14/10/2025
I got 1,431 reactions and 92 replies on my recent top post! Thank you all for your continued support. I could not have done it without you. 🙏🤗🎉
আরাকান যেভাবে বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়েছিল
বাঙালির ইতিহাসে এমন কিছু অধ্যায় আছে, যেগুলো সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছে, অথচ তাদের প্রতিটি পাতায় জ্বলজ্বল করছে অমূল্য রত্নের মতো আলো। রাখাইন — যে ভূমি আজ মিয়ানমারের অন্তর্গত, একসময় তাকে ডাকা হতো “আরাকান” নামে।
চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা ছিল সেই ভূমি। পাহাড়, নদী, আর নোনা বাতাসে মেশানো বন্দরনগরী—যেখানে একদিন বাঙালি মুসলমান ব্যবসায়ী, কবি, সুলতান ও রাজারা পাশাপাশি হেঁটেছেন ইতিহাসের বালুকাবেলায়।
প্রাচীন আরাকান ছিল এক বিস্ময়ভূমি। মাটির নিচে ছিল তেল, কয়লা, ইউরেনিয়াম, সোনা আর রূপার বিপুল ভাণ্ডার। কিন্তু এই প্রাচুর্যই হয়ে উঠেছিল তার শত্রু। একে দখল করতে এসেছিল বারবার বিভিন্ন শক্তি—কখনো বর্মি রাজা, কখনো ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক, কখনো প্রতিবেশী রাজ্য।
চতুর্দশ শতাব্দীর সূর্যোদয়ে দেখা গেল এক অনন্য দৃশ্য।
আরাকানের রাজপুত্র নরমিখলা, যিনি একসময় নির্বাসিত হয়েছিলেন, ফিরে এলেন নিজের রাজ্য দখল করতে—বাংলার গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দিন শাহের সৈন্যবাহিনীর সহায়তায়। সেই সঙ্গে বদলে গেল আরাকানের ভাগ্যও। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন, নাম নিলেন সুলতান সোলায়মান শাহ।
আরাকানের রাজদরবারে শুরু হলো নতুন ইতিহাস—যেখানে বৌদ্ধ রাজা ফারসি উপাধি গ্রহণ করেন, মুদ্রায় উৎকীর্ণ হয় কালেমা তায়্যিবা।
সেই সময় রোসাং (আরাকানের রাজধানী) হয়ে ওঠে এক সাংস্কৃতিক রাজধানী। বাংলার কবিরা সেখানে পেতেন সম্মান ও আশ্রয়।
মহাকবি আলাওল, দৌলত কাজী, সৈয়দ মোহাম্মদ রফি—তাদের কলমে ফুটে উঠেছিল প্রেম, ধর্ম, যুদ্ধ আর মানবতার মিশ্র রূপ। আরাকানের রাজদরবারে তখন প্রতিধ্বনিত হতো বাংলা কবিতার সুর।
এভাবেই মুসলিম সংস্কৃতি ও আরাকানের স্থানীয় ঐতিহ্য মিশে গড়ে ওঠে এক নবজীবন—যার ফলাফল আজকের রোহিঙ্গা জাতির উৎপত্তি। সপ্তম শতাব্দী থেকেই আরাকানে আরব বণিকদের আনাগোনা শুরু হয়। স্থানীয় আরাকানি জাতি ও মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমানদের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে এক নতুন জাতিসত্তা, যারা নিজেদের “রুহাঙ্গা” বা “রোহিঙ্গা” বলে পরিচয় দেয়।
কিন্তু শান্তি টেকেনি বেশি দিন।
১৭৮৪ সালে বর্মি রাজা ভোধাপোয়া আগুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন আরাকানের ওপর। তিনি হত্যা করলেন হাজার হাজার মানুষ, মন্দির লুট করলেন, মুসলমানদের মসজিদ ধ্বংস করলেন। আরাকানের রাস্তায় তখন রক্ত বইছিল নদীর মতো। হাজারো মানুষ পালিয়ে এল চট্টগ্রামে আশ্রয়ের খোঁজে—যেন নিজের ঘরে ফিরে আসা শরণার্থী।
এরপর এলো ব্রিটিশরা। তারা বার্মাকে করায়ত্ত করে নিল, আর তার সঙ্গে আরাকানকেও।
১৯৪৬ সালের আলোড়িত সময়ে, যখন ভারতবর্ষে স্বাধীনতার সুর বাজছে, তখন আরাকানের মুসলমান নেতারা একটি স্বপ্ন দেখলেন—বাংলার সঙ্গে এক হওয়ার স্বপ্ন। তারা গঠন করলেন আরাকান মুসলিম লীগ, আর প্রকাশ করলেন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
কিন্তু ইতিহাস তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল না।
পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা ভয় পেলেন—যদি আরাকান যুক্ত হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তান সমুদ্রপথে অতিশক্তিশালী হয়ে উঠবে।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহও সে সময় বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলেন না।
আরাকান হারিয়ে গেল সীমান্তের ওপারে, রেখে গেল এক দীর্ঘশ্বাস।
তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সেই আরাকান কেবলই দুঃখের নাম।
রোহিঙ্গা মুসলমানরা হারিয়েছে তাদের ঘর, মাটি, মর্যাদা—যেন ইতিহাসের অবহেলায় তাদের অস্তিত্বই মুছে গেছে।
যদি সেই সময় বাংলার নেতারা দূরদৃষ্টি দেখাতেন, যদি জিন্নাহ বুঝতেন এই অঞ্চলের গুরুত্ব—তবে হয়তো আজ রাখাইন রাজ্যের এই গল্পটি অন্যরকম হতো।
একটি ভূমি, যা একদিন ছিল বাংলা সংস্কৃতির বর্ধিত পরিধি—আজ তা সীমান্তের ওপারে নিঃসঙ্গ এক স্মৃতি।
আরাকানের সকাল আজও অপেক্ষা করে—কখন আবার ইতিহাস তাকে ফিরিয়ে দেবে তার হারানো আলো।
পেজে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ
---
📚 রেফারেন্স সূত্র:
1. Abdul Karim, History of the Muslims of Bengal, Asiatic Society of Bangladesh, 2007.
2. G.E. Harvey, History of Burma: From the Earliest Times to 10 March 1824, London: Frank Cass & Co. Ltd, 1967.
3. Aye Chan, The Development of a Muslim Enclave in Arakan (Rakhine) State of Burma, SOAS Bulletin of Burma Research, Vol. 3, No. 2, Autumn 2005.
4. Muhammad Yunus & Chan Aye, The Rohingyas: A People at the Crossroads, University Press Limited, Dhaka, 1992.
5. Charney, Michael W., Powerful Learning: Buddhist Literati and the Throne in Burma’s Last Dynasty, 1752–1885, University of Michigan, 2006.
History Hunters