17/09/2025
#অজান্তে_ভালোবেসেছি_তোকে
#রুদ্রিকা_বেদী
#পর্ব_৩৩
আজকে আবহাওয়া হঠাৎই খারাপ হয়ে উঠেছে। শান্ত পরিবেশ কেমন অশান্ত ভঙ্গিতে তান্ডব লীলা চালাচ্ছে বাইরে। আচ্ছা প্রকৃতি কি মানুষের মন পড়তে পারে? সত্যি পারে? হয়তো, নাহলে তারা কাঁদে কেন? কারো কষ্টে আবার কারো বিদায় বেলাতে! রূপকথার দাদী বলেছিল,যে বা যারা প্রকৃতিকে আপন করে নিতে পারে, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়, প্রকৃতিও তাকে নিজের করে নেই, ঠিক তার মায়ের মতো। এই জন্যই হয়তো তার বিদায়ের সময় পুরো প্রকৃতি কাঙাল হয়ে উঠেছিল, নিজের একজনকে হারিয়ে ফেলার শোকে! পৃথিবীতে রূপকথার মায়ের মতো এমন ব্যক্তি খুব কমই আসে....
রূপকথা শিশিরের দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। হাত কেটে রক্ত বেরোচ্ছে, তাতে শিশিরের বিন্দু মাত্র ভ্রু ক্ষেপ আছে বলে মনে হচ্ছে না। জানালায় বারংবার আওয়াজ হচ্ছে। রূপকথা শিশিরের হাতটা কাঁপা হস্তে ধরল। নিজের দিকে টেনে নিতে মুহুর্তের জন্য চোখ কুঁচকে আসলো তার। কী বিভৎস!
“এই দিকে আসুন!”
বলে শিশিরকে সোফার কাছে নিয়ে গেলো। রূপকথার হাত কাঁপছে। স্বামীর হাতের রক্ত যেন তার শরীরের শিহরণ বয়ে দিচ্ছে। সে জ্বলজ্বল চোখে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এখানে বসুন! আমি আপনার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি!”
“লাগবে না রূপকথা! আমি ঠিক আছি!”
শিশির এগিয়ে আসলো একদম। রূপকথার চোখের জল মুছে দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। নিজের ক্ষত সৃষ্ট স্থানে নজর দিয়ে শিশির মুচকি হেসে বলল,
“এর থেকেও ভয়ঙ্কর ক্ষত আমার জীবনে আছে সোনা! এর জন্য এতো চিন্তা করো না! আমি নিজে ব্যান্ডেজ করে নিবো!”
“কিন্তু, আপনার হাতে তো কাঁচ ঢুকে গেছে! আপনি একা পারবেন না!”
“আমি পারবো! টেনশন নিয়েও না।”
বলে রূপকথাকে একপ্রকার জোর করিয়ে সোফায় বসালো। হাতের রক্ত হাত বেয়ে মেঝেতে পরেছে। রূপকথার করুণ দৃষ্টিতে সেই দিকে চেয়ে রইল। শিশির গেলো ব্যান্ডেজ করার সরঞ্জাম আনতে।
_______
শিশির প্রথমে কোনো ভাবে নিজের হাত থেকে কাঁচের টুকরোটা বের করে আনলো। কাঁচের টুকরোটা বের করতেই অঝোরে রক্ত পড়া আবার শুরু হলো। রূপকথা শিশিরের পাশেই বসে ছিল। সেই দৃশ্য চোখের সামনে ফুটে উঠতেই রূপকথা অস্ফুট স্বরে চিৎকার করে উঠলো।
“আমি তোমাকে বারণ করেছিলাম দেখতে! আমি জানি তুমি এই দৃশ্য সহ্য করতে পারবে না!”
শিশির রূপকথার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কঠিন কন্ঠে কথাগুলো বলল। রূপকথা ততক্ষনে দুই হাত চোখের সামনে চাপা দিয়েছে। শিশিরের কন্ঠে রূপকথা ধীরে ধীরে চোখ থেকে হাত সরিয়ে, বাচ্চাদের মতো করে তাকিয়ে থেকে বলল,
“কতো রক্ত বেরোচ্ছে, আপনি দেখুন! ভয় তো যে কারো লাগবে! আপনি তাড়াতাড়ি ব্যান্ডেজ করুন!”
“কার কি হয়েছে!!??”
রূপকথা কথা শেষ করতেই হঠাৎ দরজার কাচ থেকে শারমিন আহসানের কন্ঠ স্বর ভেসে আসলো। রূপকথা আর শিশির দুজনে একসঙ্গে দরজার দিকে তাকালো। ঘরের দরজা খোলায় ছিল, সেখানে কখন শারমিন আহসান এসে দাঁড়িয়েছে তারা খেয়াল করেনি। শারমিন আহসানের কপালে ভাঁজ। তিনি দ্রুত এগিয়ে আসলেন ছেলের কাছে।
“ওমা! কাটলো কি ভাবে?”
তিনি প্রায় চেঁচিয়ে উঠে ছেলের হাত ধরলেন।
“কি হলো বল! কিভাবে কাটলো?”
ছেলের পাশে বসতে বসতে তিনি চিন্তিত স্বরে আবারও একই প্রশ্ন করলেন। শিশির লম্বা একটা শ্ব নিতে বলল তার মাকে। শারমিন আহসানকে হয়তো পুরো কথা বলতে চাচ্ছিল না শিশির,এই জন্যই সে মায়ের চোখের দিকে না তাকিয়েই বলল,
“কিছু না মা! হঠাৎ করে কাঁচের গ্লাসটা ভেঙ্গে গেলো, সেটার থেকে এই ক্ষত!”
শারমিন আহসান ছেলেকে আদৌও বিশ্বাস করলেন কিনা সন্দেহ তবুও সে বেশি কথা বাড়ালো না। চুপ করে ছেলের হাত স্বযত্নে নিজের কোলের উপর রেখে তাতে ব্যান্ডেজ করতে শুরু করল।
রূপকথা পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলো তার শ্বাশুড়ি মা কিভাবে ব্যান্ডেজ করছে। সত্যি কথা বলতে সে নিজে জানে না ব্যান্ডেজ কিভাবে করতে হয়। তাই শিশির যখন তাকে ব্যান্ডেজ করতে বারণ করল তখন সে জোড় দিয়ে তা খন্ডন করতে পারলো না। এখন সে মনোযোগ দিয়ে যথাযথ ভাবে ব্যান্ডেজ কিভাবে করতে হয় সেটা শিখছে। যতটা মনে তাকে এই আরকি.....!
_________
শিশিরের হাতের ব্যান্ডেজ করা শেষ হলো সবেমাত্র। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির কারণে পরিবেশটা হঠাৎ করে ঠান্ডা হয়ে উঠেছে।
শারমিন আহসান ব্যান্ডেজ করা শেষ করেই একটা বলল দুজনকে,
“তোদের একটা কথা বলতে এসেছিলাম! তোদের খালামণি বেরিয়ে গেছে!”
“ভালো হয়েছে, নাহলে আমি নিজেই করে দিতাম!”
রূপকথা নিজের মধ্যে থেকে অবাক সূচক অনুভূতিও বের করার সময় পেলো না,তার আগেই বজ্র কন্ঠে তার স্বামী চোয়াল শক্ত করে কথাগুলো বলল। রূপকথা ভ্রু কুঁচকে শিশিরের দিকে তাকালো তবে কিছু বলার সাহস পেলো না। যার জন্য একটু আগে এতো কিছু হয়ে গেলো, তাদের সম্পর্কের শক্ত স্তম্ভটা একটু হলে যার জন্য নড়ে যাচ্ছিল, যার জন্য তার স্বামী প্রথমবারের মতো তাকে একপ্রকার গলা উঁচু করে কথা বলল,তার হয় কথা বলা এক প্রকার বোকামি। এই ধরনের বোকামি করার মতো এতটাও অবুঝ রূপকথা নয়। সে একটি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইল।
“যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন আর রাগ করে থাকিস না বাবা! দুজন নিচে আয়, আমি ডিনার সার্ফ করতে বলেছি সোফিয়াকে!”
বলে ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন শারমিন আহসান।
“হুম! আসছি!”
শারমিন আহসান উঠে দাঁড়ালেন। রূপকথার কাছে এসে তার মাথায় হাত রাখলো। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না কেউ। একে অপরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শারমিন আহসান নম্র স্বরে বলল,
“আই এ্যাম সরি মা! আজকে যা হলো তা মনে নিস না!”
“আপনি এসব কি বলছেন মা! আমি মনে কেন নিতে যাবো! আমি বুঝেছি, আপনি কষ্ট পাবেন না!”
রূপকথা কথাগুলো বলেই শারমিন আহসানকে জড়িয়ে ধরল। শারমিন আহসান রূপকথার জন্য আরেকটি আশ্রয়ের জায়গায়। শারমিন আহসান তার জীবনে আসার পর থেকে কখনো মায়ের কষ্টটা আগের মতো অনুভব করতে হয়নি তার। আগলে রেখেছে নিজের মেয়ের মতো। শিশিরকে যতটা ভালোবাসে ঠিক ততটাই রূপকথাকে ভালোবাসা দিয়েছে। সেই মানুষটি ক্ষমা চাইল, এই কথা ভাবতেই রূপকথার হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠলো। যেখানে কি না তার কোনো দোষই নেই!
__________
শারমিন আহসান চলে গেছেন একটু আগে। ঘরে শীতল পরিবেশ। বাইরে বৃষ্টি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। রূপকথা আর শিশির দুজনেই চুপ করে আছে। রূপকথা কিছু জিগ্গেস করবে কিন্তু ইতস্তত কাজ করছে তার মধ্যে। শিশির সোফায় আগের মতোই বসে আছে। রূপকথা তার সামনে দাঁড়ানো।
“কিছু বলবে?”
হঠাৎ শিশির রূপকথার হাত চেপে ধরল। ধরে মাটির দিকে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল শিশির। রূপকথা প্রথমে চমকে উঠলেও পরবর্তীতে নিজেকে সামলিয়ে বলল,
“এখন হাতের ব্যাথা কেমন আছে আপনার?”
শিশির উঠে দাঁড়ালো। রূপকথার কোমর জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। সে রূপকথার ঘারের কাছে মুখ নিয়ে তাতে আস্তে করে চুমু খেলো।
রূপকথা খপ করে শিশিরের শার্ট খামচে ধরল, শিশিরের কাছ থেকে এমন প্রতিক্রিয়া সে আশা করেনি। শিশির কাঁধে মাথা রেখে গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
“এখন আগের থেকে ভালো সোনা! চিন্তা করতে হবে না!”
“আপনি কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছেন?”
“না! আমি কখনোই তোমার উপর রাগ করে ছিলাম না সোনা! এর আগে যেটা হলো সেটা আমি নিজের উপর রাগ করেই করেছি!”
“আর এমনটা করবেন না! বুঝেছেন আপনি! আর এমনটা করবেন! রাগ হলে দরকার পরলে আমাকে থাপ্পর মারবেন কিন্তু নিজের ক্ষতি করবেন না!”
শিশির সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ভ্রু জোড়া কুঁচকে এসেছে তার। রূপকথার দিকে তাকাতে দেখলো, সে কাঁদছে, নিঃশব্দের কান্না। শিশির মুচকি এসে রূপকথার চোখের জল মুছে দিয়ে হাস্কি স্বরে বলল,
“এই চোখের জল দেখলে রাগ এমনিতেও কমে যাবে, থাপ্পড় মারার আর প্রয়োজনই পরবে না আর আই এ্যাম আ গুড হাসবেন্ড! থাপ্পড় মারতে বলে আমাকে শয়তান বানিয়ে দিয়েও না সোনা!”
রূপকথা শিশিরের বলার কায়দা দেখে হেসে ফেলল। শিশির তাকে আবারও নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল। তবে সে রূপকথার মতো হাসতে পারলো না। আজ কেমন যেন লাগছে তার? মনে হচ্ছে সামনে কিছু হতে চলেছে, এমন অনুভূতি ঠিক পাঁচ বছর আগে একবার হয়েছিল,আর তখন সে তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান একজন হারিয়ে ছিল, আবার কি তেমন কিছু হতে চলেছে?
চলবে........
রুদ্রিকা বেদী - Rudrika Bedi