23/04/2024
আকাশ হোসেন। জয়পুরহাট জেলার দোগাছী গ্রামের এক দিনমজুর পিতার ঘরে জন্ম নেয়া মেধাবী সন্তান। প্রাইমারী আর হাইস্কুল লাইফে পিতার কষ্টে উপার্জিত অর্থের পাশাপাশি নিজের মেধায় অর্জিত বৃত্তি, এ দুইয়ের সমন্বয়ে চালিয়ে নিয়েছিলো তার লেখাপড়া। কলেজ লাইফের আগ পর্যন্ত কোনো প্রাইভেট টিচারের কাছে পড়ার সুযোগ হয়নি তার। কলেজ লাইফেও শিক্ষকেরা বিনে পয়সাতেই তাকে বিভিন্ন ব্যাচে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। অদম্য মেধার পরিচয় দিয়ে শেষ পর্যন্ত টিকে গিয়েছিলেন বুয়েটেও। পেয়েছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর মতো প্রসিদ্ধ বিষয়ে লেখাপড়ার সুযোগ। বুয়েটে ভর্তি কার্যক্রম থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজে তার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয় "মানুষের মানুষের জন্য" নামক বুয়েটিয়ান সিনিয়রদের দ্বারা পরিচালিত এক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান থেকে।
কিন্তু সেই দরিদ্র ঘরের মেধাবী ছাত্রটিকে আজ সকলেই চিনে "আবরারের খুনী" হিসেবে। ফার্স্ট ইয়ারে সহজ সরল ছেলেটি সিনিয়র হওয়ার পরে যোগ দেয় বুয়েট ছাত্রলীগে। আকাশের ঘনিষ্ঠ অনেকের মতে, আকাশ কে এই বলে লোভ দেখানো হয়েছিলো যেঃ "তুই গরীব ঘরের ছেলে। তোর ত চাকরি পাওয়ার কোনো লিংক নাই। তুই আমাদের সাথে ছাত্রলীগে যোগ দে। তোর সব চাকরি, লিংক আর টাকাপয়সার ব্যবস্থা ছাত্রলীগ থেকেই পেয়ে যাবি।" বুয়েট ছাত্রলীগের মানুষরূপী কিছু পশুর এরূপ কথায় প্রভাবিত হয়ে আকাশও যোগ দেয় তাদের দলে।
আকাশের এভাবে ছাত্রলীগে যোগদানের বিষয়টি অনেকেই জানতো না। আবরার হত্যার পরে অনেকেই ভেবেছিলো, হয়তো আকাশ সেদিন সাধারণ ছাত্রলীগ হিসেবে দলীয় এজেন্ডা মোতাবেক দলের প্রতি আনুগত্য দেখাতে ২০১১ নং রুমে গিয়েছিলো"। কিন্তু পরবর্তীতে তদন্তে জানা যায়ঃ "আবরার ফাহাদকে হত্যা করার পূর্বে পরিকল্পনা বৈঠকে আকাশ নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছিলো। হত্যাকান্ডের দিন আবরার কে তার রুম থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া, মুমুর্ষু অবস্থায় বাথরুমে নিয়ে যাওয়া, যে রুমে অত্যাচার করা হয়েছিলো সে রুম থেকে অন্যত্র আরেকটি রুমে আবরার কে সরিয়ে নেয়া সহ একাধিক কাজে সে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলো।" এসব তথ্য বেরিয়ে আসার পরে বুয়েটিয়ান কমিউনিটির কেউ ই আকাশের প্রতি আর বিন্দুমাত্র সহানুভুতি প্রদর্শন করেনি। সকলের কাছেই তার পরিচয় কেবলই "আবরার ফাহাদের খুনী" (যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রাপ্ত)।
খুনী আকাশের প্রতি আমাদের বুয়েট পরিবারের এখন আর কোনো সহানুভুতি কাজ করে না। একজন খুনীকে আমরা কখনোই মাফ করতে পারবো না। যারা দিনের পর দিন বুয়েট ক্যাম্পাস কে ত্রাসের রাজত্বে পরিণত করেছিলো, যারা পুরো বুয়েট কে পরিণত করেছিলো একটি জীবন্ত টর্চার সেলে, তাদের প্রতি কোনোরূপ সহানুভুতি আমাদের মন থেকে আসে না। তবে তার অভাগা পিতামাতার জন্য আমাদের আফসোস থেকে যাবে। পায়ের ঘাম মাথায় ফেলে, রিকশা ভ্যান চালিয়ে, দিনমজুরী করে যে সন্তান কে বড় করেছিলেন তারা, সমাজে একসময় যে সন্তান ছিলো তাদের গর্বের বিষয়, হয়তো ভেবেছিলেন এ সন্তানের হাত ধরেই দারিদ্র্যতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে পুরো পরিবার, আজ সে সন্তানই তাদের কাছে সবচেয়ে বড় বোঝা!! একসময় যে রিকশাচালক পিতাকে দেখে সবাই বলতো "বুয়েটিয়ানের গর্বিত পিতা", আজ উনার পরিচয় "একজন খুনীর জন্মদাতা বাপ"। নিজেকে একটু আকাশের পিতামাতার স্থানে কল্পনা করে ভাবুন তো!!!
আকাশের ঘটনা আবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কেনো আমরা ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে। আমরা বুয়েটিয়ান পরিবার চাইনা, আকাশের মতো সহজ সরল পরিশ্রমী কোনো শিক্ষার্থী রাজনীতিতে জড়িয়ে পরিণত হোক কোনো হিংস্র হায়েনায়। আমরা চাইনা, কোনো অভিভাবক আকাশের পিতামাতার মতো এরূপ করুণ পরিণতির মুখোমুখী হোক। এসব কিছুর মূলেই রয়েছে শুধুমাত্র বুয়েটের ছাত্ররাজনীতি। তাই, ছাত্ররাজনীতি মুক্ত একটি ক্যাম্পাস এই মুহূর্তে আমাদের মূল দাবী। এ মুহূর্তে রাজনীতি থাকা অবস্থায় কোনোভাবেই লেখাপড়ার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব নয়, এটিই আমাদের সকলের অভিমত।