09/06/2022
কৃষিই ছিল বাংলার আদি পেশা। এ অঞ্চলের মাটি, পানি তথা জলবায়ু ছিল কৃষির জন্য আদর্শ হিমালয়ের অববাহিকায় ভাটি অঞ্চলে বাংলার অবস্থান বিধায় অধিকাংশ নদী বাংলার উপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। চীন, তিব্বত, নেপাল, ভুটান এবং ভারতের সীমানায় অবস্থিত হিমালয় পর্বতমালার অসংখ্য হিমবাহের গলিত রূপ নদ ও নদীরূপে বাংলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এ অঞ্চলকে করেছে সুজলা, শ্যামলা ও নদীমাতৃক। জীবন ও জীবিকাকে করেছে সহজ-সরল। মানুষকে করেছে কোমল। সংস্কৃতিকে করেছে বহুমাত্রিক। খাদ্যাভ্যাসও ছিল স্বতন্ত্র।
ফসল উৎপাদনের ধরন ছিল বহুমুখী। প্রতিটি কৃষি পরিবার তার প্রয়োজনের প্রায় সব শস্য ও মসলা উৎপাদন করত। সে সময়ে গম, কাউন, মটরশুঁটি, ডাল (মুগ, মসুর, মাসকালাই), ধনিয়া, পেঁয়াজ, রসুন, গোলআলু, মিষ্টি আলু প্রভৃতি ফসল উৎপাদন হতো। পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় সবজি চাষ মূলত বাড়ির আশপাশে, ঘরের আঙ্গিনায়, ঘরের চালে মহিলারাই উৎপাদন করত। মাচা দিয়ে লাউ, বাঁশের কঞ্চিতে শিম আর ঘরের চালের উপর পাটখড়ির মাচায় চালকুমড়া ও মিষ্টি কুমড়ার চাষ হতো। বাড়ির উঠানের এক পাশে ডাঁটা, ঢেঁড়স ও অন্যান্য শাক উৎপাদিত হতো। টমেটো, মুলা, ধনিয়া পাতা বাড়ির আশেপাশে বিদ্যমান ছোট জমিতে চাষ হতো। আর বড় বড় জমিতে ধান, পাট, গমসহ প্রয়োজনীয় ফসল উৎপাদন করা হতো। সে সময়কার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে মহিলাদের কাজকর্ম বাড়ির ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। অপরদিকে পুরুষেরা নিয়োজিত ছিল মাঠের কাজে, ফসল উৎপাদনে এবং অযান্ত্রিক পানি সেচে, খাদ্যশস্য পরিবহণ ও বাজারজাতকরণে। সত্তরের দশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া কৃষিতে লাগেনি। তাই কৃষির সাথে সম্পর্কিত সকল কাজ, মূলত কায়িক শ্রম এবং গবাদিপশুর উপরই নির্ভর করতে হতো। জমি তৈরির একমাত্র অবলম্বন যাদের গরু কমছিল তারা অন্যান্য পরিবারের সাথে একত্র হয়ে সকলের গরু ও জোয়াল একত্র করে পালাক্রমে একে অপরের জমি তৈরি করত। সে সময়ে জমি চাষ ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনার জন্য লাঙ্গল, জোয়াল, মই, আঁচড়া, কাঁচি, নিড়ানি পাতলা (রোদ ও বৃষ্টি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মাথায় দেওয়ার উপকরণ) প্রভৃতি ব্যবহার করা হতো এবং খাল-বিল, পুকুর ও ডোবা হতে সেচের পানি জমিতে দেয়ার জন্য কাঠের তৈরি দোরণ এবং বাঁশের তৈরি ওড়া ব্যবহৃত হতো।
গ্রামীণ সমাজে কৃষিসহ প্রায় সকল কাজই শুরু হতো সেই ভোর হতে এবং চলতো সকাল ৮-৯ ঘটিকা পর্যন্ত । এর পর সকালের খাবার এবং কিছুটা সময় বিশ্রাম নিত। সকালের খাবারে রাতের রান্না করা শুকনো/ পানি দেওয়া পান্তা ভাত এবং তার সাথে শুঁটকি ও অন্যান্য সবজি, ভর্তা, ভাজি ইত্যাদি থাকত।
ভোরে কাজ শুরু মূল লক্ষ্যই ছিল রোদ্রের প্রখরতা গায়ে লাগার আগেই যেন জমি তৈরির মতো পরিশ্রমের কাজ অনেকটা সম্পন্ন করা যায়। নাশতা ও বিশ্রামের পরে আবার কৃষকেরা মাঠে নেমে পড়তেন এবং চলতো দুপুর অবধি। একান্ত প্রয়োজন না হলে কৃষকদেরকে (বদলি) দুপুরের খাবারের জন্য বাড়িতে আনা হতো না। তাদের দুপুরের খাবার মাঠেই পৌঁছে দেওয়া হতো। যাতে করে সময়ের অপচয় না ঘটে এবং অধিক কাজ করা সম্ভব হয়। জমি তৈরি, ফসল উৎপাদন, কাটা, বাড়িতে আনা, শস্যের স্তূপ (গাদা), মাড়াই, সিদ্ধ, শুকানো, ঢেঁকিতে ছাঁটাই করে মটকা (মাটির বড় পাত্র), ডোল এবং গোলায় (পাটখড়ি বা বাঁশ দ্বারা নির্মিত) শস্য রাখা হতো। এ কাজগুলো মূলত পুরুষেরা করলেও ধান সিদ্ধ, শুকানো ও ঢেঁকিতে ভাঙ্গার কাজে মহিলারাই অংশগ্রহণ করত। গ্রামের কৃষকেরা সাধারণত একত্র হয়ে পর্যায়ক্রমে অবস্থাপন্ন পরিবারের জমির ফসল মাঠ থেকে কেটে এনে দিত। একাজ সম্পন্ন হওয়ার পরে সচ্ছল পরিবারসমূহ পৃথক পৃথকভাবে পর্যায়ক্রমে কৃষকদের জন্য একবেলা ভালো খাবারের ব্যবস্থা করত। যা কৃষকদের মাঝে আনন্দ ঘন ও উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করত। ধান কাটা শেষ হলে খেয়াঘাটের মাঝি, নাপিত ও অন্যান্য গরিব ও নিম্নবর্ণের মানুষেরা তাদের সেবার বিনিময়স্বরূপ বার্ষিক মজুরি হিসেবে সচ্ছল পরিবার হতে ধান সংগ্রহ করত।
বাজার ছিল সপ্তাহে দুই দিন। মানুষের প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য সাপ্তাহিক বাজার ব্যতীত নিকটবর্তী তেমন কোন দোকান-পাট ছিল না। তবে প্রতিদিন সকালে উক্ত বাজারসমূহে সকালে তাজা মাছ, সবজি, দুধ ও অন্যান্য উপকরণ স্বল্প সময়ের জন্য স্বল্প পরিসরে ক্রয়-বিক্রয় হতো। সকালের এই সংক্ষিপ্ত বাজার ব্যবস্থাপনা ‘আড়ং’ হিসেবে প্রচলিত ছিল। সে সময় শিল্পের প্রসার ছিল না বললেই চলে। সরকারি চাকরিজীবীও গুটি কয়েক সরকারি ব্যাংকের মধ্যেই মূল অর্থনৈতিক কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল। সরকারি চাকরিজীবী ও ব্যাংকার ভিন্ন অন্যদের হাতে নগদ টাকা ছিল না বললেই চলে। তাই অধিকাংশ মানুষ তার উদ্বৃত্তপণ্য বাজারে বিক্রয় করে প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতো। সেসময়ে প্রাত্যহিক বাজারে প্রতিটি পরিবারের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ছিল লবণ ও কেরোসিন তেল। কারণ, এ দুটি পণ্য পারিবারিকভাবে উৎপাদনের সুযোগ ছিল না। তাই, রান্নার জন্য লবণ এবং প্রতিদিনের সাঁঝের আলোর জন্য কুপি ও হারিকেনে ব্যবহৃত হতো কেরোসিন তেল। কুপি ও হারিকেনের এ জ্বালানী সাশ্রয়ীর জন্য গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই সান্ধ্যকালীন কাজকর্ম, খাওয়া-দাওয়া, শিশুদের পড়াশোনা এবং এশার নামায আদায় করে দ্রæত ঘুমিয়ে পড়ত। চিনি ছিল না বললেই চলে, তবে আখের গুড়ের প্রাপ্যতা ছিল পর্যাপ্ত। খাবার তেল বলতে সরিষার তেল ছিল প্রথম স্থানে। তবে ক্ষেত্র বিশেষে তিলের তেল ও ব্যবহৃত হতো। এসবই ছিল বিশুদ্ধ। তেল ভাঙ্গানোর (তৈরি) জন্য কাঠের ঘানি ছিল; যা গরু দ্বারা চালানো হতো। ঘানি হতে উৎপাদিত তেল তেলবীজের মালিক পেতেন। অপর দিকে খৈল (তেল বের হওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকত) ঘানিওয়ালা পেত। এ বার্টার ব্যবস্থা মূলত নগদ টাকার স্বল্পতার কারণেই প্রচলিত ছিল।
বাজার ব্যবস্থাপনা ছিল পণ্য বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম। অনেকগুলো গ্রামের জন্য ছিল এক একটি বাজার। তাই প্রতিটি পরিবারকে হাট দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হতো এবং প্রয়োজনের তাগিদে পরিবারের কোন না কোন পুরুষ সদস্যকে হাটে যেতে হতো। পুরুষ সদস্য না থাকলে প্রতিবেশীর নিকট পণ্য আনার জন্য অনুরোধ করতে হতো। সে সময়ে বর্ষায় মাঠঘাট পানিতে টইট¤ু^র থাকত। রাস্তাঘাট ছিল না। নৌকাই ছিল একমাত্র বাহন। তাই বাড়ির সকল পরিবার মিলে এক বা একাধিক নৌকায় বাজারে যেত।
টাকার তারল্যতা কম থাকায় প্রায় সকলেই উদ্বৃত্ত শস্য বাজারে নিত আবার ক্রয়কৃত পণ্য নিয়ে বাড়ি ফিরত। এমনকি শ্রমিকের মজুরি দেওয়া হতো হাটে পণ্য বিক্রি করে। অনেক ক্ষেত্রে সবজি জাতীয় পণ্যের দাম খুব কম বা চাহিদা না থাকলে তা বাজারেই ফেলে আসতে হতো। এসব সবজির মধ্যে ছিল টমেটো, খিরা, মুলা ইত্যাদি। সবজির ওজন বেশি হওয়ায় বিক্রি না হলে বাজারে ফেলে আসা ছাড়া উপায় ছিল না।
বর্ষা মৌসুমে গ্রামের মাঠঘাট ছিল ধান ও পাটের সমারোহ। সেসময় পাটের চাহিদাও উৎপাদন ছিল ব্যাপক। অনুক‚ল পরিবেশ, বিশেষ করে স্বচ্ছ ও অথৈই পানি এবং সস্তা শ্রমিকের প্রাচুর্যের কারণে পাট উৎপাদন, কর্তন, জাগ দেওয়া, পাটখড়ি থেকে পাটকে পৃথককরণ, পাট ধোয়া এবং বাঁশের উপর পাট শুকানো ছিল গ্রামীণ বর্ষার অন্যতম চিত্র। সে সময়ে ধান ও পাট পৃথক জমিতে উৎপাদন করা হলেও কোন কোন কৃষক আউশ ধানের সাথে পাট একত্রে ফলাতেন। তৎকালীন সময়ে রাসায়নিক সারের প্রচলন ছিল না; তাই পাটের গোড়া জমিতে মিশে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পেত।