19/07/2025
ফেদায়ে মিল্লাত আসআদ মাদানী (রহ,)
“জাতির নেতা সেই…!”
১৯৬৮ সালের ১৫ নভেম্বর।
রাতের আঁধারে বেদনার এক ঝড় এলো আওলাদে রাসূল ফেদায়ে মিল্লাত মাওলানা সাইয়িদ আসআদ মাদানী (রহ.)–এর জীবনে।
এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় শহীদ হলেন তাঁর শ্রদ্ধেয় শ্বশুর মাওলানা হামিদুদ্দীন ফয়জাবাদী (রহ.), শহীদ হলেন চালকও। মাওলানা হামিদুদ্দীন ফয়জাবাদী (রহ,) দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিসে শুরার অন্যতম সদস্যও ছিলেন।
আর হযরতের স্ত্রী ও সন্তানরাও এ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। কিন্তু তিনি দুঃখের সাগরে দাঁড়িয়ে রইলেন ধৈর্যের পর্বত হয়ে।
১৬ নভেম্বর দেওবন্দে জানাজা ও দাফনের শোকাবহ আয়োজন শেষ করেই ১৭ তারিখ তিনি উপস্থিত হন দিল্লিতে অনুষ্ঠিতব্য জমিয়তের নির্ধারিত প্রাদেশিক বৈঠকে।
১৯ তারিখ হাসপাতালে মৃত্যু হলো তাঁর কলিজার টুকরো সন্তান মুহাম্মদের। আইয়ুব জাফর হযরতকে চাঁপা কন্ঠে সাহেবজাদার মৃত্যু সংবাদ শুনালেন।
পুত্রবিয়োগের সংবাদ শ্রবণে তাঁর কণ্ঠে ছিল না হাহাকার, চোখে ছিল না অশ্রু—শুধু ছিল অটল এক ত্যাগের দীপ্তি।
এ সম্পর্কে ১৯৬৮ সালের ২৯ নভেম্বর মাওলানা ওহীদুদ্দীন খান আল-জমিয়তে একটি হৃদয়স্পর্শী প্রবন্ধ লিখেন –
“মাওলানা মাদানীর দুর্ঘটনা”।
তিনি লিখলেন:
“পুলিশ যখন তদন্ত শুরু করতে চাইল, মাওলানা বললেন—
‘যা হবার ছিল, তা হয়েই গেছে। এখন আইনী ব্যবস্থা নিয়ে আর কী হবে? যে চলে যাওয়ার ছিল, সে চলে গেছে। যার থাকার কথা, সে থেকে যাবে।’
যখন হাসপাতালে থেকে তাঁর সন্তানের মৃত্যুসংবাদ এলো, তখনও তিনি বললেন—
‘যা হবার ছিল, তা হয়ে গেছে। শোক করে লাভ কী?’
জমিয়তের কেন্দ্রীয় কমিটি তখন এ দুর্ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি মিটিং স্থগিতের ঘোষণা দিল। মিটিং স্থগিতের কথা শুনে হযরত তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন—
‘এ দুর্ঘটনায় কি আমরা জমিয়তের কাজ থামিয়ে দেব? জাতীয় কাজ কি ব্যক্তিগত শোকের কাছে থেমে যাবে?’
তিনি নির্দেশ দিলেন, সকলকে জানিয়ে দেয়া হোক—বৈঠক হবে যথাসময়ে।
শোকার্ত ভিড়ের মাঝেও তাঁর মুখে ফুটে ছিল অদ্ভুত শীতলতা, দৃঢ়তা, শাশ্বত এক হাসি।
কারও কণ্ঠে অবাক স্বীকৃতি—
‘মাওলানা মাদানী (রহ.) যেন অটল পাহাড়!’
কারও অনুভূতি এভাবে প্রকাশ পেল—
‘এমন সময়েই মানুষের আসল সত্তা প্রকাশ পায়।’
হ্যাঁ—এই মুহূর্তেই তিনি বুঝিয়ে দিলেন—
“জাতির নেতা সেই, যার নিজের ব্যথা বুকে জমে থাকে কিন্তু জাতির বেদনার কাছে হার মেনে যায়।”
শোককে তিলে তিলে পুড়িয়ে নিজেকে উজাড় করে দিলেন জাতির জন্য।
মাওলানা মাদানী (রহ.) প্রমাণ করলেন—নেতৃত্ব মানে অটলতা, ত্যাগ আর অসীম ধৈর্যের প্রতীক হওয়া।
তিনি ছিলেন সেই উচ্চ মাপকাঠির মানুষ, যার জন্যই লেখা হয়—
“জাতির নেতা সেই… যে নিজের ক্ষত ঢেকে রাখে আর জাতির ক্ষত সারাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।”
-মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব,
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।