20/03/2025
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অজানা কাহিনী
সে অর্থে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সংগীতের ডিগ্রি অর্জন করেননি কোনো কালে। মিত্র ইনস্টিটিউশনের বন্ধু শ্যামসুন্দরের বাড়িতে হারমোনিয়াম নিয়ে চেষ্টা করতেন গান গাওয়ার। সুর যেন তাঁর সহজাত কবচকুণ্ডল। রেকর্ডের গান শুনে আর অনুশীলন করে দ্রুত তৈরি হয়ে গেল গলা। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ গান গাওয়ার অনুমতি দিতে নারাজ। ওই স্কুলেরই আরেক সহপাঠী সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উৎসাহে শেষ পর্যন্ত অডিশন দিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে। সে সময়ে যার নাম ছিল ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন। নির্বাচিত হলেন, ‘আমার গানেতে এলে নবরূপে চিরন্তনী’—গানটি লিখে দিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। পরিবারের তরফে আপত্তি ছিল, অন্যান্য বাধাবিপত্তিও কম ছিল না।
দুই বন্ধু ঘুরে বেড়াতে থাকলেন রেকর্ড কোম্পানির দরজায়। কিছুদিন মন দিলেন সাহিত্যচর্চায়। নতুন দলবল নিয়ে ‘কল্যাণ সংঘ’ নামে একটি সাহিত্যের আসরও জমে গেল। ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হল প্রথম গল্প ‘একটি দিন’। ততদিনে ম্যাট্রিক পাশ করেছেন, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢুকেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে এসে একটা সুবিধা হয়েছিল তাঁর, পেয়েছিলেন গান গাওয়ার বিস্তৃত পরিধি। কিন্তু সে পড়াশোনাও চলল না বেশিদিন, কয়েকদিন শিখলেন স্টেনোগ্রাফি। অবশেষে একদিন গেলেন শৈলেশ দত্তগুপ্তের কাছে। তিনি তখন কলম্বিয়া ও এইচ-এম-ভি স্টুডিও-র বিখ্যাত সুরকার। ১৯৩৭-এর ডিসেম্বরে প্রথম প্রকাশিত হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আধুনিক গানের রেকর্ড।
শৈলেশ দত্তগুপ্তের কাছেই প্রকৃত অর্থে গানে হাতেখড়ি হল তাঁর। রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার উৎসাহ পেলেন তাঁর কাছ থেকেই। প্রথমে তিনি থাকতেন ভবানীপুরে, পরে চলে যান বালিগঞ্জে। তখন থেকে হেমন্তেরও অনেকটা দেরি হয়ে যেত ক্লাসে পৌঁছোতে। একদিন খুব বকলেন শৈলেশবাবু। মাথা নিচু করে হেমন্ত শুধু জানালেন যে, এতটা পথ হেঁটে আসতে সময় লেগে যায়। মুখ ফুটে বলতে পারলেন না আর্থিক সমস্যার কথা। কিন্তু সবই বুঝলেন শৈলেশবাবু, তারপর থেকে প্রতিদিন এক আনা করে দিতেন ট্রামভাড়া বাবদ।
তখনও পর্যন্ত নিজের কোনো হারমোনিয়াম ছিল না। এখানে-ওখানে গিয়ে করতে হত অনুশীলন। দ্বিতীয় রেকর্ডটি বেরোনোর পর চল্লিশ টাকা দিয়ে ঘরে নিয়ে এলেন নিজের প্রথম হারমোনিয়াম। কদিন পরে প্রকাশিত হল তৃতীয় রেকর্ড। আর তারপরই মুখোমুখি হতে হল বাবা কালিদাস মুখোপাধ্যায়ের। পড়াশোনা বন্ধ করে গান গেয়ে জীবন চলতে পারে না। কোনো নিশ্চিত ভবিষ্যৎ আছে এই পথের? সংসারে বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে পারবে কি? পড়াশোনা না করতে চাইলে, অফিসে কিছু একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেবেন তিনি। কিন্তু গান বন্ধ! মা কিরণবালার হস্তক্ষেপে সে যাত্রা শান্তিস্থাপন হলেও, টাল খেয়ে যায় দুজনের সম্পর্ক।
কিছুদিন চলল টিউশন করে। অবশেষে মিলল ছবিতে একক প্লে-ব্যাকের সুযোগ। রবীন্দ্রসংগীত নয়, আধুনিক গান নয়, ভক্তিগীতি। ছবির নাম ‘নিমাই সন্ন্যাস’। মূল চরিত্রে ছবি বিশ্বাসের কণ্ঠের গান গাইলেন তিনি। প্রকাশিত হল প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড। এতদিন অনেকেই তাঁকে ‘ছোটো পঙ্কজ’ বলতেন। কিন্তু এখন তিনি আবিষ্কার করেছেন নিজস্ব গায়কিয়ানা। বাংলা সংগীতজগতে ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাম। এরপরই আসে আইপিটিএ পর্ব। সলিল চৌধুরীর সঙ্গে জুটিতে তৈরি হতে থাকল ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূ’, ‘অবাক পৃথিবী’, রানার’, ‘পাল্কীর গান’-এর মতো কালজয়ী সব সৃষ্টি। আর তাকাতে হয়নি পিছন ফিরে। বাংলা সিনেমা তো বটেই, কয়েক বছরের মধ্যে ডাক এল হিন্দি সিনেমা থেকেও। সুরের অনবদ্য সৃষ্টি আর কণ্ঠের জাদুতে সিনেমার গানের জগতে একচ্ছত্র স্থান অধিকার করে নেন তিনি। বাংলা সিনেমার রাজধীরাজ উত্তম কুমারের চলতে থাকলো একেরপর এক সুপারহিট গান...
যুগ বদলেছে, বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। গান শুধু আর শোনার নয়, দেখারও। তা সত্ত্বেও কেউ ছিনিয়ে নিতে পারেনি তাঁর স্থান। গানের সূত্রেই অমরত্ব পেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
#হেমন্তমুখোপাধ্যায় #হেমন্তমুখোপাধ্যায়েরবাংলাগান