
27/06/2025
আমার এক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বড়ভাই জার্মানিতে একটি স্বনামধন্য কোম্পানিতে সাইন্টিস্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। দেশে আসলেই তিনি আমাকে স্মরণ করেন। ধানমন্ডিতে তাঁর বাসা হওয়ায়, অফিস যাতায়াতের পথে লেকের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের গল্পগুজব হতো। একদিন তিনি আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। তাঁর ড্রইংরুমে ছোট একটি মিসাইলের নমুনা দেখে আমি বেস অবাক হলাম। কারন ভাই পড়ালেখা করেছেন EEE তে, মিসাইল নিয়ে কি কাজ! জিজ্ঞাসা করতেই ভাই কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে তাঁর মিসাইল গবেষণার পেছনের গল্প শোনালেন, যা শুনে আমি রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম।
ভাই দেশের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে EEE তে পড়াশোনা করেছেন। তবে তাঁর মূল আগ্রহের বিষয় ছিল ক্ষেপণাস্ত্র। ভার্সিটিতে থাকাকালীনই তিনি ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে প্রচুর ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন। তাঁর প্রবল আগ্রহের কারণে, স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য MIST -তে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তিও হয়েছিলেন। কারন MIST ছাড়া অন্য কোথাও সে সুযোগ ছিলনা। কিন্তু বিশেষ কিছু কারণে তিনি তাঁর এই আগ্রহকে কবর দিতে বাধ্য হন।
মিসাইল নিয়ে তাঁর অতিরিক্ত আগ্রহের কারণে বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তাঁকে নজরে রাখা শুরু করে। এরপর একদিন একজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা তাঁকে বাসায় ডেকে নির্জনে বোঝান যে, মিসাইল নিয়ে তাঁর এই অতি আগ্রহ তাঁর জীবনের জন্য হুমকি হতে পারে। তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা না করে কেবল এতটুকু বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ যদি উন্নত মানের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়, তবে প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য তা হবে সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ। তাই তারা চায় না যে আমরা সেই সক্ষমতা অর্জন করি।
এর পরই ভাই ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে তাঁর গবেষণা ও আগ্রহ থামিয়ে দিতে বাধ্য হন। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, তাঁর বাবা একজন উচ্চপদস্থ সরকারি প্রশাসক হওয়া সত্ত্বেও তিনি এই আগ্রহ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
একসাথে কফি হাতে ভাই তাঁর গবেষণা নিয়ে আমাকে বোঝাচ্ছিলেন। আমি যেহেতু সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, ভাই একদম একাডেমিক আলোচনা শুরু করে দিলেন। আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়েও তার কথাবার্তা আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিলো। ফিজিক্সের জটিল- সুক্ষ্ম জ্ঞানে তার যে গভীরতা, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। এত অসম্ভব মেধাবী মানুষটিকে আমরা আমাদের দেশের জন্য কাজে লাগাতে পারিনি, এটা সত্যিই দুঃখজনক।
ভাই বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য ছিল এমন একটি ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা যা পাশের দেশের ক্ষেপণাস্ত্রকে টেক্কা দিতে পারে। এর জন্য প্রায় ৩০টির মতো প্যারামিটার সমাধান করা প্রয়োজন ছিল, যার মধ্যে তিনি একাই প্রায় ১৮টির মতো সমাধান করে ফেলেছিলেন। বাকিগুলো সমাধানের জন্য যখন তিনি বিমানবাহিনীর বেশ কিছু কর্মকর্তা এবং একাডেমিক ব্যক্তিদের সাথে কথা বলা শুরু করেন, তখন কেউই তাঁকে সাহায্য তো করেইনি, উল্টা তখনই মূলত তাঁকে নজরে আনা হয়। পরবর্তীতে ভাই খুব ভাল চাকরি পেলেও শেষমেশ দেশ ছেড়ে চলে যান। এবং সাধীনভাবে কাজ করতে না পারার আক্ষেপটা তার মধ্যে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছিলো।
যারা মনে করেন মেধার অভাবে আমরা প্রযুক্তিতে পিছিয়ে আছি, বিষয়টি আসলে সম্পুর্ন সত্য নয়। এর মূল কারণ হলো ক্ষমতা। ক্ষমতার অভাবে ক্ষমতাধর দেশগুলো আমাদের গলা চেপে ধরে রাখে। চাইলেও অনেক কিছু আমাদের করতে দেওয়া হয় না। আর সে কারণেই সুযোগের অভাবে দেশের মেধাবীরা বিদেশে পাড়ি জমান। খোঁজ নিয়ে দেখুন, এই দেশ থেকে যারা বিদেশে যান, তাঁরা সবাই সুনামের সঙ্গেই কাজ করে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রাখছেন। আমাদের দেশে আনাচেকানাচে এমন অসংখ্য মেধাবী লুকিয়ে আছে,কিন্তু সেই মেধাগুলো ইউটিলাইজ করতে না পারাটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা।
- শামস আল রিফাত
সাবেক শিক্ষার্থী, কুয়েট