26/08/2025
১.
সাতটি বছর। দুই হাজার পাঁচশ পঞ্চান্নটি দিন। সময়ের এই বিশাল ক্যানভাসে মানুষ বদলে যায়, শহর বদলে যায়, সম্পর্কগুলোর ওপর ধুলোর আস্তর পড়ে। রাফিদের জীবনটাও বদলেছে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির আকাশ তাকে নতুন পরিচিতি দিয়েছে, কর্পোরেট জগতের শীর্ষে পৌঁছানোর সিঁড়ি গড়ে দিয়েছে। কিন্তু কিছু স্মৃতি, কিছু ক্ষত ধুলোর আস্তরের নিচে চাপা থাকা আগ্নেয়গিরির মতো, সামান্য আঘাতেই লাভা উদগীরণ করতে প্রস্তুত থাকে।
প্লেনের জানালা দিয়ে মেঘের সমুদ্র দেখতে দেখতে রাফিদের মনে হচ্ছিল, সে যেন সময়ের স্রোতে ভেসে আবার সেই পুরোনো ঘাটে ফিরে আসছে, যে ঘাট থেকে সে একদিন সব বন্ধন ছিন্ন করে যাত্রা শুরু করেছিল। ঢাকা নামটা কানে বাজতেই বুকের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল। এই শহর, এই মাটি—তার শেকড়। অথচ এই শেকড়ই তাকে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা দিয়েছে।
গফুর চাচার ফোনটা যখন এসেছিল, রাফিদ তখন সিডনিতে তার অ্যাপার্টমেন্টের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ব্রিজের দিকে তাকিয়ে ছিল। চাচা ফোঁপাতে ফোঁপাতে যা বলেছিলেন, তা শোনার জন্য রাফিদ প্রস্তুত ছিল না।
"বাবা, তোমার মা... তোমার মা আবার শেখ বাড়িতে শালিসি বসাইতে চায়।"
শালিসি! কেন?
গফুর চাচার পরের কথাগুলো ছিল আরও অবিশ্বাস্য, "তোমার মা চায় তুমি রাহাতের অংশটা ওরে ফিরাইয়া দেও। গ্রামের মুরুব্বিদের ডাইকা বিচার বসাইয়া। কইবো, বড় ভাই হইয়া তুমি ছোট ভাইয়ের হক মাইরা খাইতাছ।"
রাফিদের হাত থেকে কফির মগটা প্রায় পড়েই গিয়েছিল। একটা ঠান্ডা স্রোত তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। সে হাসবে না কাঁদবে, বুঝতে পারছিল না। যেই মা'কে সে সাত বছর আগে শেখ বাড়ির রানির আসনে বসিয়ে দিয়ে এসেছিল, যার মাসের টাকা সে কোনোদিন একদিনের জন্যও এদিক-ওদিক হতে দেয়নি, সেই মা তার পিঠে এভাবে ছুরি বসাতে পারেন?
কেনই বা পারবেনা? রাহাত তো তার আদরের কলিজার টুকরো।
রাফিদ ভাবতেও পারিনি আবার তার মা তার সাথে এমনটা করতে পারেন।
যেই মাকে রাহাত ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলো রাস্তায়, সেখান থেকে তুলে রাফিদ মাকে দিয়েছিলেন রানীর মর্যাদা, শেখ বাড়ির সম্মান। আর আজ সেই মা-ই তার ছোট ছেলের জন্য আবার বড় ছেলেকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন!
মায়ের কি ন্যূনতম লজ্জাবোধটুকুও নেই?
রাহাত জুয়া খেলে, মেয়েদের পেছনে টাকা উড়িয়ে শেখবাড়ির সম্মানটুকু বিক্রি করতে বসেছিল, অন্য কারো কাছে সামান্য দামে বাড়ির অংশ তুলে দিতে চেয়েছিল, গফুর চাচা যদি রাফিদকে খবরটা না জানাতো? তখন শেখ বাড়ির এক অংশ হাতছাড়া হয়ে যেতো এই বড় ভাই-ই দ্বিগুণ দামে সেই অংশ কিনে নিয়েছিল। শুধু তাই নয়, তাকে আর তার স্ত্রী তানহাকে সেই বাড়িতেই মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছিল। এমনটা তারা কীভাবে করতে পারে?
বিমানের চাকা রানওয়ে স্পর্শ করার সাথে সাথে একটা ঝাঁকুনি খেল রাফিদ। স্মৃতির জট থেকে বাস্তবে ফিরে এল সে। ঢাকা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সাত বছর আগের সেই ভীরু, অপমানিত, পালিয়ে যাওয়া রাফিদ আজ ফিরছে একজন প্রতিষ্ঠিত, আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে। কিন্তু ভেতরের ক্ষতগুলো কি শুকিয়েছে?
ভিআইপি লাউঞ্জ দিয়ে বেরিয়ে আসতেই চোখে পড়ল চেনা মুখটা। গফুর চাচা। সাতটা বছরে মানুষটার বয়স যেন এক ধাক্কায় অনেকখানি বেড়ে গেছে। চুল প্রায় সব সাদা, চামড়ায় পড়েছে গভীর বলিরেখা। কিন্তু চোখের সেই স্নেহময় দৃষ্টিটা আগের মতোই আছে। রাফিদকে দেখামাত্রই তিনি দৌড়ে এলেন।
"বাবা, আইসা পড়ছ!"—বলতে গিয়ে তার গলা ধরে এল। রাফিদ এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। এই একটা মানুষের বুকেই সে নিঃস্বার্থ আশ্রয়ের গন্ধ পায়।
"কেমন আছেন, চাচা?" রাফিদের গলাটাও ভারি শোনাল।
"তোমার লাইগা অপেক্ষা করতে করতে তো বুড়া হইয়া গেলাম। আর তুমি না আইলে আমি মাইয়ার বিয়া দিতাম না, বাবা। দরকার হইলে সব ছাইড়া আবার গ্রামে চইলা যাইতাম।"
গফুর চাচার এই সরল অভিমানটুকুই রাফিদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এই মানুষটার অনুরোধ সে ফেলতে পারে না। রাফিদ মূলত দেশেই ফিরেছে গফুর চাচার মেয়ের বিয়ের জন্য। চাচা সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, রাফিদ না এলে তিনি কোনো অনুষ্ঠান করবেন না। এমনকি রাফিদের দেওয়া ফ্ল্যাট ছেড়ে গ্রামে চলে যাবেন। যার কাঁধে মাথা রেখে একদিন সে নতুন জীবন শুরু করার শক্তি পেয়েছিল, তাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা রাফিদের নেই।
গাড়িতে ওঠার পর ঢাকার চিরচেনা যানজট আর কোলাহল রাফিদকে ঘিরে ধরল। সাত বছরে শহরের চেহারা অনেক বদলেছে। ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলের বিশাল পিলার—সবকিছুই যেন উন্নয়নের বিজ্ঞাপন। কিন্তু মানুষের ভেতরের লোভ, হিংসা, আর স্বার্থপরতার কি কোনো বদল হয়েছে? শেখ বাড়ির মানুষদের তো হয়নি।
গফুর চাচা ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে আড়চোখে বারবার রাফিদকে দেখছিলেন। তিনি বললেন, "বাবা, শালিসির কথা হুইনা তুমি রাগ করছ জানি। কিন্তু তোমার মা'রে... "
রাফিদ তাকে থামিয়ে দিল। শান্ত কিন্তু কঠিন গলায় বলল, "চাচা, ওই বাড়ির প্রসঙ্গ এখন থাক। আমি আপনার মেয়ের বিয়ের জন্য এসেছি। সব আয়োজন ঠিকঠাক হচ্ছে তো?"
গফুর চাচা বুঝলেন, রাফিদ প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাইছে। তার ভেতরের ঝড়টা তিনি আঁচ করতে পারছিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "সব ঠিক আছে, বাবা। তোমার বইনে তার ভাই ছাড়া বিয়ের পিঁড়িতে বসব না বইলা দিছিল।"
রাফিদ ম্লান হাসল। যার নিজের কোনো বোন নেই, সে আজ অন্যের ভাই হয়েছে। অথচ নিজের আপন মা, আপন ভাই তাকে তাদের, নিজের কেউ বলে দাম দেয়না।
গাড়ির কাঁচের বাইরে ছুটে চলা শহরের দিকে তাকিয়ে রাফিদের স্পষ্ট মনে পড়ে গেল সেই দিনটার কথা। তার চাকরিটা চলে গিয়েছিল। বেকার, দিশেহারা অবস্থায় যখন সে মাকে বলেছিল , তখন তার মা লোকজন জড়ো করে, ঘরভাড়া বাবদ, ৬০০০ টাকা চেয়েছিল। আমিনা বেগম এই টাকা দেওয়ার ক্ষমতা রাফিদের নেই, সে এই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য। কোনো সমবেদনা না জানিয়ে, স্বার্থপরতা আর বিরক্তির চোখে বলেছিলো,
"চাকরি নাই, এখন কী করবি?" তোর বউ আর তোকে কে খাওয়াবে?
"চেষ্টা করছি মা, একটা না একটা চাকরি পেয়ে যাবো ।"
"ততদিন? রাহাতের পাঠানো টাকায় বসে বসে খাবি? সেই জন্যই তো আমি এই বাড়িতে শালিসি ডেকেছি"
আমাকে ৬০০০ টাকা দে নয়লে চলে যা।"
সেই কথাগুলো শলাকার মতো বিঁধেছিল রাফিদের বুকে।
হ্যাঁ, এক কাপড়ে। নিজের জন্ম দেওয়া সন্তানকে তার মা এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন, যেন সে ছোট ছেলে রাহাতের রোজগারে ভাগ বসাতে না পারে।
রাফিদ শেখ বাড়ি থেকে বের হবার কিছুক্ষণ পরেই ইতালি থেকে ফোন করেছিল রাহাত। সেই ফোনকলটা ছিল কফিনের শেষ পেরেক।
"হ্যালো, রাফিদ?" রাহাতের গলায় ছিল আদেশের সুর।
"হ্যাঁ, রাহাত..."
"শোন, মা সব বলেছে। তুই এখন থেকে শেখ বাড়ির পরিচয়টা কোথাও দিবি না। লোকে জানলে আমার সম্মান থাকবে না। আমার বন্ধুরা জানলে হাসাহাসি করবে। তুই আমার ভাই, এটা ভুলে যা। তাছাড়া আমার বিয়ে-শাদি করতে হবে। শশুর বাড়ির লোক এটা জানলে আমি বিয়েও করতে পারবো না "
ফোনটা কেটে গিয়েছিল। রাফিদ সেদিন নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। যে মা তাকে জন্ম দিয়েছেন, তিনি তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। যে ভাইকে সে ইতালি পাঠিয়েছে, সে তার পরিচয়টুকুও মুছে ফেলতে চায়। সেই দিনই রাফিদের ভেতরের নরম মানুষটা মরে গিয়েছিল।
এইসব ভাবতে ভাবতে গাড়িটা কখন যে শেখ বাড়ির সেই চিরচেনা রাস্তায় ঢুকে পড়েছে, রাফিদ খেয়ালই করেনি। বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। এই সেই বাড়ি! যেখান থেকে তাকে এক কাপড়ে বের করে দেওয়া হয়েছিল। যার প্রতিটি ইট, কাঠ তার বঞ্চনার সাক্ষী। আজ এই পুরো বাড়ির মালিক সে। রাহাতের অংশটুকুও তার নামে। অথচ কী আশ্চর্য! বাড়ির ওপর তার কোনো অধিকারবোধ জন্মাচ্ছে না, জন্মাচ্ছে একরাশ তিক্ততা।
গাড়ি থেকে নামতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল রাহাত আর তার স্ত্রী তানহা। রাহাতের চেহারায় সেই আগের ঔদ্ধত্য নেই, কেমন একটা ম্রিয়মাণ ভাব। তানহার চোখেমুখে অস্বস্তি। তাদের পেছনেই দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাফিদের মা, শেখ বাড়ির কর্ত্রী—আমিনা বেগম। সাত বছরে তার চেহারায় আভিজাত্য বেড়েছে, কিন্তু চোখের সেই উদাসীনতা কমেনি।
রাফিদ সোজা হেঁটে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে লাগল, কারো দিকে না তাকিয়ে। যেন তারা কেউ সেখানে উপস্থিতই নেই। এই উপেক্ষাটা ছিল তরবারির চেয়েও ধারালো।
রাহাত আমতা আমতা করে বলল, "ভাই,তুই আবার এসেছিস?"
রাফিদ থামল। রাহাতের দিকে না তাকিয়েই কঠিন গলায় বলল, "বাড়িটা আমার। আমি আসব, এটাই স্বাভাবিক।"
এরপর সে তার মায়ের দিকে তাকাল। সেই চোখে কোনো অভিযোগ ছিল না, অভিমান ছিল না। ছিল শুধু এক গভীর নীরাবতা। যে নীরবতা বুঝিয়ে দিচ্ছিল, সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে গেছে সে।
আমিনা বেগম ছেলের এই দৃষ্টিতে কিছুই আচ করতে পারলেন না। তিনি চোখ নামিয়ে নিলেন।
"আমার থাকার ঘরটা ঠিক করা আছে?" রাফিদ প্রশ্নটা করল গফুর চাচাকে।
"হ্যাঁ, বাবা। তোমার পুরান ঘরটাই আমি নিজের হাতে পরিস্কার করছি।"
রাফিদ আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াল না। সোজা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় তার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। পেছনে ফেলে গেল একরাশ অস্বস্তি আর নীরবতা।
নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল রাফিদ। ঘরটা আগের মতোই আছে। বইয়ের তাক, পড়ার টেবিল, খাট—সবকিছু পরিপাটি করে গোছানো। কিন্তু এই ঘরের বাতাসে যেন এখনো তার কৈশোরের হাহাকার আর যৌবনের অপমান মিশে আছে।
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল সে। উঠোনে মা আর ভাই এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বিহ্বল চেহারাটা কাঁচের ভেতর দিয়েও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তারা হয়তো ভেবেছিল, সাত বছর পর রাফিদ ফিরবে একরাশ অভিযোগ নিয়ে, চিৎকার করবে, পুরোনো হিসেব মেলাতে চাইবে। কিন্তু এই শান্ত, শীতল, নিরাসক্ত রাফিদকে তারা চিনতে পারছে না। এই রাফিদ তাদের অচেনা।
রাফিদ জানে, এই লড়াইটা চিৎকারের নয়, ক্ষমতার। শালিসি তারা ডেকেছে। এখন সেই শালিসিতেই রাফিদ তাদের বোঝাবে, নির্বাসিত রাজপুত্র যখন নিজের রাজ্যে ফেরে, তখন সে আর করুণার পাত্র থাকে না। সে আসে নিজের সাম্রাজ্যের ভিত্তি আরও মজবুত করতে।
তার আগমনী বার্তাটা সে দিয়ে দিয়েছে। আজ খেলাটা শুরু হবে তার নিয়মে।
চলবে...
#গল্প_শেখবাড়ির_বড়ছেলে
#সিজন২
#লেখিকা:এ_এইচ_স্পর্শ