
19/07/2023
আমাদের বন্ধু তপন বড়ুয়া
""""""""""''"""""""
চার দশক আগের কথা। মাত্র ভর্তি হয়েছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। গাঁ গেরামের গন্ধ তখনো পোশাকে আচরণে কথায় কাজে। বাংলা বিভাগের সতীর্থদের উচ্ছ্বল আনন্দে কাটে সকাল সন্ধ্যা। এসময়ে পরিচয় ঘটে ক্যাম্পাস সংলগ্ন জোবরা গ্রামের তরুন তুর্কী কবি তপন বড়ুয়ার সাথে।
চবিতে পড়বার শুরুতেই মনে জাগে কবি হবার বাসনা। ভাবসাবও সেইরকম! কাধে ব্যাগ, আউলা চুল, এলোমেলো পায়ে হন্টন! মনে যা ই আসে তা ই লিখে ফেলি খাতায়। ভাবি এগুলোই হলো কবিতা। কিন্তু ছাপা হয়না কোথায়ও। আমরাও দমে যাবার পাত্র নই। জিন্নাহ, ইন্দিরা, বাবর, হাবিব, সাগর মিলে গড়ে তুলি নিম্নচাপ সাহিত্য গোষ্ঠী। দেওয়ালিকা, ভাঁজপত্র প্রকাশ করি। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই কবিতা নিয়ে। চবি ক্যাম্পাস থেকে প্রকাশ করি কবিতাপত্র "শতাব্দীর বিক্ষুব্ধ শব্দমালা।"
ঠিক এইসময় আমদের সাথে যোগ দেয় ঝাঁকড়া চুলের তরুন কবি তপন বড়ুয়া। কথায় লেখায় বারুদের স্ফুলিঙ্গ। প্রেম আর দ্রৌহের সম্মিলনে অনিন্দ্য কথামালার শিল্পীত নির্মাণ। আমরা মুগ্ধ হই তার কবিতায়, তার বাচনিক সৌকর্যে, বুকভরা আন্তরিকতায়। শ্যামলবরণ দিলখোলা তরুণটি কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের অন্তরে জায়গা করে নেয়।
তারপর চবি রেল স্টেশানে, বক্কর সওদাগরের চা দোকানে (এখনকার নাম মৌওর দোয়ান), কলা ভবনের জারুলতলায়, শাটল ট্রেনের দরোজায়, কাজির দেউড়ির স্টুডিওতে দিনের পর দিন আড্ডা দিয়েছি। সিঙ্গারা, চা সিগ্রেট উড়িয়েছি অজস্র। আমাদের প্রাণের সংগঠন বাংলাদেশ সাহিত্য পরিষদ, স্বরশ্রুতি, বোধন, সবকিছুতেই ছিল তাঁর আত্মিক সংযুক্তি। এভাবে কাটে তেত্রিশ বছর।
শেষের দিকে ঘটে ছন্দপতন। যোগাযোগের, আন্তরিকতার, সহমর্মিতার। আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি আপন কর্মক্ষেত্রে। তপনও গুটিয়ে নেয় নিজেকে অভিমানী জেদে। কিন্তু কবিতা ফটোগ্রাফি আবৃত্তি উপস্থাপনা আর সংগঠনপ্রীতিকে ত্যাগ করেনি কখনো। নিজের সাধ্যমত অবদান রেখেছে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষে। ডিসি হিলের বৈশাখী মেলা, আউটার স্টেডিয়ামের বিজয় মেলাকে নিয়েই শেষের সময়গুলোতে মগ্ন ছিল সে।
তারপর দিন যায়। পার হয় সময়। ডিসি হিলে থামে বাদ্য-বাজনা। সিআরবি শিরিষ তলায় জমে ওঠে নতুন আয়োজয়। শিল্পকলার চাকচিক্য বাড়ে। তপন বড়ুয়া থিতু হয় জোবরায়। শহুরে মানুষগুলোর সান্নিধ্য পারতপক্ষে এড়িয়ে চলে। মাটিগন্ধী জোবরায় আলোছায়ায় আত্মমগ্ন হয়। দূরাগত সুরের আবেশে একজন তপন বড়ুয়া ক্ষয়িষ্ণু সত্ত্বার নিকট সমর্পিত হয়।
অবশেষে ২০২২ সালের ৪ জুলাই আজকের দিনে আমরা তাঁকে চিরতরে হারিয়ে ফেলি।
আজ তপন বড়ুয়ার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।
সংগৃহীত :Azad Bulbul (ড. গাজী গোলাম মাওলা)