14/10/2025
#অজান্তে_ভালোবেসেছি_তোকে
#২য়_পরিচ্ছেদ
#রুদ্রিকা_বেদী
পর্ব - ০১
[🚫পর্বটি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষদের জন্য 🚫]
“এই কে রে, আমার নানু ভাইয়ের পিছনে লেগেছে?”
রূপকথা তেজের সাথে তার কথা বলা শেষ করতে রুমের ভিতর থেকে একটা ভারী এবং ভাঙ্গা গলা ভেসে আসলো। পর মূহুর্তে ঘর থেকে উইট চেয়ারে একজন পঁয়ষট্টি থেকে সত্তর বছরের মাঝে বেরিয়ে আসলেন। মাথায় চুল নেই বললেই চলে,যা আছে তাও পাকা। বয়সের চাপে শরীরের চামড়া সব ভেঙ্গে গেছে। চোখে গোল ফ্রেমের পাওয়ারের চশমা! লোকটি সাদা রঙের পাঞ্জাবি আর পায়জামা পড়ে আছে। দুইবার স্ট্রোক করার কারণে পায়ে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন তিনি,
“এই যে আরেকজন আসলেন। তোমাদের দুজনের জন্য আমার মেয়েটা বাদর হচ্ছে!”
“বলো নানু!”
রূশি আধো আধো স্বরে চেঁচিয়ে সাদাফের কোল থেকে লাফ দিয়ে দৌড়ে উইল চেয়ারে বসে থাকা লোকটার কাছে গেলো। লোকটি হাত বাড়িয়ে রূশিকে কোলে তুলে নিলো। রূশি লোকটা গলা জড়িয়ে ধরল।
সাদাফ মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো। রূপকথা, উইল চেয়ারে বসে থাকা লোকটা আর রূশির কাছ থেকে বিদায় জানিয়ে বলল,
“নানু, তুমি এসেছ এখন আমি রূশিকে রেখে যেতে পারি, নাহলে রূপকথার হাতে তুলে দিলে রূশিকে আর আস্তো পাওয়া যাবে না!”
সাদাফের কথায় উইল চেয়ারে বসে থাকা লোকটা খিলখিল করে হেসে উঠলো। রূশি মুখে হাত দিয়ে হাসলো,অন্য দিকে রূপকথা সাদাফের দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে উঠলো, সাদাফ সেই দিকে চেয়ে ভয় পাওয়ার মতো ভাব করে বলে,
“আচ্ছা আমি যাই! আমার গার্লফ্রেন্ড অপেক্ষা করছে, আজকে ডেটে যাবে বলেছে, দেরি করলে টিনা আমার দুই গালে দুটো থাপ্পর মারবে....!”
“তুমি টেনা আন্টিকে কুবে বিয়ে কলবা...?”
রূশি চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করল। তার শব্দ উচ্চারণ শুনলে রূপকথার গম্ভীর চেহারাটাও হাস্যোজ্জ্বল হয়ে আসে। রূপকথা নিজের হাসি সামলিয়ে বলে,
“ওটা টেনা আন্টি হবে না রূশি,ওটা টিনা হবে!”
রূশি চোখ মুখ চোখ মুখ কুঁচকে মায়ের দিকে তাকায়। রূপকথা চোখ পাকিয়ে উঠার আগে সাদাফ বলে,
“তুই যেদিন বিয়ে করবি, সেদিন তোর সাথে তোর টেনা আন্টির সাথে আমি বিয়ে করবো!”
সাদাফের কথায় রূশি লজ্জা পেয়ে উঠে। সে লজ্জায় বড়ো নানুর কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিলো। তার আদুরে ভাব দেখে সবাই এক প্রস্থ হেসে নিলো। সাদাফ রূশিকে আদর করে উইল চেয়ারে বসে থাকার লোকটা সালাম জানিয়ে বেরিয়ে গেলো।
সাদাফ যেতেই রূপকথা কড়া কন্ঠে রূশিকে আদেশ দিলো,
“রূশি অনেক খেলাধুলা হয়ে যাও এখন পড়তে বসো!”
“ম্যাম্মা,আল এতটু খেলি!”
“না,আর না,পড়তে যাও!”
রূশি ঠোঁট ফুলিয়ে কাতর দৃষ্টিতে তার বড়ো নানুর দিকে তাকালো। বড়ো নানুও ঠোঁট উল্টিয়ে চোখ পিটপিট করতে করতে বলে,
“যাও নানু ভাই! এখন পড়ো রাতে ডিনারের পর অনেক খেলবো!”
রূশি কিছু বলল না। সে নারাজ হয়ে বড়ো নানুর কোল থেকে নেমে দাঁড়ালো। মুখটা নিচু করে মায়ের কাছে যেয়ে দাঁড়ালো। রূপকথা মেয়ে দিকে তাকিয়ে ভীষণ মায়া হলো। সে হাঁটু গেড়ে বসে মেয়ের দুই গালে দুটো চুমু খেয়ে,রূশির মুখ তুলে ধরে বলে,
“যাও মা! এখন পড়তে বসো তারপর আমিও তোমার সাথে খেলবো!”
রূশি উৎফুল্ল হয়ে গেলো। সে মায়ের দিকে হাসি মাখা মুখে তাকিয়ে বলে,
“ছত্যি..?”
“তোমার মা বলেছে মানে বলেছে! আমি খেলবো!”
“ইয়াপপপ....”
বলে রূশি রূপকথাকে জড়িয়ে ধরে। রূপকথা মেয়েকে পরম আদরে ভরিয়ে দিলো। রূশি এবার তার বড়ো নানু আর মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। রূপকথা উঠে দাঁড়ালো। রূশি রুমে যাওয়া মাত্র তার মুখের হাসির গায়েব হয়ে গেলো। সে কিচেনের দিকে যাবে তার আগে উইল চেয়ারে বসে থাকা লোকটা নরম স্বরে ডাকলো,
“রূপ!”
“হ্যাঁ নানু।”
রূপকথার নানু মিস্টার রেওয়াজ শাহাবুদ্দিন খান! তিনি বাংলাদেশ এবং ইংল্যান্ডের অন্যতম বড়ো বিজনেস ম্যান। রূপকথার রেওয়াজ সাহেব গম্ভীর মুখে চেয়ে বললেন,
“এইদিকে এসে বস!”
“হুম বলো!” রূপকথা হাঁটু ভাঁজ করে মেঝেতে বসলো।
রেওয়াজ সাহেব নাতনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে তোর? মুড অফ কেন?”
“কাল আমার আর রূশির পাপার বিবাহ বার্ষিকী! চারটা বসন্তের মাঝে একটাও তার সাথে কাটাতে পারলাম না!”
“বোকা, এর জন্য মন খারাপ করে!”
“মন খারাপ করবো না তো কি করবো নানু! তোমরা তো সব আমাকে দাবার গুটি বানিয়ে রেখেছো! যখন যে আসে তখন সে নিজের সুবিধার মতো চালিয়ে যায়! তুমিও তো তার মধ্যে একজন নানু!”
রূপকথা অশ্রু নয়নে বলে উঠলো। বলতে যেয়ে গলা কাঁপছিল তার। নাতনীর এমন আচরণেও রেওয়াজ সাহেবের দৃঢ় ব্যক্তিতে কোনো পরিবর্তন আসলো না। সে মুচকি হেসে বলে,
“হুম মানছি তুই দাবার গুটি কিন্তু আমি তোকে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করেনি মা!”
“চুপ করো তুমি! স্ট্রোকের কথা শুনে আমি এখানে আসলাম! তোমাকে সুস্থ করলাম তারপর আমাকে আর যেতে দিলে না কেন?”
রেওয়াজ সাহেব নাতনীর কথা শুনে হাসলেন। চোখ থেকে চশমাটা খুলে ধরলেন। চশমা পরিষ্কার করতে করতে বললেন,
“তোর বর যেটা করেছে সেই হিসেবে একটু তো শাস্তি প্রয়োজন! আমি শুধু তাকে সেটাই দিচ্ছি!”
“চার বছর দূরে থাকা,এটা একটু শাস্তি নানু?”
“অবশ্যই! তুই নিজেকে যতটাই অভাগী মনে করিস না কেন, তুই তো শেহজাদী, তোর বাবার বংশ বলো আমার বংশ বলো তুই একমাত্র উত্তরাধিকারী এই সবের! সেই শেহজাদীর বর যদি নিজের প্রথম স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ভাবে,আমি আমার আজকের জীবন সঙ্গীকে ভালোবাসি কিনা মনে সেই প্রশ্ন জাগে তখন তার কাছ থেকে একটু হলেও দূরত্ব তৈরি করা উচিৎ!”
“তাই বলে চারবছর?”
রূপকথার কন্ঠে অভিমান ফুটে উঠলো। রেওয়াজ সাহেব প্রশ্নটা শুনে মিটমিট করে হাসলেন। তিনি এই চার বছরে রূপকথাকে অনেক শক্ত করে তুলেছেন। নিজের পায়ে চলতে শিখিয়েছেন কিন্তু সব পরিবর্তন হলেও অনুভূতি তো পরিবর্তন হয়না। রেওয়াজ সাহেব জানেন রূপকথা তার স্বামীকে কতোটা ভালোবাসে। চোখেই তো প্রকাশ পায় তবে মাঝে মধ্যে রাগও দেখা যায় রূপকথার ওই চোখে! রাগটা এই কারণে,যে শিশির কেন তাকে ভালোবাসতে পারলো না! রেওয়াজ সাহেব হাতের চশমাটা চোখে দিতে বললেন,
“তুই যখন হলি, তার কিছুক্ষণের মাথায় তোর মা,মানে আমার মেয়ে মারা যায়। একমাত্র সন্তান আমার! কষ্ট যেমন হচ্ছিল খুশিও হচ্ছিল, একজন গেছে তো কি হয়েছে তার অংশ তো থেকে গেছে, তোকে যখন প্রথম দেখলাম,তখনই বুঝতে পেরেছিলাম তুই কোনো রূপকথার পরিদের থেকে কম নইস! রেখে দিলাম রূপকথা। তোর বাবাকে বললাম, আমার নাতনীকে নিয়ে যাই আমার সাথে,না তিনি দেবেন না! তার বউয়ের শেষ চিহ্ন,কিভাবে ছাড়ে? জোড় করতে পারলাম,তোর দাদী হাত জোড় করে তোকে ভিক্ষা চাইল আমার কাছে! রাজি হলাম তোকে বাংলাদেশে রেখে আসতে! কিন্তু তাই বলে যে তোর ব্যাপারে খবর রাখতাম না এমন নয়। তোর প্রত্যেকটা পদক্ষেপ আমি নিজের নজরে রাখতাম। তোর সৎ মায়ের আচরণ সম্পর্কেও আমি জানতাম,তাই তোকে নিতে গেছিলাম কিন্তু তখনো তোর বাবা বাধ সাধে, মেয়েকে সে দেবে না! ভাবলাম অন্য উপায় তোকে সরিয়ে আনবো কিন্তু তার মধ্যে তোর আর আহসান ইন্ড্রাস্ট্রির একমাত্র উত্তরাধিকারী এবং বর্তমানের মালিক আর্শিয়ান আহসান শিশিরের সাথে বিয়ে ঠিক হলো! আমি খুশিই হলাম! শিশিরের অতীত সম্পর্কে আমি সব জানতাম কিন্তু ওতোটা মাথা ঘামায়নি! পাঁচ বছর তো হয়ে গেছে , শিশির তার অতীত সম্পর্কে হয়তো সব ভুলে গেছে কিন্তু আমার ধারণা ভুল হলো.....!”
থামলেন রেওয়াজ সাহেব। রূপকথা চোখ জলে ভরে উঠেছে। রেওয়াজ সাহেব রূপকথার চোখের জল মুছে আবারও বলতে শুরু করলেন,
“সবই ভালো চলছিল, কিন্তু একদিন শিশির তোর সতীনকে দেখতে পেলো!”
রূপকথার মুখ ফুলে উঠলো। সে বুঝতে পাচ্ছে নানু ইচ্ছে করে পিছনে লাগছে সতীন শব্দটা উচ্চারণ করে,
“পুরাতন স্ত্রীকে দেখে তার মনে হলো ,সে এখনো তার আগের স্ত্রীকেই ভালোবাসে! তাহলে বর্তমানে যে রয়েছে তার অবস্থান কোথায়? তুই বুঝতে পারলি সবকিছু, অভিমান করলি, কান্না কাটি শুরু করলি! আর এই দিকে সব খবর পেয়ে যেন আমার শরীর খারাপ হতে লাগলো, এতোটাই অসুস্থ হয়ে পরলাম তোর চিন্তায় স্ট্রোক হয়ে গেলো, ডাক্তার বলল হয়তো আর বাঁচবো না, শেষ ইচ্ছা স্বরূপ তোকে নিয়ে আসার হুকুম দিলাম! আর এই আদেশ পালন করলো সাদাফ! তুই আসলি, তোকে দেখে যেন জান ফিরে পেলাম! মরার ঘর থেকে ফিরে আসলাম কিন্তু পা টা আর চলল না! সুস্থ হওয়ার জানতে পারলাম তুই প্রেগন্যান্ট! আমি তো আবারও মহা আনন্দিত! প্রেগন্যান্ট অবস্থায় তোকে ছাড়ি কিভাবে আর সত্যি বলতে মিস্টার আহসানের প্রতি আমার একটু রাগ আছে, আমার নাতনী কি এতোটাই ফেলনা যে যখন খুশি নিজের বউ বানিয়ে নিবে আবার যখন খুশি ছুঁড়ে ফেলবে? তাই তো আর ফিরে যেতে দিলাম না!.... রূপকথা!”
রূপকথা এতোক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। নানুর প্রত্যেকটা কথা সত্য! কথাগুলোর উপর বিচার করার মতো কোনো কারণ নেই। শিশির শেষ মুহূর্তেও তার চোখে চোখ রেখে , 'তাকে ভালোবাসে' এই কথা বলতে পারেনি! কেমন দ্বিধা মধ্যে ছিল সে, এমন মানুষের সাথে সারাজীবন কি সংসার করা যেতো? রূশির উপর কেমন প্রভাব পড়তো?
“রূপকথা?”
আবার ডাকলেন রেওয়াজ সাহেব। রূপকথা এবার সাড়া দিয়ে উঠলো। রেওয়াজ সাহেব মুচকি হেসে বললেন,
“এতো চিন্তা করতে হবে না, আল্লাহ আছেন! যা হচ্ছে সব তার ইশারায়! এবং যা হবে তাও তার ইশারায় তাই শুধু হতে দাও!”
“হুম!”
“আর হ্যাঁ,কাল কিন্তু বাংলাদেশ থেকে অনেক বড়ো বিজনেস ম্যান আসছেন, মিটিং ফিক্স করা হয়েছে! কালকের মিটিং তুই সামলাবি!”
রূপকথা চোখ বড়ো বড়ো করে চাই তার নানুর দিকে। সে ঝটপট উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“নানু তুমি জানো কাল রূশিকে নিয়ে আমি সারাদিন বাইরে থাকবো,এর মধ্যে তুমি, মিটিং কেন ফিক্স করেছো?”
“আরে আমি কি বারণ করছি রূশিকে নিয়ে ঘুরতে, তিন চার ঘন্টার মিটিং শেষ করে রূশিকে নিয়ে যেখানে খুশি ঘুরিস,যদি সাথে এই বুড়ো কে নিতে চাইস তাহলে আমিও একটু মজা করতে পারি!”
“এই বুড়ো বয়সে আর মজা করতে হবে না,আরাম করো!”
বলে খাঁকারি দিয়ে ভিতরে চলে গেলো রূপকথা। রেওয়াজ সাহেব তার যাওয়ার দিকে চেয়ে ঠোঁট টিপে রহস্য ময় হাসলেন,
“কালকে তোর জন্য অনেক বড়ো কিছু অপেক্ষা করছে রূপকথার! আগাম হ্যাপি এনির্ভাসারি!”
_____
লন্ডনের এক বিশাল বহুল হোটেলের কামরায় আর্শিয়ান আহসান শিশির বিশ্রাম করছেন। আজ সকালেই ইংল্যান্ডে এসেছে সে, খান ইন্ড্রাস্ট্রিদের সাথে পার্টনারশিপ বিষয়ে আলোচনা করতে। কাল সকালে মিটিং!
শিশির একটা কালো রঙের ট্রাওজার পরিহিত অবস্থায় কামরার সাদা বিছানার উপুড় হয়ে শুইয়ে আছে। মাসের এই সপ্তাহ আসলেই শিশিরের কেমন আনচান করে। মাথা ছিঁড়ে যেতে চায় যন্ত্রণায়! আর তখনই মনে পড়ে কোমল হাতের স্পর্শ! যেন বিষাদ আরো বাড়িয়ে দেয়। কাল তার আর রূপকথার বিবাহ বার্ষিকী! মেয়েটা আর খুঁজে পেলো না সে! জানতে পারলো না,কেমন আছে! নিশ্চয়ই আরেকটু বুঝতে শিখেছি!
এই কয়টা দিনগুলিতে শিশির বেশি কাজ করে। কোনো রকম রেস্ট ছাড়া পরিশ্রম করে যাতে পুরোনো স্মৃতি তাকে না জ্বালায় কিন্তু কতোটুকু সাফল্য আসে তা শিশিরও ঠিক জানে না.....!
____
সকাল নয়টা।
রূপকথা,রূশি আর রেওয়াজ সাহেব এসে পৌঁছেছেন অফিসে। রূপকথা সম্পূর্ণ কালো আউটফিট বেছে নিয়েছে আজকে। কালো ফর্মাল প্যান্ট, কালো স্কিন টিশার্ট তার উপর জড়িয়ে থাকা কালো ওভার কোর্ট। পায়ে কালো পেন্সিল হিল। চোখে গাঢ় করে কাজল আর বাদামী চুলগুলো টাইট বান করেছে,অন্যদিকে রূশি পড়েছে মায়ের মিনি ভার্সন আউটফিট এবং সাথে নিয়েছে একটা পিংক টেডিবিয়ার!
রূপকথা রূশিকে তার নানুর কাছে দিয়ে মিটিং রুমের দিকে ছুটলো। সাড়ে নয়টায় মিটিং। সে দেরি করার মতো মেয়ে নয়। তার কে মিটিং রুমে যেতে দেখে বাকি কলিগরা তার পিছন পিছন ছুটতে লাগলো। তারা রূপকথাকে রাগী হিসেবেই চেনে। কোনো কিছু এখানে সেখানে হলে রূপকথার অগ্নি মুর্তি দেখা যায় এবং অফিসের বেশিরভাগ ইম্পলয় রূপকথাকে সমঝে চলে ...........
রূপকথার ম্যানেজার দৌড়ে রূপকথার পাশে এসে তার সাথে মিলিয়ে হাঁটা ধরল,
“তারা এসেছেন?” [ইংরেজিতে কথোপকথন হচ্ছে] রূপকথা জিজ্ঞেস করলো।
“হ্যাঁ ম্যাম তারা এসে গেছেন!”
বলে হাতের ফাইল এগিয়ে দিলো। রূপকথা ফাইলটা হাতে নিল কিন্তু খুলে দেখলো না। সে জলদি হেঁটে মিটিং রুমের দিকে এগোলো। পিছন পিছন বাকিরা।
রূপকথা দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতেই মিটিং রুমে উপস্থিত সবার মধ্যে চাপা ফিসফিসানি বন্ধ হয়ে গেলো। রূপকথা সোজা যেয়ে নিজের সিটের কাছে দাঁড়াল।
তার উপস্থিতিতে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে গুড মর্নিং জানালো তাকে। রূপকথা নিজের ডেস্কের উপর ফাইল রেখে মাথা তুলে গুড মর্নিং জানাতে যাবে তার আগেই রূপকথার চোখ থমকে গেলো বিশাল কাঁচের টেবিলের একদম রূপকথা বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির উপর। লোকটাও যেন থমকে গেছে।
রূপকথা নিজের চোখে বিশ্বাস করতে পারছে না,তার সামনে শিশির দাঁড়িয়ে আছে। রূপকথা ঢোক গেলল। শিশিরের ধারে সানজিদ দাঁড়িয়ে আছে। তার যেন চোখে বিশ্বাসই হচ্ছে না। সে গোল গোল চোখে একবার রূপকথার দিকে তাকায় তো একবার শিশিরের দিকে তাকায়!
শিশির হাতের মুঠো শক্ত টেবিলের উপর রাখলো। তার ভিতর যেন মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। রূপকথাকে দেখে আনন্দ হচ্ছে আবার আবাকও হচ্ছে,প্রশ্ন জাগছে আবার রাগও হচ্ছে!
____
“বলো নানু...তুমি কালকে আমাকে ....বুরছিলে যে আজ পাপা আছবে! থাহলে পাপা কোথায়?”
রূশি রেওয়াজ সাহেবের কোলে মাথা ঠেকিয়ে ঠোঁট উল্টে প্রশ্নটা করল। রেওয়াজ সাহেব কিছুক্ষণ রূশির দিকে চেয়ে রইল। চেহারা একদম বাবার উপর গেছে। এতো মায়া ভরা চেহারা! দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। রেওয়াজ সাহেব রূপকথার কপালে চুমু খেয়ে হেসে বললেন,
“তোমার পাপা তো চলে এসেছে। মিটিং রুমে তোমার মায়ের সাথে মিটিং করছে! মিটিং শেষ হলে তুমি যেও দেখা করতে!”
“সত্তি বলো নানু?”
“হুম!”
বলে রেওয়াজ সাহেব গাল বাড়িয়ে দিলো। রূশি চার বছর পর তার পাপাকে প্রথমবার দেখার আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। সে খিল খিল করে হাসতে হাসতে তার বড়ো নানুর গালে চুমু এঁকে দিলো এবং সাথে চলল হাততালি!
____
অবশেষে মিটিং শেষ হলো। সবাই আস্তে আস্তে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। শুধু বসে আছে তিনজন। রূপকথা শিশির আর সানজিদ। তিনজনের মুখ ফ্যাকাসে। সানজিদ হাসতে চাচ্ছে কিন্তু পরিস্থিতি দেখে আর হাসতে পাচ্ছে না। সে ইতিমধ্যে মুনকে ম্যাসেজ করে জানিয়ে দিয়ে রূপকথার ব্যাপারে। অপর পাশ থেকে আনন্দে ফেটে পড়ছে মুন।
“সানজিদ, বাইরে যা! তোর ভাবির সাথে আমার কিছু কথা আছে আলাদা!”
শিশিরের আদেশে সানজিদ তাড়াতাড়ি উঠে বাইরে চলে গেলো। রূপকথা অপর দিকে চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে। মনে ভয় কাজ করলেও প্রকাশ করছে না মুখে । সানজিদ বেরিয়ে যেতেই শিশির নিজের জায়গায় ছেড়ে উঠে আসলো রূপকথার দিকে। ধীর গতিতে!
রূপকথা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। শিশিরের এমন কঠিন চাহনি রূপকথার শরীরে শিহরণ বইয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ তার মনে পড়লো রূশির কথা! তাকে দেখলে শিশির কি করবে?
শিশির দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে গেলো একটা শব্দে। বাইরে থেকে বাচ্চা গলায় কেউ,ম্যাম্মা ম্যাম্মা বলতে বলতে ভিতরে প্রবেশ করছে।
রূশি তার পিংক টেডিবিয়ার হাতে নিয়ে দরজা টেলে ভিতরে ঢুকলো। তাকে দেখার সাথে সাথে শিশির বিস্মিত হয়ে রূপকথার দিকে তাকালো। রূপকথা অনুভূতি শূন্য দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চেয়ে আছে!
রূশি দৌড়ে মাঝখানে এসে দাঁড়াতেই চমকে উঠলো। সে শিশিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“পাপা...থুমি এছেছ?”
ছোট বাচ্চাটার মুখে পাপা ডাক শুনে যেন শিশির আকাশ থেকে পড়ল। রূশির দিকে বড়ো বড়ো চোখে তাকাতে লক্ষ্য করল, মেয়েটা অধিকাংশই তার মতো দেখতে! তাহলে কি মেয়েটা তারই সন্তান? শিশির রূপকথার দিকে চেয়ে বলল,
“ইজ সি...?”
“ইয়েস, ইউর চাইল্ড রূশি!”
শিশির প্রশ্ন শেষ করার আগেই উত্তর দিলো রূপকথা। শিশির হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল রূশির সামনে। রূশি তার বাবাকে চিনলেও তার বাবা এই প্রথম তার সন্তানের অস্তিত্ব টের পেলো। শিশির আর কিছু ভাবতে পাচ্ছে না। সে তার রূশি সোনাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল।
রূপকথা পিছনে সরে আসলো। এখানে তার কোনো হস্তক্ষেপ দরকার নেই। মেয়ে বাবা চার বছর পর প্রথম বারের জন্য একে অপরকে দেখলো। একে অপরের ভালোবাসায় মিশে যাক দুজন!
___
শিশির রূশি অনেক একে অপরের সাথে কথা বলল। শিশির খেয়াল করল রূশি তার সম্পর্কে সব কিছু জানে। রূশি তার দাদীর সম্পর্কেও সব জানে। বিষয়টি জেনে শিশির রূপকথার দিকে আড়চোখে তাকায়। রূপকথা ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে।
“রূশি মা আমার, তুমি একটু বাইরে যাও, তোমার মায়ের সাথে আমার একটু কথা আছে!”
“ওত্তে পাপা..আমি বাইরে যাচ্ছি। বাই পাপা,,বাই ম্যাম্মা…।”
শিশিরের কোল থেকে নামতে নামতে বিদায় নিলো। রূপকথা মেয়ের কাছে যেয়ে মাথায় আদরে বলল,
“বড়ো নানুর কাছে যেয়ে খেলা করো। আমি আসছি।”
রূশি মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। রূশি চলে যেতেই শিশির রূপকথার হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে নিলো। প্রবল বেগে রূপকথার দুই হাত পিছনে আবদ্ধ করে দেওয়ালের সাথে ঠেসে ধরল। দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকতেই রূপকথা নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসলো। শিশির তার ডান হাত রূপকথার গলার কাছে নিয়ে আলতো ভাবে চেপে ধরল। রূপকথা ঢোক গিলে শিশির চোখে চোখ রাখে।
শিশির তার মুখটা রূপকথার ঠোঁটের একদম নাগালে আনলো। রূপকথার শরীর অবশ হয়ে আসছে। চার বছর পর স্বামীর এমন তীক্ষ্ণ ছোঁয়ায়! শিশিরের গরম নিঃশ্বাস রূপকথার বুকের উপর আছড়ে পড়ছে। রূপকথা ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে।
শিশির রূপকথার গোলাপী চিকন ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিশিয়ে দিলো। সাথে চলতে শুরু করল তার হাত। স্বভাবত রূপকথার সারা অঙ্গে শিশির তার অস্তিত্ব ফেলছে। রূপকথার নড়ার মতো শক্তিটুকু নায়। সে শুধু শিশিরের ঠোঁটের অনুভূতি নিচ্ছে....
কিছুক্ষণ একই ভাবে ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে রেখে শিশির রূপকথার গলায় কাছে মুখ নামিয়ে আনলো। শিশির বুঝছে পাচ্ছে রূপকথা কাঁপছে কিন্তু তাতে মাথা না ঘামিয়ে রূপকথার গলায় কামড় বসিয়ে দেয়, ব্যাথায় রূপকথা শব্দ করে উঠে। তীব্র যন্ত্রণায় চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসতে চাইলো।
“হ্যাপি এনিভার্সারি সোনা!”
“হুম!”
চলবে....
রুদ্রিকা বেদী - Rudrika Bedi