
27/07/2025
#অজান্তে_ভালোবেসেছি_তোকে
#রুদ্রিকা_বেদী
#পর্ব_১২
,
,
,
গাড়ি এসে থেমেছে আহসান মহলের সামনে। রূপকথা শিশিরের দিকে তাকিয়ে লজ্জা মাখা মুখটা নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো। সে দৌড়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল। শিশির সেই দিকে চেয়ে মুচকি হাসে। সেও সিটবেল্ট খুলে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। আজকের পরিবেশটা ভারি সুন্দর। আকাশে ঝলমলে রোদ হওয়ার সত্তেও আজ যেন রোদ গায়ে লাগছে না। তার সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস বয়ে চলেছে। এমন পরিবেশ দেখতে পাওয়া এখন বড়োই দুর্লভ!
শিশির বাড়িতে প্রবেশ করল। সে লিভিং রুমে যেতেই দেখলো রূপকথা দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখের উজ্জ্বল ভাবটা হারিয়ে গেছে। তার সামনে শারমিন আহসান খুশি খুশি মনে কি সব বলছেন। শিশির এগিয়ে গেলো। রূপকথার পাশে দাঁড়ালো। শিশিরকে দেখে শারমিন আহসান ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। সে উঠে দাঁড়ালেন। ছেলেকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
--“তুইও চলে এসেছিস! সূর্য দেখছি সত্যিই এখন পশ্চিম দিক দিয়ে উঠা শুরু করবে!”
বলে হো হো করে হেসে উঠলেন। শিশির কোনো জবাব দিলো না। সে রূপকথার দিকে একবার চাইলো। তার দৃষ্টি মেঝেতে। মুখের চাহনি শিশিরের কাছে ভালো ঠেকলো না।
--“তার ভালোই করেছিস! তুই না আসলে তোকে কলই করতাম!”
শিশির মায়ের দিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
--“কেন?”
--“বেয়ান ফোন করেছিলেন! তোদের আজ রাতে ওনাদের ওখানে ডিনারে ডেকেছেন!”
শিশিরের মুঠো শক্ত হয়ে উঠলো। সে এতোক্ষণে বুঝলো রূপকথার শূন্য চাহনির রহস্য। সে মায়ের দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
--“আমরা যাবো না!”
শিশিরের মুখে না শব্দটি শুনতে শারমিন আহসানের হাসি গায়ের হয়ে গেলো। সে ভ্রু কুঁচকে ছেলের দিকে তাকালো। তারপর বলল,
--“কিন্তু বাবু, আমি তো বলে দিয়েছি যে তোর আজ রাতে ওখানে যাবি!”
মায়ের কথায় শিশিরের চাহনিতে কোনো ভাবান্তর হলো না,সে যেমনটা আগে চেয়ে ছিল ঠিক তেমনি এখনো চেয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টি শান্ত,তবে কঠোরতাও দেখা যায়। শিশির মায়ের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রূপকথা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
--“মা আপনি চিন্তা করবেন না! আমরা আজ রাতে যাবো!”
শিশির বিস্ফারিত চোখে রূপকথার দিকে চাইল। রূপকথা শিশিরের দিকে তাকিয়ে তাকে শান্ত হতে বলল, তার পর সে শারমিন আহসানের দিকে চেয়ে বলল,
--“মা আমি উপরে যাচ্ছি! ফ্রেশ হতে।”
--“আচ্ছা মা যাও!”
রূপকথা পাথরের মতো উপরে চলে গেলো। শারমিন আহসান যেন কিছু আন্দাজ করতে পারছেন। তিনি এগিয়ে গেলেন ছেলের কাছে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চিন্তিত স্বরে বললেন,
--“কিছু কি হয়েছে?”
--“অনেক কিছু হয়েছে মা,তবে তোমাকে পরে সব খুলে বলবো।”
বলে সেও উপরে চলে গেলো। শারমিন আহসান চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে। একদিকে তার মাথায় বিভিন্ন চিন্তা অন্য দিকে ছেলের এমন পরিবর্তন দেখে তার আনন্দ লাগছে। চোখের কোণে হালকা জল দেখা দিলো তার.......
___
--“তুমি রাজি কেন হলে যেতে!”
ঘরে ঢুকতেই শিশির গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করল, খাটে চুপচাপ বসে থাকা রূপকথার উদ্দেশ্যে। রূপকথা চোখ তুলে তাকায়। তার চোখের বিষন্নতা। তারপরও সে হাসে। উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে আসে শিশিরের কাছে। মাথা নিচু করে বলে,
--“মা যেহেতু হ্যাঁ বলে দিয়েছেন, সুতরাং আমাদের ওখানে যাওয়া উচিত! যদি না যায় তাহলে মায়ের কথার অপমান করা হবে!”
--“কারা করবে? মিস্টার চৌধুরী,তাতে আমার বিন্দুমাত্র যায় আসে না রূপকথা!”
--“কিন্তু আমার আসে! আমার শাশুড়ির অপমান বা আমার বরের কেউ অপমান করলে সেটা আমার অপমান হবে! আপনাদের সম্মান মানে আমার সম্মান! আমি চাই না, আমার জন্য সেটা নষ্ট হোক!”
রূপকথা প্রতিবাদ যেন শিশিরকে কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ করে দিয়ে গেলো। সে অপলক চোখে চেয়ে রইল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রূপবতী নারীটির দিকে! সে শুধু দেখতেই সুন্দর নয় তার চিন্তাধারা, তারই মত উচ্চ এবং সুন্দর। এমন দৃঢ়তা আগে কখনো রূপকথার মুখ থেকে শুনেনি শিশির। সে আর কোনো কথা বলল না। এমন কথার উপর প্রতিবাদ করা মানায় না শিশিরের। সে মুচকি হেসে রূপকথার চুপসে আসা মুখটা নিজের দুই হাতের তালুতে। মুখ এগিয়ে এনে রূপকথার চোখে চোখ রাখে। এখন কোনো কথা নয়। সবই যেন চোখে চোখ আদান প্রদান হচ্ছে।
বেশ অনেকক্ষণ একে অপরের গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তারপর শিশির রূপকথার কপালে গাঢ় চুম্বন আঁকল। রূপকথার চুল কানের কাছে গুঁজে দিয়ে বলল,
--“ঠিক আছে! তুমি রেডি হয়ে নিও!”
রূপকথা হাসার চেষ্টা করে। তবে তার মন হাসতে পারল না। মুখে যেতে বললেও,তার মন যেন বিন্দু মাত্র সায় দিচ্ছে না। কিন্তু এখন কিছু করার নেই। যেতে তো হবেই.........
___
আশরাফ চৌধুরী লিভিং রুম দিয়ে পায়চারি করছে। কপালে তার চিন্তার ভাঁজ। বারংবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। সবে মাত্র সন্ধ্যা, ঘড়িতে ছয়টা পঁয়তাল্লিশ বাজে। এখনো আরো এক ঘন্টা।
সোনিয়া চৌধুরী রান্না ঘরে তদারকি করছেন। আজ সবকিছু শিশিরের পছন্দের তৈরি হচ্ছে। রান্নায় কোনো ধরণের সমস্যা না হয় তাই সবই চোখের সামনে তৈরি করার অডার। সোনিয়া চৌধুরী কিচেন তদারকি করলেও তার চোখ সামনে আশরাফ চৌধুরীর দিকে। ওপেন কিচেন থেকে স্বামীকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
সোনিয়া চৌধুরী কিচেনে কাজ করা সকল চাকরদের সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসলেন কিচেন থেকে। স্বামীর দিকে এগিয়ে গেলেন। আশরাফ চৌধুরী তখনও হাঁটছেন। সোনিয়া চৌধুরী বরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আশরাফ চৌধুরীকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিলেন, তারপর বললেন,
--“এখানে চুপ করে বসো। কখন থেকে দেখছি এখান থেকে সেখানে করছো! এতো চিন্তা করলে তো বিপি হায় হয়ে উঠবে!”
--“তুমি বুঝবে না সোনিয়া! শিশিরকে বোঝাতে না পারলে আমাদের বিজনেস ডুবে যাবে! ভেবেছিলাম রূপকথার বিয়ে শিশিরের সাথে হলে আমাদের বিজনেসে সুবিধা হবে , সব প্রজেক্ট কোনো চিন্তা ছাড়াই আমাদের হয়ে যাবে বাট এখন এই মেয়েটার জন্য সব শেষ! অপয়া কোথাকার! সব কিছু শেষ করে দেয়। জন্মের সময় যদি মরে যেতো?”।
আশরাফ চৌধুরী গর্জে উঠলেন। সোনিয়া চৌধুরী আশরাফ চৌধুরীকে শান্ত করতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আর বললেন,
--“উফ্! থামো। বাচ্চা মেয়ে ভুল হয়ে গেছে। তাই নিয়ে এমন ভাবে বলতে হয়। যাইহোক শিশির তো আসছে। আমি রূপকথাকে সরিয়ে নিয়ে যাবো তখন তুমি শিশিরকে বুজিয়ে বলো!“
--“তাই করতে হবে!”
আশরাফ চৌধুরী মাথা নাড়ালেন। সোনিয়া চৌধুরী বরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আশরাফ চৌধুরীর চোখের অগোচরে সোনিয়া চৌধুরীর মুখে বিজয়ের হাসি ফুটে উঠল.....
___
শিশির লিভিং রুমে তৈরি হয়ে বসে আছে। হাতে তার ফোন। কোনো দরকারি ফাইল দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সে মূলত রূপকথার জন্য অপেক্ষা করছে। রূপকথা তৈরি হয়ে আসলেই তারা বেড়িয়ে পড়বে। ।।
পাঁচ মিনিট পর, শিশিরের কানে পায়ের শব্দ ভেসে আসলো। রূপকথার পায়ের পায়েলের শব্দ। শিশির ফোন থুয়েই সিঁড়ির দিকে তাকালো। রূপকথা নামছে। মেরুন রঙের কাতান শাড়ি পরেছে। আঁচল ছেড়ে দেওয়া। রূপকথার লম্বা ওয়েভি চুলগুলো সুন্দর করে চিরনি করে ছেড়ে দেওয়া। কানে সোনোর দুল। গলায় হার। সব দেখে রূপকথার মুখের দিকে চোখ যেতেই যেন থমকে গেল শিশির। গাঢ় করে কাজল দুই চোখে, নাকে নথ, ঠোঁটে গাঢ় খয়েরী লিপস্টিক। ফর্সা বর্ণের এই মুখ যে দেখবে সে আর চোখ সরিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য রাখবে না।
শিশির এগিয়ে গেলো সিঁড়ির সামনে। রূপকথার দিকে তার হাত এগিয়ে দিলো। রূপকথা লজ্জা লাল হয়ে উঠে। সে হাত এগিয়ে শিশিরের হাতের উপর রাখে। রূপকথা ধীরে ধীরে নিচে নেমে শিশিরের কাছে এসে দাঁড়ায়। শিশির তার চোখ সরাতে পারছে না। রূপকথার গালে ছুঁয়ে দিয়ে বলে,
--“আজকের যাওয়াটা কি কোনোভাবে ক্যানসেল করা যাবে না? আজকের রাত আমি শুধু তোমাকে দেখতে চাচ্ছি!”
রূপকথা লাজুক ভঙ্গিতে হাসে। তারপর নরম স্বরে বলে,
--“অন্য কোনোদিন দেখে নিবেন, আজ থাক!”
--“এতো সুন্দর কেন তুমি?”
শিশিরের প্রশ্নে সে হাসে কোনো জবাব দেয় না। তার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে।
--“আমার পছন্দের বউ! সুন্দর হবে না?”
হঠাৎ পিছন থেকে একটা আওয়াজ আসতেই রূপকথা দূরে সরে দাঁড়ায়। তার শাশুড়ি মায়ের গলা। শিশির পিছনে ফিরে তাকায়। রূপকথা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শারমিন আহসান তাদের থেকে হালকা দূরে দাঁড়িয়ে মিট মিট করে হাসছেন। শিশির কি বলবে বুঝতে পারল না। রূপকথার দিকে তাকালো,সে তো লজ্জায় মাথায় তুলতে পারছে না। এমন অবস্থায় কিছু বলা মানে মেয়েটাকে আরো বেশি লজ্জিত করা, শিশির দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেলো শারমিন আহসানের দিকে। মায়ের দুহাত ধরে বলল,
--“থ্যাংকিউ মা! এতো সুন্দর একটা বৌমা নিজের জন্য খুঁজে আনার জন্য!”
--“শুধু কি নিজের জন্য? তোমার জন্য বুঝি আনেনি!”
শারমিন আহসান মুখ ফুলিয়ে বললেন। তার কথার ধরন শুনে রূপকথাও হেসে ফেলল। শিশির মাকে জড়িয়ে ধরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
--“মা দেরি হয়ে যাচ্ছে, এখন বেড়োই!”
--“হ্যাঁ হ্যাঁ! তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পর। সাবধানে যাবি!”
বলে রূপকথার দিকে তাকালো। রূপকথা এগিয়ে এসেছে। শারমিন আহসান বৌমার মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
--“সাবধানে যা!”
রূপকথা শাশুড়ি মায়ের কথায় মাথা নাড়ালো। শিশির আর রূপকথা শারমিন আহসানকে সালাম জানিয়ে বেরিয়ে গেলো।
শিশির আর রূপকথা বাইরে আসতেই হঠাৎ রূপকথার পা হোঁচট খেলো। শিশির পাশে থাকায় রক্ষে হলো। সে রূপকথাকে নিজের বাহুতে আঁকড়ে ধরল। সাবধানে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে,
--“ঠিক আছো তুমি?”
রূপকথা কোনো জবাব দিলো না। তার মন হঠাৎ কু ডেকে উঠলো। তার পা আর এগিয়ে যেতে চাইলো না। সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কোনো বিপদের আশংকা সে যেঞ পারছে.....
চলবে..........
কিছু কথা,
অনেকেই জিজ্ঞেস করছেন কেন এতো দেরি করে গল্প দিচ্ছি? ২১ তারিখেও আমি গল্প দিয়েছি, কিন্তু তারপর সারা বাংলাদেশে যে শোকের ছায়া ঘুনিয়ে এলো, তারপর আর লেখা তো দূরের কথা ফেসবুকেই আসতে ইচ্ছে করছিল না। নিজেকে একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে বের করে নিয়ে এসেছি, তাই আবার লেখা শুরু করেছি, আশা করি এখন থেকে প্রত্যেক দিন গল্প দিবো
রুদ্রিকা বেদী - Rudrika Bedi