
06/07/2025
#ইলন মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি’
মার্কিন রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তির উত্থান
দুদিন আগেও পৃথিবীর সেরা ধনী ইলন মাস্ক ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু, সহচর এবং সহকর্মী।
হঠাৎ করেই পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর সেই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ঝগড়া করে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে রাজপথে নেমে আসলেন পৃথিবীর সেরা ধনী ইলন মাস্ক।
‘ডেমোক্র্যাট’ আর ‘রিপাবলিকান’ পার্টির গোলামী ছেড়ে বের হয়ে আসার ডাক দিলেন আমেরিকার মানুষকে। ঘোষণা দিলেন আমেরিকার তৃতীয় রাজনৈতিক দল আমেরিকা পার্টির।
বাংলাদেশের মানুষের কাছে আগে থেকেই ইলন মাস্ক বেশ জনপ্রিয়। সম্প্রতি বাংলাদেশে ইলন মাস্কের স্যাটেলােইট ভিত্তিক ইন্টারনেট সার্ভিস ‘স্টারলিংক’-এর যাত্রা শুরু হওয়ায় ইলন মাস্ককে নিয়ে এদেশের মানুষের আগ্রহ আরো বেড়েছে।
আমেরিকার ১৬০ বছরের দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার ইতিহাস ভেঙ্গে তৃতীয় দল গড়ার এই চ্যালেঞ্জে পৃথিবীর সেরা ধনী ইলন মাস্ক কতটা সফল হবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে দুইটি প্রধান রাজনৈতিক দল, ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান পার্টি দীর্ঘদিন ধরে একচ্ছত্র আধিপত্য করে আসছে। এই দ্বিদলীয় ব্যবস্থার মাঝে এর আগে তৃতীয় শক্তি হিসেবে কিছু দল কিংবা প্রার্থী আত্মপ্রকাশ করলেও, তারা কখনো স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তবে এবার ইলন মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি’ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
প্রযুক্তি, ব্যবসা ও গণমাধ্যমের এই চৌকস ব্যক্তিত্ব রাজনীতিতে প্রবেশ করে যে আলোড়ন তুলেছেন, তা মার্কিন রাজনীতিতে বহুমাত্রিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
দীর্ঘদিনের ডেমোক্র্যাট আর রিপাবলিকান পার্টির ক্ষমতার পালাবদলের খেলায় এবার নিশ্চয় নতুন এক মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে ইলন মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি’।
নতুন এই দল গঠনের ঘোষণা দিয়ে মার্কিন রাজনৈতিক প্রথা আর রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা ইলন মাস্ক।
ইলন মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি’ গঠনের ঘোষণা নি:সন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচিত ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট এই দুই প্রধান দলের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের মাঝে তৃতীয় একটি শক্তি কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে সেটাই বিশ্লেষণ করার সময় এখন।
মার্কিন রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তির উত্থানের যে চ্যালেঞ্জগুলো মাস্ককে মোকাবেলা করতে হবে তা এই প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
প্রথমত: মার্কিন রাজনীতিতে তৃতীয় দলের চ্যালেঞ্জ
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাস দ্বি-দলীয়তেই অভ্যস্ত। ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দল প্রায় ১৬০ বছর ধরে ক্ষমতার পালাবদলে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। মাঝেমধ্যে তৃতীয় দলের উত্থান দেখা গেলেও তারা কখনোই জাতীয় পর্যায়ে টিকে থাকতে পারেনি।
রস পেরো ১৯৯২ সালে ‘রিফর্ম পার্টি’ গঠন করে তৃতীয় শক্তি হিসেবে আলোড়ন তুলেছিলেন। কিন্তু সেই সময় তিনি তার দলের স্থায়ী ভিত্তি গড়তে ব্যর্থ হয়েছেন।
‘গ্রীন পার্টি এবং ‘লিবারেল পার্টি’র মতো দলগুলোও কিছু নীতিগত জায়গায় প্রভাব বিস্তার করলেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনে সক্ষমতা অর্জনে অক্ষম হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত: ইলন মাস্কের ব্যতিক্রমী অবস্থান
ইলন মাস্ক শুধুমাত্র একজন ধনী প্রযুক্তি উদ্যোক্তাই নন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আলাপে প্রভাবশালী কণ্ঠস্বরও। তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এখানে বিশ্লেষণ করলে পাঠক স্পষ্ট ধারণা পাবেন। যেমন-
ইলন মাস্কের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। শুধু ‘টেসলা’ কিংবা ‘স্পেস এক্স’ নয়, টুইটারের মালিকানার মাধ্যমে তিনি বিশ্ব গণমাধ্যমকে নিজের মত করে ব্যবহার করতে পারেন। তাঁর বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড প্রতিদিনই বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমে বহুলভাবে আলোচনায় আসে।
ইলন মাস্কের রাজনৈতিক অবস্থানও একেবারে নড়বড়ে নয়। মাস্ক মাঝে মাঝে ডানপন্থী এবং কখনো কখনো উদারপন্থী মতামত দেন। যা তাঁকে উভয় দলের সমর্থকদের একটি নির্দিষ্ট অংশের কাছে আগে থেকেই বেশ গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
মাস্ক নিজেকে কখনো মধ্যপন্থী, কখনো লিবার্টেরিয়ান, আবার কখনো রক্ষণশীল মূল্যবোধের সমর্থক হিসেবে প্রকাশ করেছেন। অতীতে তিনি ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন দিয়েছেন। বারাক ওবামারও ঘনিষ্ট হয়েছিলেন।
এই দ্বৈত অবস্থান তাঁকে মেইনস্ট্রিম রাজনীতিতে অসন্তুষ্ট জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। তাঁর দল সম্ভবত ‘ট্রাডিশনাল ভ্যালু প্লাস টেকনোক্র্যাটিক ভবিষ্যৎবাদ’ এই মিশ্র দর্শনের ওপর দাঁড়িয়ে যাবে।
টেকনোক্র্যাটিক নেতৃত্বের ধারণায় বিশ্বাসী মাস্ক ভবিষ্যতের নেতৃত্বে ব্যবসায়ী ও প্রযুক্তিবিদদের ভূমিকা দেখতে চান, যা মূলধারার রাজনীতির বাইরে।
তৃত্বীয়ত: ইলন মাস্কের সক্ষমতা
নিজের বিপুল সম্পদ দিয়ে মাস্ক একটি সংগঠন তৈরি করতে পারেন, যা প্রচারে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের টেক্কা দিতেও সক্ষম।
প্রযুক্তিপ্রেমী তরুণদের মাঝেও তাঁর একটি বিশাল অনুসারী গোষ্ঠী আছে। প্রতিদিন ১৮০ মিলিয়ন ফলোয়ারের সঙ্গে তিনি বিশাল এক জনমত গঠনকারী হিসেবে ব্যাপক প্রভাবশালীও। তরুণদের আকর্ষণ করার সক্ষমতায় অনেককেই টেক্কা দিতে পারবেন মাস্ক।
এআই, স্পেস, ক্লিন এনার্জি ইত্যাদি নিয়ে তাঁর কাজ তাকে নতুন প্রজন্মের কাছে আদর্শ হিসেবে গড়ে তুলেছে। মাস্ক চাইলে পুরো নির্বাচনী প্রচার নিজের অর্থে আর নিজস্ব জনবলেই চালাতে পারবেন।
মাস্ক মনে করেন প্রযুক্তি ও তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সরকার পরিচালিত হওয়া উচিত। কর হ্রাস, উদ্যোক্তাবান্ধব নীতি এবং ছোট সরকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে তিনি।বাকস্বাধীনতা, অস্ত্র ধারণের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার প্রতি তাঁর ঝোঁকপ্রবনতা প্রবল।
আমেরিকান রাজনীতির প্রতি বিরক্ত বহু মানুষের কাছে ‘আমেরিকা পার্টি’ একটি ‘এন্টি-এস্টাবলিমন্টে’ হিসেবে জনপ্রিয় বিকল্প হতে পারে। প্রচলিত দুই দলের দুর্নীতি ও ভণ্ডামিকে চ্যালেঞ্জ জানানো মাস্ক তাই সহজেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেন।
চতূর্থত : ইলন মাস্কের দুর্বলতা
যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট(এফপিটিপি) বা ‘সরল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জয়’ নির্বাচন পদ্ধতি তৃতীয় দলের বিজয়ের জন্য উপযোগী নয়। বাংলাদেশে বর্তমানে এই রকম পদ্ধতির পরিবর্তে পিআর বা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবি উঠেছে। এফপিটিপি পদ্ধতিতে, ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে একটি ভোট দেন। নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থী বিজয়ী হন। নতুন দলের জন্য এটা একটা বড় সমস্যা।
এছাড়ার মার্কিন নির্বাচনে ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ সিস্টেম তৃতীয় দলের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা। অতীতেও বেশ কয়েকবার এর প্রমান পাওয়া গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট নির্বাচন পদ্ধতি এবং ইলেকটোরাল কলেজ সিস্টেমে প্রচুর অর্থ ও শক্তিশালী সংগঠনের প্রয়োজন। এসব কারণে তৃতীয় দলগুলোর জন্য টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
নতুন দলের সংগঠনিক দুর্বলতাও এখানে বড় ফ্রাক্টর হিসেবে কাজ করবে। রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাটদের মতো শক্তিশালী ও স্থায়ী রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা মাস্কের জন্য বেশ কঠিন হবে।
ট্রাম্প এখন আর কোন কিছুতেই ইলন মাস্ককে ছাড় দিবে না। ট্রাম্প প্রশাসন ইলন মাস্কের ব্যবসার বারোটা বাজিয়ে দিতে চাইবে।
মাস্কের বিতর্কিত অবস্থানও একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাঁর অতিরিক্ত স্বাধীনচেতা মনোভাব এবং সবসময় ‘বৃত্তের বাইরে’ যাওয়ার প্রবনতা নতুন রাজনৈতিক দলের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
পঞ্চমত : ইলন মাস্কের সম্ভাবনা
মধ্যবর্তী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রিপাবলিকান ও মধ্যমপন্থী ডেমোক্র্যাট ভোটার আমেরিকা পার্টির দিকে ঝুঁকতেও পারেন। ইলন মাস্ক হয়তো সেরকম ইঙ্গিত পেয়েই নতুন দল গড়ার সাহস কেরেছেন।
ইলন মাস্কের এই পদক্ষেপকে কেবল একটি ব্যক্তি বা দলের অভ্যুত্থান হিসেবে না দেখে বৃহত্তর মার্কিন রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক সংস্কার ও টেকনো-রাজনীতির উত্থান হিসেবেও দেখা যেতে পারে।
‘আমেরিকা পার্টি’ হয়তো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সরাসরি বিজয়ী হতে পারবে না, কিন্তু এটি মার্কিন রাজনীতিতে বহুল প্রচলিত বয়ানের ধারা বদলেও দিতে পারে।
ইলন মাস্কের ‘আমেরিকা পার্টি’ যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করতে পারবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যদিও প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর তুলনায় এটি একটি নবীন উদ্যোগ এবং নির্বাচন ব্যবস্থার কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা এর সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, তবুও মাস্কের প্রযুক্তি-অর্থ-জনপ্রিয়তা এই দলকে অন্তত “রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে পারবে।
ভবিষ্যতে ‘আমেরিকা পার্টি’ যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে কিনা, তা নির্ভর করবে দলের কাঠামো, আদর্শিক ভিত্তি, নেতৃত্ব এবং জনসম্পৃক্ততার দক্ষতার ওপর।......................................
৬ জুলাই ২০২৫......................................