 👑
নামাজ শেষে বাবা, চাচা, মামারা বলতেন,
"ঈদ মোবারক!"
আর আমরা বলতাম, “সালামি কই?” 💸
ছোট্ট একটা টাকা পেয়ে ছুটে যেতাম ঘরে লুকাতে—
যেন কেউ কাড়তে না পারে।
বিকেলে বান্ধবীদের সাথে দল বেঁধে বের হতাম—
রিকশা সাজানো, হাতে চুড়ির রং, ঠোঁটে মায়ের দেওয়া লিপস্টিক।
ঐ দিনটা ছিল আমাদের রাজত্বের দিন। 💃
আর কেনাকাটা?
ঈদের জামা কিনতে গেলে মা বলতেন—
"এইটা পরলেই তুই দারুণ লাগবি!"
জামার রঙের সাথে মিলিয়ে চুড়ি, ক্লিপ, ফিতা—সব মা-ই ঠিক করে দিতেন।
মার চোখের ভাষা বুঝেই বুঝে যেতাম, কোনটা কিনলে ওনার চোখে আনন্দের জ্যোতি জ্বলবে। 🛍️
---
কিন্তু সময় তো আর থেমে থাকে না।
সবাই বড় হয়ে যায়।
আমিও হয়ে গেছি।
এখন মায়ের আঁচলের বদলে হাতে থাকে ব্যাগ আর ব্যালেন্সশিট।
রোজকার ব্যস্ততার ভেতর কোথা থেকে যেন “ঈদ” শব্দটাই ফসকে গেছে।
মা আর বলেন না, “চুপচাপ পড়তে বস।”
আজ বলেন—
"ঈদের তো মাত্র দশ দিন বাকি মা… বাড়ি আসবি কবে?" 📞
চাঁদরাত কেটে যায় এখন শহরের এক নিঃশব্দ ফ্ল্যাটে,
দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারে ঈদের দিনটা মার্ক করা,
কিন্তু তাতে নেই মেহেদির গন্ধ।
নেই চুড়ির ঝনঝনি, নেই রান্নাঘরের কোলাহল।
নতুন জামা এখন নিজেই কিনি—
দামি, কিন্তু নির্জন।
রাতের বেলা জামাটা বিছানায় রাখলেও কেউ আর এসে দেখে না,
কেউ বলে না— “কি রে, বুড়ি হইলি রে?”
হাতে মেহেদি দিই না,
কারণ কেউ আর হাত ধরে বসে থাকেনা ডিজাইন বেছে দেওয়ার জন্য।
ঈদের সকালে ঘড়ির অ্যালার্মেই ঘুম ভাঙে,
মায়ের কোলের উষ্ণতা আজ নেই।
আয়নার সামনে দাঁড়ালেও মন বলে না— “রাণী দেখাচ্ছিস!”
সালামির বদলে আসে ব্যাংক থেকে OTP মেসেজ।
ঈদের শুভেচ্ছার বদলে ইনবক্সে থাকে কিছু ফরমাল উইশ। 📲
তবে ঠিক তখনই, হোয়াটসঅ্যাপে মায়ের ছোট্ট একটা বার্তা আসে—
"তোর জন্য শাহী টুকরা করেছি মা… খাসলি কিছু?"
চোখ ভিজে যায় নিঃশব্দে।
হাতে মেহেদি নেই,
তবুও মনে হয়—
সেই ছোট্ট মেয়েটা আজও কোথাও বসে আছে,
চাঁদের দিকে তাকিয়ে,
মায়ের কোলে ফেরার অপেক্ষায়। 🌙
---
ঈদের চাঁদ এখন আর কেবল আকাশে ওঠে না…
ওটা লুকিয়ে থাকে—
মায়ের কণ্ঠে,
চাচির পুরনো চুড়ির বাক্সে,
সেই প্রথম মেহেদি রাঙা হাতে,
আর এক বুক না বলা ভালোবাসায়…
যা কেবল বাড়ির উঠোন পেরোলেই বোঝা যায়। 🏡
---
ঈদ এখন আর শুধুই উৎসব নয়,
ঈদ এখন— একটা ঘরে ফেরার নাম,
একটা মায়ের কোলে মুখ লুকোনোর আর্তি।
যেখানে কেউ জিজ্ঞেস করে—
"তুই খেয়েছিস তো মা?"
আর সব অভিমান গলে জল হয়ে পড়ে… ❤️
---
শেষে শুধু একটাই প্রার্থনা—
যেন জীবনের প্রতিটি চাঁদরাতেই একবার করে মনে পড়ে—
শৈশবের সেই ছোট্ট আমি,
যে আজও জানালার পাশে বসে থাকে,
ঈদের জন্য,
আর একটিবার…
মায়ের কোলে ফিরতে চায়।
---
#চাঁদরাতের_আড়ালে #ঈদেরগল্প #মায়ের_কোল #শৈশবের_ঈদ #ঈদনস্টালজিয়া #ভালোবেসেইঈদ