18/10/2025
মাদরাসা শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় পুলিশের দায়সারা বক্তব্য : ন্যায়বিচারের পথে একটি বিপজ্জনক উদাসীনতা
গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরে ১৩ বছর বয়সী এক মাদরাসা শিক্ষার্থীর ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে পুলিশের আনুষ্ঠানিক বক্তব্যটি শুধু অসংবেদনশীল নয়, বরং আইনগতভাবে বিভ্রান্তিকর ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। পুলিশ বলেছে, “মেয়েটির সঙ্গে অভিযুক্তের প্রেমের সম্পর্ক ছিল, সে পূর্বে দুইবার পালিয়ে গিয়েছিল এবং সর্বশেষ স্বেচ্ছায় ফিরে এসেছে।” এই বক্তব্যে দুটি গুরুতর সমস্যা রয়েছে। একটি আইনি, আরেকটি নৈতিক ও সামাজিক।
প্রথমত, বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) অনুযায়ী, ১৬ বছরের নিচে কোনো শিশুর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক তার সম্মতিতেও ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হয়। আইন অনুযায়ী ১৩ বছর বয়সী শিশুর 'সম্মতি' বলে কিছু নেই। অতএব, পুলিশের পক্ষ থেকে 'প্রেমের সম্পর্ক' কিংবা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে 'সম্মতিতে পালিয়ে যাওয়া' ধরনের ভাষা ব্যবহার করা আইনের অপব্যাখ্যা ও অপরাধের গুরুত্ব খাটো করার প্রচেষ্টা। এটি ভিকটিম-ব্লেমিংয়ের এক ধরনের কৌশল, এটি শিশুর মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করে এবং অপরাধীর পক্ষে অবচেতনে প্রশ্রয় সৃষ্টি করে।
দ্বিতীয়ত, পুলিশের বক্তব্যের ভাষা শুধু আইনি ভুল নয়, এতে একটি গভীর সামাজিক পক্ষপাত কাজ করছে। মাদরাসা শিক্ষার্থী হওয়ায় মেয়েটির প্রতি যে সংবেদনশীলতা থাকা দরকার ছিল, তা অনুপস্থিত। বরং 'প্রেমের সম্পর্ক' আখ্যা দিয়ে ঘটনাটিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই ধরনের মনোভাব কেবল মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সামাজিক নিরাপত্তা দুর্বল করে না, বরং গোটা আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করে।
তৃতীয়ত, মেয়েটির বাবা-মায়ের বক্তব্যে পুলিশের বিবরণ আংশিক বা বিকৃত বলেই প্রতীয়মান হয়। আমরা ভিকটিম পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, মেয়েটির আগে পালিয়ে যাওয়ার গল্প সম্পূর্ণ অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এটি ঘটনাটিকে গোপন করার একটি অংশ। তার উপর ঘটনাটির দুই মাস পর্যন্ত মামলা গ্রহণে গড়িমসি এবং ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। এটি পুলিশের প্রাথমিক দায়িত্ব লঙ্ঘন এবং কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৫৪ নং ধারা অনুযায়ী ভিকটিমের ন্যায্য অধিকার লঙ্ঘন।
চতুর্থত, পুলিশের বক্তব্যে ঘটনাটির মানসিক ও সামাজিক মাত্রাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। একজন নাবালিকা মেয়েকে আটকে রেখে একাধিক ব্যক্তি মানসিক ও শারীরিক টর্চার করা, জোরপূর্বক আটকে রাখা কিংবা ভয়ভীতি দেখানো—এসবই পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৩৪০ ও ৫০৬ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমনকি 'প্রেমের সম্পর্কের' দোহাই দিলেও এসব অপরাধের বৈধতা তৈরি হয় না। এ ধরনের দায়সারা বক্তব্য শুধু ভিকটিম পরিবারকে অপমান করে না, বরং পুলিশের নৈতিক দায়িত্ববোধ ও নিরপেক্ষ তদন্তের প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
একবার ভেবে দেখুন, ১৩ বছর বয়সী শিশু মেয়েকে ২ দিন আটকে রেখে হিন্দু যুবক যে পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে, যা ঘটনার ২ মাস পরেও সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ। এতেও কি ঘটনার পাশবিকতা উপলব্ধি করতে পারছেন না? এটি প্রেমের সম্পর্ক নাকি ফাঁদ?
মনে রাখা জরুরি, পুলিশ রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তাদের ভাষা, বয়ান ও আচরণ আদালতের আগেই ন্যায়বিচারের প্রথম মাপকাঠি। কিন্তু এখানে সেই দায়িত্বের জায়গায় দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের প্রতি অতি-সংবেদনশীলতা আর ভিকটিমের প্রতি অবহেলা।
সাধারণ আলেম সমাজ মনে করে, এই ঘটনার তদন্ত প্রক্রিয়া এখনই স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সময়সীমাবদ্ধ পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা জরুরি। কারণ এটা শুধু একটি মাদরাসা শিক্ষার্থীর ন্যায়বিচারের প্রশ্ন নয়, এটি রাষ্ট্রের আইনের প্রতি আস্থার প্রশ্ন। মাদরাসা শিক্ষার্থী হওয়া কোনো নাগরিককে আইনি সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত করার অজুহাত হতে পারে না।
পুলিশ প্রশাসনের এই ধরনের দায়সারা, গাফিলতিপূর্ণ ও অসংবেদনশীল বক্তব্য দেশের বিচারব্যবস্থা ও নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য গুরুতর হুমকি।
আমরা, সাধারণ আলেম সমাজ আটকে রেখে ধর্ষণের ঘটনাকে 'প্রেমের সম্পর্ক' আখ্যা দিয়ে ঘটনাটি শিথিল অপচেষ্টাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। সেই সাথে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে হিন্দু যুবক জয়কুমার দাস ও লোকনাথ চন্দ্রসহ পলাতক আসামীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার দাবি করি। আমরা ধর্ষণের ঘটনায় ১ বিন্দু ছাড় দিতে রাজি নই।
মাদরাসা শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে হিন্দু যুবক কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এটিকে কোনোভাবেই প্রেমের সম্পর্ক বলে দায় এড়ানো যায় না। যেখানে নারীবাদী ও সুশীল সমাজ বাল্যবিবাহকেই নাক সিঁটকানির চোখে দেখে, সেখানে এই ১৩ বছর বয়সী শিশু নির্যাতনের মতো সংবেদনশীল ঘটনাতে তাদের নীরব ভূমিকা তাদের দ্বিচারিতাকেই স্পষ্ট করে।
আমরা মনে করি, সেক্যুলার রাষ্ট্র কেবল ধর্মীয় সমাজকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করে না, বরং নতুন একটি সামাজিক শ্রেণি তৈরি করে। যেখানে তারা কখনও প্রান্তিক আবার কখনও অতিরিক্ত দৃশ্যমান। এই ঘটনায় অপরাধী যদি মাদরাসা পরিচয়ের হত, এতক্ষণে নারীবাদী ও সুশীলদের বিবৃতি ও যুগলবন্দী কলাম দেখতে পেতাম। তারা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বিষয়টিকে অতিরিক্ত দৃশ্যমান করে 'ধর্মীয় সমাজের কলঙ্ক' হিসেবে প্রচার করত৷ অথচ এখন ভিকটিম হওয়ার কারণে মাদরাসা শিক্ষার্থীর নাগরিক অধিকার প্রাপ্তির নিশ্চয়তাও পাচ্ছে না। উল্টো প্রেমের সম্পর্ক বলে শিশুর মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন করছে এবং শিশু নির্যাতনের মতো একটি ভয়াবহ জঘন্য অপরাধকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে।
—সাধারণ আলেম সমাজ