
09/09/2025
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে কলঙ্কময় অধ্যায়- লংগদু পাকুয়াখালী ট্রাজেডি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম সবসময়ই ছিলো সংঘাত, রক্তপাত ও ষড়যন্ত্রের আঁতুড়ঘর। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এখানকার একটি অংশ বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সশস্ত্র কর্মকাণ্ড শুরু করে। যার ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশ পায় বারবার বাঙালি জনগোষ্ঠীর উপর হত্যা, লুটপাট ও নির্বিচার গণহত্যার মধ্য দিয়ে। তারই এক ভয়াল দৃষ্টান্ত হলো রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু উপজেলার পাকুয়াখালী ট্রাজেডি, যা আজও ইতিহাসের কলঙ্কময় অধ্যায় হয়ে বাঙালি জাতিকে শোকাহত করে রেখেছে।
১৯৯৬ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর, শান্তিবাহিনী তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সন্ত্রাসীরা চরম নৃশংসতার নজির গড়ে তোলে। সেদিন লংগদুর ৩৬ জন নিরীহ বাঙালি কাঠুরিয়াকে ব্যবসায়িক লেনদেনের প্রলোভন দেখিয়ে সীমান্তবর্তী পাকুয়াখালী অরণ্যে ডেকে নেয়া হয়। সন্ত্রাসীরা তাদেরকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে হাতে দা, কিরিচ ও ভারতীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে একে একে হত্যা করে।
সেদিন মৃত্যুর দুয়ার থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান ইউনুস আলী নামের এক কাঠুরিয়া। তার বর্ণনায় উঠে আসে ভয়াল হত্যাযজ্ঞের বিবরণ। তিনি জানান, প্রতিটি বাঙালি কাঠুরিয়াকে দা ও ছুরি দিয়ে এলোপাথাড়ি আঘাত করা হয়। দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হয়। নিহতদের লাশের অবস্থা ছিল এতটাই করুণ যে, উদ্ধারকালে তাদের চেনাই যাচ্ছিল না।
গ্রামবাসী সেনাবাহিনী ও পুলিশের সহায়তায় ৯ থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে পাকুয়াখালীর গহীন খাদ থেকে ২৮টি লাশ উদ্ধার করে। বাকী ৭ জনের কোনো খোঁজ মেলেনি আজও। এভাবেই ৩৫ জন নিরীহ বাঙালি কাঠুরিয়া নিছক বাঙালি হওয়ার অপরাধে জীবন হারান।
১৯৯৬ সালের এই ভয়াবহ ট্রাজেডি পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জ্বলন্ত প্রমাণ হলেও, আজ পর্যন্ত এর কোনো বিচার হয়নি। তৎকালীন সরকার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রীরা বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টোটা। একই বছরের শেষে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির শর্ত অনুযায়ী শান্তিবাহিনীর সকল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায় মাফ করে দেওয়া হয়। ফলে পাকুয়াখালী হত্যাযজ্ঞসহ অসংখ্য হত্যাকাণ্ড, লুটপাট ও ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই বন্ধ হয়ে যায়।
এই দায়মুক্তির কারণে আজও স্বজনহারারা শুধু কান্না বুকের ভেতর চেপে রেখে প্রতিবছর এই দিনটিকে পালন করেন। তারা করব জিয়ারত, দোয়া মাহফিল ও প্রতিবাদ সভার মাধ্যমে নিহত আত্মীয়দের স্মরণ করেন। কিন্তু তাদের আর্তনাদ পৌঁছায়নি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী মহলে। ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন কিংবা বিচার-কিছুই পায়নি ভুক্তভোগীরা।
লংগদু উপজেলা ও আশপাশের অঞ্চল বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এটি শুধু ভোটের বাক্স। কিন্তু জনগণের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে রাজনীতি করা হলেও, কোনো দলই পাকুয়াখালী ট্রাজেডি নিয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়নি। ইতিহাসের এই ভয়াবহতম হত্যাযজ্ঞ রাজনৈতিক বক্তৃতা কিংবা সংসদীয় আলোচনায় স্থান পায়নি। বরং ট্রাজেডি দিনের স্মরণোৎসবকে সীমিত আকারে পালনে বাধ্য করা হয়েছে।
শুধু পাকুয়াখালী নয়, শান্তিবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় একের পর এক বাঙালি নিধন, গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, নারীদের উপর পাশবিক নির্যাতন-সবই ঘটেছে। কিন্তু এ সব হত্যাযজ্ঞের কোনোটিরই বিচার হয়নি। ফলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়েছে এবং পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দমননীতি জারি রেখেছে।
১৯৯৬ থেকে ২০২৫ দীর্ঘ ৩ দশক পার হলেও পাকুয়াখালী হত্যাযজ্ঞের বিচার শুরু হয়নি। নিহতদের পরিবার এখনও অপেক্ষায় আছে ন্যায়বিচারের। কিন্তু রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা ও রাজনৈতিক সমঝোতার কারণে এই অপেক্ষা যেন অনন্তকাল পর্যন্ত স্থায়ী হতে চলেছে।
স্বজনহারাদের একটাই দাবি-তথাকথিত শান্তিবাহিনী ও তার মদদদাতা সন্তু লারমাকে আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। গণহত্যার দায় থেকে কাউকে অব্যাহতি দেওয়া যায় না। দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও বাঙালি জাতিসত্তার নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থেই পাকুয়াখালী হত্যাকাণ্ডসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
লংগদু পাকুয়াখালী ট্রাজেডি শুধু ৩৫টি পরিবার নয়, সমগ্র জাতির জন্য এক অবিনাশী ক্ষত। এই হত্যাযজ্ঞ পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় অধ্যায় হয়ে আছে। সময়ের প্রলেপে হয়তো স্মৃতির ক্ষত ফিকে হয়, কিন্তু রক্তের ঋণ ভুলে যাওয়া যায় না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভেঙে পাকুয়াখালী হত্যাযজ্ঞের বিচার নিশ্চিত করাই হোক জাতির প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা।