05/02/2025
আমার বিয়েতে সবচেয়ে বেশি আপত্তি যার ছিল সে হচ্ছে আমার ভাবী। অবশ্য আপত্তি হবে নাই বা কেন নিজে একজন ডাক্তার হয়ে বিয়ে করেছে জেনারেল লাইনে পড়া আমার ভাইকে। যখন দেখলো আমার বর হ্যান্ডসাম, ভালো স্টুডেন্ট ,বাইরে পড়াশোনার জন্য যাচ্ছে তখন তো তার একটু আতে ঘা লাগবে বৈকি । আসলে এই দুনিয়াতে কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না। এমন কোন কাজ নেই যে সে আমার বিয়ে ভাঙার জন্য করেনি। ভাইয়া প্রথম থেকে রাজি ছিল না এটা সত্যি কিন্তু পরে আমি আর মা মিলে কনভিন্স করে ফেলেছিলাম কিন্তু তারপর ভাইয়াকে আবার কি না কি বলেছ ওই কালনাগিনী ভাইয়া আবার বেঁকে বসলো। শেষে আমার জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে। তবে বলে দিয়েছে যদি এর ফল ভালো না হয় তাহলে তারা আমার দায়িত্ব নেবে না , আমার তাতে বয়েই গেল। আমার মা খুব ভালো করে জানতো, ওই মহিলা মানে তার একমাত্র পুত্রবধূ যদি আমার বিয়েতে উপস্থিত থাকে তাহলে কোন না কোন ভাবে আমার বিয়েটা ভেঙে দেবে তাই কড়া নির্দেশ দিয়ে তাকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আর আমার ভাই হচ্ছে বউয়ের আঁচল ধরা মানুষ সেও বিয়েতে উপস্থিত ছিল না। তার বউ বাচ্চা যেখানে নিমন্ত্রিত না সেও নাকি সেখানে থাকবে না। যতসব ফালতু সেন্টিমেন্ট।
ডাক্তার মহাশয়া নিজেকে অত্যন্ত মহাজ্ঞানী পন্ডিত মনে করে। সে ভাবে তার চেয়ে জ্ঞানীগুণী মানুষ এই দুনিয়াতে নেই কিন্তু আমি মনে মনে যেই ছক করতে পারি সে খাতা কলমেও তা করতে পারবে না। আমি দেখতে ভালো না, তবুও এই হ্যান্ডসাম ছেলেটা আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। এটাই আমার ভাবীর পছন্দ না।
অবশ্য আরো দুই একটা ছোটখাটো ব্যাপার আছে। সে নিজে আমার জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব এনেছিল। লোকটার বয়স প্রায় ৩৫ এর কাছাকাছি। একটা মেয়ে বাচ্চা আছে, সে দেশের বাইরে থাকে। নির্ঝঞ্ঝাট সংসার , শাশুড়ি ননদ নেই তার মতে। মানে দাঁড়াচ্ছে আমরা মা মেয়ে মিলে তাকে অনেক জ্বালাই যাইহোক ওই সংসারে নাকি আমাকে পাঠাবে। কত বড় ধৃষ্টতা, আমাকে নাকি বিয়ে দিবে একটা বিপত্নীক পুরুষের কাছে। আসলে কূটনীটা সফল হতে পারেনি তাই আমার প্রতি এত জেলাস।
অবশ্য আমার হবু শাশুড়ি ননদ যে খুব একটা রাজি তাও কিন্তু না। ওই যে বললাম আমি দেখতে তেমন একটা ভালো না যদিও সবাই বলে আল্লাহর সৃষ্টি সবই সুন্দর তারপরেও আমি কালো মোটা বেঁটে । তাই বলে কি আমার ভেতরের সৌন্দর্যটা দেখবে না? তবে ছেলের কাছে তারা হার মেনেছে। আর ঐ ছেলেকে কিভাবে হাতে রাখতে হয় সেটা তো আমি ভালো করেই জানি। ইমো আইডিতে পরিচয় হয়, তারপর যা হবার তাই হলো। সে আমাকে কি ব্ল্যাকমেইল করবে ,আমিই করেছি। এখন সে চাইলেও আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না।
আর তাছাড়া দুই একটা ছোটখাটো ব্যাপার তো গোপন করতেই হয়।
যেমন ছেলের চেয়ে আমি বয়সে চার বছরের বড় সেটা গোপন করে গেছি কারণ আমার ডিগ্রী পরীক্ষার সার্টিফিকেট দেখে বোঝার উপায় নেই । স্কুলে ভর্তি হয়েছি দেরি করে দুই একটা ক্লাসে ফেলও করেছি। আমি এসবের তোয়াক্কা করি না, ছেলে না জানলেই হলো।
আর হ্যাঁ ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় আমার ওভারির কোন একটা সমস্যা হয়েছিল পরে নাকি সেটা জরায়ুতেও চলে গিয়েছিল, কি করে সেসব জানিনা। মেজর একটা অপারেশন হয়েছিল, জরায়ু ফেলে দিতে হয়েছিল সেটা গোপন করে গেছি। আর আমার ভাবীর আপত্তিটা এখানেই। তার কথা হচ্ছে যদি ছেলে তোমায় সত্যি ভালোবাসে তাহলে তাকে সবটা বলে তারপরে বিয়ে করা উচিত। আচ্ছা কোন ছেলে এসব শুনলে বিয়ে করবে? তার মানে আমার বিয়েটা ভাঙার ধান্দা ছাড়া আর কিছুই না। বিয়ের পর নিশ্চয়ই আমায় ফেলে দিতে পারবে না। তাছাড়া আমার কাছে যে জিনিস আছে তাকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য কি করে ফেলবে?
বিয়েটা আমার ভালই ভালই হয়ে গেছে। বিয়ের রাতেই রাতুলকে থেকে যেতে বললাম সেও সঙ্গে সঙ্গে রাজি। রাতুল মানে যে আমার হবু বর ছিল এখন আমার বর। মিষ্টি মধুর দিন কাটতে লাগলো। এরই মধ্যে আমার ভাবী আবার বাড়িতে ফিরে এসেছে। আমাকে ওরা শ্বশুর বাড়িতে তুলে নেয় নি। রাতুল বাইরে থেকে পড়াশোনা শেষ করে এলে তারপর রিসিপশন হবে । এখনো ওরা ওদের আত্মীয়-স্বজন কাউকে ঠিকমতো জানায়নি। রাতুল অবশ্য আসা-যাওয়া করে। আমার ওই কালনাগিনী ভাবী যখন বাড়িতে থাকে তখন রাতুল এলে ভালোই যত্ন করে ,এটা সেটা এগিয়ে দেয়, খাবার রান্না করে, নাস্তা গুছিয়ে দেয়, ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে যদিও আমার এটা একেবারে পছন্দ না, সুন্দরী মেয়ে দেখলে যে কোন ছেলের মাথা ঘুরে যেতেই পারে। সে যে তার সৌন্দর্য দিয়ে আমার জামাইকে কুপোকাত করতে চাইছে সেটা আমি ভালই বুঝতে পেরেছি। উপরে উপরে বড় বোনের মত ভাব দেখালেও চোখ দেখলেই বুঝতে পারি কি চাচ্ছে সে।
এরপর থেকে রাতুল বাড়িতে এলে সে যেন ওর সামনে না আসে তা খুব কড়া ভাষায় আমি বলে দিয়েছি ।প্রথমে ডাইনিটা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল পরে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে দিল আর আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
রাতুল বাইরে পড়াশোনা করতে যাবে সেই জন্য বেশ কিছু টাকা-পয়সার প্রয়োজন, আমি জানি ওরা মধ্যবিত্ত। তাই ভাইয়াকে গিয়ে বলবো বলে ঠিক করলাম, ওদের তো আর আয় রোজগারের শেষ নেই। ডাক্তার বউ রাতের পর রাত নাইট ডিউটি করে । কাড়ি কাড়ি টাকা কামাচ্ছে অবশ্য ডিউটি করে না কি করে কে জানে? মেয়ে মানুষ রাতের বেলা বাড়ির বাইরে থাকছে আবার মুখে বড় বড় সতিত্বের কথা, ডাক্তার হয়ে যেন মাথা কিনে নিয়েছে।
ভাইয়া তখন ল্যাপটপে কি যেন একটা কাজ করছিল আর ডাইনিটা স্বামীর জন্য কফি বানাতে ব্যস্ত। আমি মুখে না বললে কোনদিন আমাকে বানিয়ে দেয় না অথচ আমার ভাই শ্বাস না ফেলতেই সবকিছু মুখের সামনে এসে হাজির। শুধু বিয়ে করে স্বামীর খেদমত করলেই হয় না পুরো শশুর বাড়ির খেদমত করতে হয়। এইটা বোধহয় এই মেয়েকে তার বাপ মা শিক্ষা দেয় নি। আমি ভাইয়াকে কথাটা বলতেই যাবো এমন সময় আমার শাশুড়ির ফোন। অসহ্য লাগে এই মহিলাকে আমার। কারণে অকারনে ফোন করবে।
বিরক্ত লাগলেও ফোনটা রিসিভ করলাম,
ওপাশ থেকে আমার আমার ননদের কন্ঠ , যে কিনা ঢাকা ইউনিভার্সিটি তে অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স না কি একটা সাবজেক্টে যেন পড়ে। সেও নিজেকে বিরাট জ্ঞানী মনে করে। বিয়ের দিন এসেছিল, আমার হাতে মেহেদি পরিয়ে দিতে চাইলে আমি সরাসরি না করে দিয়েছি। মেহেদি দিলে তো আমি পার্লার থেকেই দিয়ে আসতে পারতাম । অনারম্ভরভাবে বিয়ে হচ্ছে তাহলে মেহেদী পরে কি হবে? তাছাড়াও মেয়েটা কথাও বলে ফটফট। কত বড় সাহস আমাকে বলে কিনা তার চা করে দিতে মানে আমি যে মেয়ে কখনো গ্লাসে পানি ভরে খাই না সে তার জন্য চা করে দিবে কারণ তার মাথা ব্যথা করছে। কয়েকবার সে আমাকে চা করে খাইয়েছে বলে, এখন নাকি আমাকেও করতে হবে মগের মুল্লুক পেয়েছে, তাও আমারই বাড়িতে। আর এই বাড়িতে এত ঘন ঘন আসার কারণ তো বুঝি না বাপু। যাই হোক ফোন রিসিভ করে খুব বিরক্তির সরে বললাম ,
-কি হয়েছে ঐশী? কেন ফোন করেছ ?
-এভাবে কথা বলছ কেন ভাবী ,তোমাকে ফোন করতে কারণ লাগবে ? এমনি গল্প করার জন্য ফোন দিয়েছি।
-আমি ব্যস্ত থাকি, যখন তখন আমাকে ফোন করবে না
মেয়ে যেন আকাশ থেকে পরলো তুমি আবার এত কিসের ব্যস্ত ! তুমি তো আর এখন মাস্টার্স করছো না তাছাড়াও চাকরি বাকরিও করছো না এমনকি চাকরি-বাকরি করার চেষ্টাও করছো না।
-শুনো ঐশী, এখন থেকে আমার সাথে সাবধানে কথা বলবে
-তুমি এমন ব্যবহার করো কেন আমার সাথে ভাবী
-আমি ভালোভাবেই কথা বলছি হয়তো তোমার ফোনের স্পিকার নষ্ট
-আচ্ছা ভাবী আমি রাখি, ওইপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস শুনলাম
আমার বয়েই গেছে ওর দীর্ঘশ্বাসের জন্য আমি যেন এখন আহাজারি শুরু করবো।
-কিরে কিছু বলবি ?
-ভাইয়া জানোই তো রাতুল বাইরে যাবে পড়াশোনা করতে
ভাইয়া মুখ না তুলেই বলল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো
-তো আমার বিয়েতে তো কোন খরচ টরচ করনি এবার তো কিছু দিতে হয় তাই না ?
কফি নিয়ে ঘরে ঢুকলো সেই সম্রাজ্ঞী ,ঢুকেই বলে বসলো
-হ্যাঁ তোমার বিয়েতে কোন ধুমধাম হয়নি সবকিছু ঠিক আছে কিন্তু আমার যত গয়না আছে সবই কিন্তু মা তোমাকে দিয়ে দিয়েছে
-কি বলতে চাচ্ছ ভাবী, মায়ের গয়নায় মেয়ের অধিকার থাকবে না?
-ওগুলো তোমার মায়ের গয়না না ওগুলো আমার বাবার বাড়ি থেকে দেয়া। মা শুধু আমাকে একটা পাতলা চেইন দিয়েছিলেন। তবুও আমি একটি শব্দ উচ্চারণ করিনি। আচ্ছা এসবে আমি না ঢুকি, দেখো তোমার ভাইয়া যা বলে ।
-ভাইয়া শোনো ওর অনেকগুলো টাকা প্রয়োজন আর ও একবার বিদেশে সেটেল হয়ে যেতে পারলে আমাকেও তো নিয়ে যাবে তাই না ?
-শোন ঋতু তোর বিয়েতে আমার কোন মত ছিল না আর এই বিয়েটা আমার ভালো লাগছে না। আমি এখন কোন প্রকার টাকা পয়সা দিবো না, সত্যি কথা বলতে কি আমার কাছে সেই পরিমাণ ক্যাশ নেই আর থাকলেও আমি দেয়ার আগে বেশ কয়েকবার ভাবতাম তবে রাতুল যখন তোকে নিয়ে যাবে তখন যা খরচ লাগে আমি দিবো কথা দিচ্ছি তোকে।
-তার মানে তোমরা কোন সাহায্য করবে না! রাতুলের সামনে আমি কি করে চেহারা দেখাবো ?
-তুই এখন ঘর থেকে যা
মায়ের কাছে গেলাম গিয়ে কেঁদে কেটে কেটে একাকার করে দিলাম।
-মা তুই চিন্তা করিস না, তোর বাবার গ্রামের বাড়ির সমস্ত সম্পত্তি আমার নামে। আমি বিক্রি করে দিলেও কেউ আমায় কিছু বলতে পারবে না, তোর চাচাদের সাথে কথা বলছি , কান্না করিস না মা।
-কিন্তু ভাইয়া যদি কিছু বলে ?
-ওইটা আমার নামে আর আমার সম্পত্তি আমি আমার মেয়েকে দিব সেখানে কে কি ভাবল তা আমার বিবেচনা করার বিষয় না
-ভাবী কোন না কোনভাবে বাগরা দিবে, দেখো
-ছাড় তো পরের বাড়ির মেয়ে, ঐসব আমি দেখে নিব ।
সত্যিই মা তেলেসমতি কান্ড করে দেখালেন। ভাইয়া ভাবী কেউ কোন কথা বললো না। কি জানি কি করে মুখে স্কচটেপ আটকে রেখেছিল। গ্রামের শুধু ভিটেমাটি ছাড়া বাকি যে সম্পদ আছে সবটা বিক্রি করে রাতুলকে দেয়া হলো। সেই রাতটা ছিল আমার জন্য স্বপ্নময় বর্ণিল একটা রাত। তবে আমি ইচ্ছে করেই দু এক রাত রাতুলকে দূরে সরিয়ে রেখেছি বলেছি, "আমার পি*রি*য়*ড হয়েছে।" না হলে হয়তো সে ব্যাপারটা ধরে ফেলবে। তবুও ইন্টিমেট সময়ে অনেক সময় উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে বসে, আমিও উল্টাপাল্টা জবাব দিই।
ইতোমধ্যে ভাবীর পোস্টিং হলো ঢাকায়। কাকে কাকে ধরে, কিসের বিনিময় বা কয় রাতের বিনিময়ে ঢাকায় গেছে কে জানে, ঢাকায় যাওয়া কি এত সহজ? উদ্দেশ্য জামাইয়ের কাছাকাছি থাকা, ভাইয়ার চাকরিটা তো ঢাকাতেই। সাপ্তাহিক ছুটি তে এখানে আসতো। এখন সারাক্ষণ আমার ভাইয়ের সাথে থাকবে আর গিলে খাবে আমার ভাইটার মাথাটা।
এদিকে রাতুলের যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে। আমার কেমন উদাস উদাস লাগে। মনটা গোধূলির আকাশের মত ভারী হয়ে থাকে সবসময়। এক সময় রাতুল চলেও গেল।
এখন যেহেতু ভাবী ঢাকায় চলে গেছে তাই আমার ভাই এখানে আসার আর প্রয়োজন বোধ করে না। মাস শেষে অবশ্য টাকা পাঠালো। টাকা পেয়ে মায়ের চোখ তো চড়ক গাছ, মাত্র ২০ হাজার টাকা! আমরা ভাড়া বাড়িতে থাকি। এটা কি ভুল করে পাঠিয়েছে? মা তখনই ভাইয়াকে ফোন দিল
-তুই মাত্র ২০ হাজার টাকা পাঠিয়েছিস, এই টাকায় কি হবে?
-আমার ফ্যামিলি এখন এইখানে, বাচ্চাটাকে এখানকার স্কুলে ভর্তি করাতে হয়েছে। কাজেই আমার খরচ বেড়ে গেছে আর তাছাড়া এখন তোমার একার জন্য বিশ হাজার টাকা আমি মনে করি যথেষ্ট। ছেলের এ ধরনের কথায় মা চমকে উঠলেন ।
-আমার একার জন্য মানে! তোর বোনের কি হবে ?
-তার জন্য তার স্বামী আছে
-সে তো আর ইনকাম করে না, সে পড়াশোনা করতে গেছে ,
আসল কথা হচ্ছে জায়গা জমি কিছুই তোকে না দিয়ে সব ওকে দিয়েছি এটাই তোর বউয়ের সমস্যা।
-হ্যাঁ মা সমস্যা তো বটেই তবে আমার বউয়ের না, আমার নিজেরই । তুমি যদি আমাকে বঞ্চিত করতে পারো তাহলে আমিও তো আমার ফ্যামিলির ফিউচার টা দেখবো তাই না? তবে তুমি দোষ আমাকে দিতে পারবে না যে আমি তোমাকে ফেলে দিয়েছি। একটা মানুষের চলার জন্য বিশ হাজার টাকা যথেষ্ট ।
-বাসা ভাড়াই তো ১২ হাজার টাকা চলে যায়
-গ্রামের বাড়িতে ভিটা মাটি আছে সেখানে চলে যেতে পারো মা আমি রাখি। প্রতি মাসে এর বেশি আমি আর দিতে পারবো না ।
মায়ের মুখ গম্ভীর হলো আসলেই আমাদের তখন গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। সবকিছু হয়েছে ওই অসভ্য মেয়েটার জন্য নিশ্চয়ই সারাক্ষণ আমার ভাইয়ের কানে কান মন্ত্রণা দিয়েই যাচ্ছে।
গ্রামের বাড়িতে আসার পরে আমার এডজাস্ট করতে খুব সমস্যা হচ্ছিল যদিও এখান থেকে এসএসসি পাস করার পরেই আমি শহরে গিয়েছিলাম তবুও গ্রাম তো গ্রামই। এখানে কি থাকা যায়? রাতুলকে বলতে হবে দ্রুত যেন আমাকে নিয়ে যায় কিন্তু কি করে বলবো ও ইদানিং খুব ব্যস্ত থাকে আমাকে একেবারে সময় দিতে পারেনা, দুই তিন দিন পর পর এক দুই বার চ্যাটিং হয়।
হঠাৎ এক রাতে মা কেমন অস্থির বোধ করলেন সমানে ঘামতে লাগলেন কিছু বুঝে উঠার আগেই হার্ট এটাকে মা চলে গেলেন।
পরের দিন টা পুরো বাড়ি গমগম করছিল। আমার ভাই ওই বেয়াদবটাকে সাথে করে নিয়ে এসেছে যাকে আমার মা একদম দেখতে পারত না বলাই বাহুল্য আমিও পারিনা। কি দেমাগ , দেমাগের চোটে মাটিতে পা পরে না। একবার আমার বিছানা গুছিয়ে দিতে বলেছিলাম সে তখন তাড়াহুড়ো করে হসপিটালে যাচ্ছে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল
-এখন বড় হয়েছো, বিয়েও হয়েছে, তাছাড়া বয়সে তুমি আমার চেয়ে বড়, সম্পর্কে না হয় ছোট, নিজের কাজটুকু অন্তত করো।
ভেবেছে আমাকে এত বড় একটা কথা শুনিয়ে চলে যাবে প্রচন্ড রাগে আমার গা জ্বলে গিয়েছিল, ঠাস করে একটা থাপ্পড় মেরে দিয়েছিলাম
সেই দিনই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল আর তারপরেই তো দ্রুত ঢাকায় পোস্টিং নিল । আমার চেহারা নাকি সে আর দেখতে চায় না। আমার ভাইয়ের কম টাকা পাঠানোর পেছনেও এই ঘটনা যে দায়ী এটা খুব ভাল করেই বুঝতে পারি। তার বউ এখানে থাকবে খাবে অথচ আমার বিছানাটা গুছিয়ে দিতে পারবে না এ কেমন কথা! যত যাই হোক এই বাড়ির বউ সে । আমার শাশুড়ি আর ননদও এসেছিল আমার শাশুড়ি নানান ভাবে আমাকে সান্তনা দিচ্ছিল । মহিলাকে দেখলেই আমার গায়ে জ্বালা ধরে সারাক্ষণ আমার সামনে হাদিস ফলাতে থাকে। আমার মা মরেছে আমাকে ঠিকমতো কাঁদতেও দিচ্ছে না কোরআন শরীফ নিয়ে এসে বলে আমি নাকি এক পারা পড়ে দিতাম। সেই কোন ছোটবেলায় পড়েছিলাম তাও পুরো শেষ করিনি এখন নাকি সেটা পড়তে হবে কান্নাকাটি বাদ রেখে। রক্তিম চোখে তাকিয়ে ছিলাম বয়সে ছোট হলে তাকেও একটা থাপ্পর দিতাম। আমার মনোবৃত্তি বুঝতে পেরেই বোধ হয় ঐশী তার মাকে নিয়ে গেল। আর আমার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। তাতে আমার বয়েই গেল তোদের টা আমি খাই না পরি? ভারী এসেছে আমার ঢাকা ইউনিভার্সিটিওয়ালী।
তিন দিনের মিলাদ শেষে ভাইয়া তার পরিবার নিয়ে চলে যাবে, তখন আমাকে নিয়ে সবার মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছে।
ভাবী আমার শাশুড়ি কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-আন্টি, আমাদের মেয়েটার একটু মাথা গরম কিন্তু মেয়ে খুব ভালো। আপনি একদম চিন্তা করবেন না আর রাতুল তো এখনো পড়াশোনা করছে, ঋতুর খরচ আমরাই দেব। আপনি শুধু ওকে আপনার কাছে নিয়ে রাখুন, ওর সিকিউরিটি আমাদের কাছে অনেক জরুরী।
আল্লাহ! এই মেয়ের মুখের বাণী শুনে সবার কাছে অমৃত লাগবে কিন্তু আমি তো জানি এটা কি জিনিস ? কি সুন্দর করেই না বুঝাচ্ছে !
আমার শাশুড়ি ও তখন সুরে সুর মিলিয়ে বললেন
-না না মা , ও তো আমার ছেলের বউ ওকে আমি আমার কাছে নিয়ে রাখবো। তোমরা কেন খরচ দিবে?
মুহূর্তে আমার মাথাটায় রক্ত উঠে গেল, মানে কি! আমি কি একবারও বলেছি আমি ওই মহিলার সাথে বসবাস করবো ?
-অসম্ভব বলে চিৎকার করে উঠলাম আমি
সবগুলো চেহারা আমার দিকে ঘুরে গেল
-আপনারা আমার মতামত না নিয়ে আমি কোথায় থাকবো না থাকবো সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।
-তাহলে তুই কোথায় থাকবি? ভাইয়া গলার স্বর উচু করে বললো
-আমার পুরোপুরি অধিকার আছে তোমার সাথে থাকার, আমি তোমার বোন।
-বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি মেয়েদের ঠিকানা হয় তবুও আমি তোকে রাখতাম কিন্তু তুই আমার স্ত্রীর সাথে যে ব্যবহার করেছিস তাতে তুই ভিখারির মত আমার বাড়িতে গেলেও আমি তোকে রাখবো না
-ও ওই একটা থাপ্পরের জন্য তুমি আমাকে শাস্তি দিচ্ছো ?
-থাপ্পর! আমার শাশুড়ি আর ননদ যেন থমকে গেল
-হ্যাঁ বেয়াদবি করেছিল তাই থাপ্পর দিয়েছি তাদের দিকে ফিরে সোজা সাপ্টা জবাব দিলাম ।
-তুই যেখানে খুশি সেখানে থাক আমি আর তোর কোন দায়িত্ব নিচ্ছি না। ভাইয়া ভাবীকে ইশারা করলো আর ভাবী মেয়ের হাত ধরে বের হয়ে গেল, ভাইয়া ঘরের দিকে গিয়ে নিজেদের ব্যাগ নিয়ে রওনা হলো।
আমার শাশুড়ি এগিয়ে এসে বললেন,
- একটু আগে তুমি যা বললে সেটা কি সত্যি?
-কেন আপনার কি মনে হয় বেয়াদবি করলে আমি থাপ্পর মারতে পারি না আর আপনার কাছে জবাবদিহিতা জন্য বাধ্য নই। আমি আপনার ছেলেকে বিয়ে করেছি আপনার পুরো পরিবারকে না ।
ঠাস করে আমার গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে দিলো উনি আমি প্রায় ছিটকে পড়ে যাচ্ছিলাম দেখলাম আমার দুই চাচা দাঁড়িয়ে আছে কেউ কিছু বললো না
-শোন বেয়াদব মেয়ে, তুমি আর তোমার মা মিলে যে বিয়ের আগে এত কিছু লুকিয়েছো সেটা আমি এখানে এসে জানতে পেরেছি। তবুও তোমাকে এই পরিস্থিতিতে আমি একা রেখে যেতে চাইনি । কিন্তু তোমার যে ব্যবহার তাতে আমার ছেলেকে যত দ্রুত সম্ভব তোমাকে ডিভোর্স দিতে আমি বলবো আর আমার মনে হয় সেটা বলতে হবে না কারণ আমার ছেলেটা যথেষ্ট চালাক এবং চতুর সে আমার বা আমার মেয়ের মত নয় সে তোমাকে বিয়ে করেছে উদ্দেশ্য বোধহয় ওই একটাই ছিল তোমার কাছ থেকে টাকা হাতানো। আমরা মা মেয়ে মিলে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। তোমাকে যে ওর পছন্দ না সেটা আমরা বিয়ের পরপরই বুঝে গিয়েছি, আমাদের পরিবারে এই ডিভোর্স কালচারটা নেই আর আমরা চাইনি আমার ছেলেকে দিয়ে এটা শুরু হোক তাই ওকে অনেক বুঝিয়ে শুুঝিয়ে এখন পর্যন্ত রেখেছি কিন্তু এখন উৎসাহিত করব। ঐশী চল, বলে ঘটঘট করে অসভ্য মহিলা বের হয়ে গেল।
মায়ের জন্য খুব কান্না পেল। সত্যিই এতদিন টিভি সিনেমায় যা দেখে এসেছি তা হাড়ে হাড়ে মিলে গেছে। ননদ শাশুড়িরা এত খারাপ হয়! ছি: আজকে ওরা আমাকে ফেলে এভাবে চলে যেতে পারলো? আর ঘরে বউ আসলে ছেলে যে পর হয়ে যায় এটাও তো চোখের সামনে আমার ভাইকে দেখেই বুঝলাম। কিভাবে বউয়ের নেওটা হয়েছে, একটা থাপ্পড় দিয়েছি বলে আমাকে এত বড় শাস্তি দিল, আমি ওর মায়ের পেটের বোন।
রাতুলের কাছ থেকে কোন দেনমোহর ছাড়াই ডিভোর্স লেটার পেয়েছিলাম। কেস করলে অবশ্যই দেনমোহর পেতাম কিন্তু সেই সামর্থ্য আর লোকবল আমার ছিল না। এভাবে কেটে গেছে পাঁচ বছর। আর কখনো যোগাযোগ হয়নি কারো সাথে জানিনা হয়তো সেখানে রাতুল সেটেল হয়ে গেছে নতুন কাউকে জীবনসঙ্গী করেছে। আমি আমার এক চাচার সংসারে থাকি। চাচি প্যারালাইসিস এর রোগী। বাজার করা ছাড়া আর সব কাজই আমাকে করতে হয়। চাচাতো ভাইয়ের বউ আগেই বলে দিয়েছে
-শোনো মেয়ে আমাদের এখানে থাকতে হলে কাজ করে খেতে হবে। আমি তোমার শিক্ষিত ডাক্তার ভাবী নই যে যাই কিছু করো না কেন পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে চুপ করে থাকব ।আমি যা বলব তাই তাই করবে, মুখে মুখে তর্ক তো করবেই না তাহলে চুল ছিঁড়ে ফেলবো আর চড় থাপ্পর কয়টা খাবে তার কোন সীমা পরিসীমা নেই আমি প্রচন্ড রেগে কিছু বলতেই যাচ্ছিলাম থাকি একটা থাপ্পর খেলাম
-এইটা প্রথম কিস্তি, এরপর থেকে চলতেই থাকবে যদি ঠোঁট চলে । বলে বিশ্রী ভঙ্গি করে ভাবী চলে গিয়েছিল।
সন্ধ্যার মৃয়মান আলো, শীতকালে এমনিতেই গ্রামে তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামে, রাত ভোর হতে অনেক সময় নেয়। মানুষ আর এখন মানুষের কাতারে নেই। একটা লোভী মানুষকে বিয়ে করেছিলাম। ননদ আর শাশুড়ি দুটোই প*তি*তা আর ভাই তো ঢুকেছে সেই কু*ত্তি*টার আঁচলের নিচে। সবাই এত নিষ্ঠুর কেন, পৃথিবীতে আমি এক অসহায় মেয়ে ,সৃষ্টিকর্তা কি দেখেনা?
©সুবর্না শারমিন নিশী*