09/02/2024
মারুফের শেষ পরিনতি।
_এস এম শেরআলী শেরবাগ
মারুফ, শৈশব যার হাসি আনন্দে আহ্লাদে কেটেছে। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান মারুফ পরিবারের সবার নয়নের মনি। শিশুকাল তার এতটাই ভাল কেটেছে যা আজ তার মনে পড়লে মাঝে মধ্যে অন্য মনষ্ক হয়ে শিশু সুলভ আচারন করে বসে। বাড়ন্ত বয়সে চক্রাকারে উপনিত হতেই মারুফকে শিক্ষিত প্রজন্ম হিসাবে গড়ে তুলতে নেওয়া হয় বিদ্যালয়ে। সেখানে মারুফ সহপাঠী বন্ধুদের সাথে বেশ মিলি মিশে এগিয়ে চলতে থাকে আগামীর দিকে। সহপাঠীদের মধ্যে পারভিন সুলতানা পারুর সাথে তার ঘনিষ্ঠতা একটু বেশি। সম বয়সিদের মধ্যে পারু বেশ মিশুক, যদিও সে ধনী বাবা-মায়ের কন্যা কিন্তু তার মধ্যে পরিবারের সেই অর্থনৈতিক প্রভাবটা ভর করেনি।
স্কুল আঙ্গিনায় মারুফ আর পারুর সাথে অন্যান্য সহপাঠীদের বেশ আড্ডা জমে। তারা একসাথে খেলাধুলা আর পড়-লেখা উভয়ই নিয়ে ব্যস্ততার মাঝে সময় কাটায়। ছেলেবেলা থেকেই মারুফ আর পারর বন্ধুত্ব এতটাই গভীর হয়ে উঠেছে যে, ওরা কখনো কেউ ভাবতেই পারেনা যে তারা ভিন্ন লিঙ্গে জন্মগ্রহণ করেছে। যদিও কৈশরে তাদের এতোটা আন্তরিকতা কেউ কেউ ভাল চোখে দেখেনা, তাতে তাদের যেনো কিছুই আসে যায় না।
এ ভাবেই এগিয়ে যায় তাদের জীবন চক্র। এরই মধ্যে ক্রমোন্নয়ে চলে আসে বয়ঃসন্ধি কাল। সমস্যা শুরু হয় মারুফের পরিবারে। হরমন জনিত কারনে মারুফের আচার আচারনে ব্যপক পরিবর্তন লক্ষ করে, তার পরিবার। বড্ড চিন্তিত হয় তার পিতা-মাতা। শুরু হয় মারুফকে নিয়ে চিকিৎসকের নিকট দৌড়াদৌড়ি। কিন্তু সেকি সকল চিকিৎসক এর এক কথা মারুফ হরমন জনিত রোগে ভুগছে। তার সঠিক চিকিৎসা, এ দেশে সম্ভব নয়। তাকে দ্রুত লন্ডন বা সিঙ্গাপুরে নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। তারা আরও বলেন, এখন বয়ঃসন্ধিতে তার এই পরিবর্তন রোধ করা না গেলে, সে তৃতীয় লিঙ্গের রুপ ধারন করতে পারে। এ সব কথা শুনে মারুফের পিতা-মাতার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। তাদের খাওয়া, নাওয়া ঘুম হারাম হয়ে যায়। অন্যদিকে মারুফের ভেতর বেশ পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, মারুফ কথা বলে মেয়েদের মতো তার চালচলনও কিছুটা মেয়েলি। বড্ড চিন্তায় পড়ে যায় পরিবারের সবাই। লজ্জা ও সামাজ থেকে মারুফ কে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা শুরু হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় তার স্কুলে যাওয়া। নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় বাইরে বের হওয়ার ব্যাপারে। বিষয় গুলি মারুফ মেনে নিতে পারেনা, তাই তো বদ্ধ ঘরে নিজেই নিজের সাথে যুদ্ধ শুরু করে।
বেশ কিছু দিন স্কুলে আসেনা মারুফ। সহপাঠীরা তাকে বেশ মিস করছে। পারু বেশ চিন্তিত তার স্কুলে যেনো মন বসছেনা, কেবলই তার মনে প্রশ্ন জাগে, কেনো মারুফ আসছে না, তবে কি সে অসুস্থ, নাকি অন্যকিছ। সহপাঠীদের সাথে একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় স্কুল ছুটির পর সবাই মারুফের বাসায় যাবে। যে কথা সেই কাজ। দল বেধে সবাই এসেছে মারুফদের ভাড়া বাসায়, সকল সহপাঠীদের একসাথে দেখে মারুফের মা বড্ড চিন্তায় পড়ে গেলো, ওরা তো ছেলের সাথে দেখা করতে চাইবে, তখন কি বলবো। আগপাছ না ভেবে মারুফের মা, জাহানারা বেগম দ্রুত পাশের রুমে নিয়ে মারুফকে তালাবদ্ধ করে রাখে, আর বলেন তোমার স্কুলের বন্ধুরা আসেছে ওরা না যাওয়া পর্যন্ত কোনো কথা বলবেনা। চুপচাপ এখানে শুয়ে থাকবে। মারুফ মায়ের কথায় প্রতিবাদ করে বলে, কেনো মা, আমার কি দোষ তোমরা আমাকে স্কুলে যেতে দেবেনা, বন্ধুদের সাথে খেলতে যেতে দেবেনা, এমনকি আমার বন্ধুরা এসেছে তাদের সাথেও দেখা করতে দেবেনা....
সন্তানের এমন প্রশ্ন শুনে জাহানারা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন, শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোয়াল বেয়ে নেমে পড়া অশ্রুজল আলতো করে মুছে বলে, বাবারে তোর শরীরের এই পরিবর্তন আমাদের সমাজ মেনে নেবেনা। সবাই তোকে টিটকারি করবে, আজেবাজে কথা বলবে। সমাজে আমরা মুখ দেখাতে পারবোনা, সবাই তোকে কেন্দ্র করে যানা তাই বলবে। এ কারনেই সঠিক চিকিৎসা না হওয়া পর্যন্ত তোকে সবার অলক্ষে থাকতে হবে। আলতো করে মুছে বলে, বাবারে তোর শরীরের এই পরিবর্তন আমাদের সমাজ মেনে নেবেনা। সবাই তোকে টিটকারি করবে, আজেবাজে কথা বলবে। সমাজে আমরা মুখ দেখাতে পারবোনা, সবাই তোকে কেন্দ্র করে যানা তাই বলবে। এ কারনেই সঠিক চিকিৎসা না হওয়া পর্যন্ত তোকে সবার অলক্ষে থাকতে হবে।
মারুফ মায়ের কথা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, তার মা রুম থেকে বের হয়ে দরজা দিতেই বলে ওঠে, মা....
আমার শারিরীক এই পরিবর্তন জন্য তো আমি দায়ি নই, বা তোমাদের ও কোনো হাত নেই তবে কেনো আমাকে সবার অলক্ষ্যে থাকতে হবে। জাহানারা বেগম সন্তানের এমন কথা শুনে দৌড়ে এসে সন্তান কে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে বাবারে তোর প্রশ্নের উত্তর আমার জানানেই, তবে আমি জানি এ সমাজ তোকে গ্রহন করবেনা ফলে তোকেও আমাদের ছেড়ে চলে যেতে হবে অন্যএক জগতে। যে জগতে অবহেলা, বঞ্চনা এমন কি পরমুখাপেক্ষী হয়ে বাঁচতে হবে। তোর এই পরির্বতন জানাজানি হলে সমাজের তৃতীয় লিঙ্গ অর্থাৎ হিজড়া সম্প্রদায় লোকেরা তোকে আমাদের বুক থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে, যার কষ্ট আমি বা তোর বাবা সজ্জ করতে পারবোনারে বাবা...
একবুক চাপা কষ্ট নিয়ে জাহানারা বলে, বাবারে তোর এই পরিবর্তন সমাজ ভাল চোখে দেখবেনা, তা ছাড়া তোর বন্ধুরা জানতে পারলে ওরা তোর থেকে দুরে সরে সরে যাবে। আমরা দারিদ্র্যেরতার নিম্নে বসবাস করছি ইচ্ছা থাকলে তোর উপযুক্ত চিকিৎসা করাতে ব্যর্থ তার পরেও আমরা তোর পিতা মাতা তোর যতই পরিবর্তন সাধিত হোকনা কেনো আমরা তো তোকে হারাতে চাইনা।
সন্তান কে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে কথা বলার মাঝেই বারংবার কলিংবেলের আওয়াজ আসছিলো জাহানারার কানে। ছেলে রেখে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে এসে দরজা খুলতেই অবাক হয়ে যায় সে.....
স্কুল থেকে মারুফের সহপাঠী সবাই আজ এসেছে, ওরা সবাই জানতে চায় কেনো মারুফ স্কুলে যাচ্ছেনা, কথা বলতে বলতে একএক করে সবাই ঘরে প্রবেশ করতে থাকে, জাহানারা বেগম ওদের দিকে অপলক নয়নে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কি বলবে তা যেনো ভেবে পাচ্ছেনা। এরই মধ্যে পারু এসে প্রশ্ন করে আন্টি মারুফ কই ওকে ডাকুন, বেশ কয়েকদিন স্কুলে যাচ্ছেনা, কি হয়েছে ওর, ওকি অসুস্...?
পারুর প্রশ্ন শুনে জাহানারা যেনো বাকরুদ্ধ কি বলবে কি বলবেনা ভাবতে থাকে। রুবেল, নয়ন, তমালিকা ওরা প্রশ্নের পর পশ্ন করে যাচ্ছে কিন্তু কোনো উত্তর পাচ্ছেনা। এক সময় পারু এসে জাহানারার হাত ধরে বলে আন্টি ডাকুন না মারুফকে...
জাহানারা যেনো আঁতকে উঠলো, শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখের কোনা বেয়ে নির্গত জল মুছে পারুর মাথায় হাত রেখে বললো মা তোমরা বোসো আমি তোমাদের জন্য জল খাবারের ব্যবস্থা করছি কথা শেষ না হতেই তমালিকা বলে উঠলো, খালাম্মা আমরা কিছুই খাবনা আপনি মারুফকে ডাকুন....
জাহানারা ভেতরের রুমে যাওয়ার সময় কথা গুলো শুনে থমকে দাড়িয়ে বলে মারে মারুফ তো বাসায় নেই ওতো দিন দশেক হলো মামার বাড়িতে গেছে, অবশ্য ওখানে মারুফ মাস খানেক থাকবে। কথা শেষ হতেই রুবেল বলে উঠলো এই তোরা ওঠ চল আমরা যাই, মারুফ আসলে না হয় আরেক দিন আসবো। কথা শেষ না হতেই একএক করে সবাই উঠে দাঁড়ায় পারু বসে কি যেনো ভাবতে থাকে। জাহানারা বলে উঠলো না না তোমরা উঠোনা আমি তোমাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করছি। কিন্তু কে শোনে কার কার কথা যে যার মতো একে একে রুম থেকে বের হতে থাকে।
অন্য দিকে বদ্ধ ঘরে বসে মারুফ সব কিছু শুনতে পেলেও কিছুই যেনো করার নেই। মাঝেমধ্যে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় আমি এখানে মামার বাড়ি যায়নি, মা মিথ্যা বলেছে.... কিন্তু তা সে বলতে পারেনা। তাই একা বসেবসে চোখের জল ফেলতে থাকে। অন্যদিকে একএক করে সবাই চলে গেলেও পারু আর তমালিকা বসে রইল। মারুফ ছোএো বেলা থেকেই তেলাপোকা কে বেশ ভয় পেতো তাই জাহানারা ও চিন্তিত এই বুঝি ছেলে তেলাপোকা দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠে, তবে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। জাহানারা ভাবে ওরা দুজন যাচ্ছেনা কেনো। এক পা দুপা করে জাহানারা এগিয়ে এসে রুপার মাথায় হাত রেখে বলে মারে ওরা সবাইতো চলে গেলো....
পারু দির্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে ঠঠলো আন্টি আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে মারুফ এখানেই আছে, আমি যেনো ওর প্রতিটি নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ওর কথা শুনে জাহানারা মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, জাহানারা কিছু একটা বলতে যাবে এরই মধ্যে মারুফ চিৎকার দিয়ে উঠলো, মা......ঐ দেখো তেলাপোকাটা গুলো আমার দিকে ছুটে আসছে......
জাহানারা মারুফের চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই পিছপিছ ছুটে আসে পারু আর তমালিকা....
মারুফ ভয়ে মায়ের বুকের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায়, পারু তৎক্ষনাৎ বলে ওঠে আন্টি আপনি আমাদের মিথ্যা বকলেন কেনো....? তার এমন প্রশ্ন শুনে জাহানারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এক পর্যায়ে মারুফ কে ওদের সামনে দাঁড় করিয়ে বলে দেখোতো তোমরা তোমাাদের মারুফকে চিনতে পারো কিনা...?
তমা আর পারু অবাক দৃষ্টিতে মারুফকে দেখতে থাকে, সেকি এতো দেখছি আমাদের মতোই গায়ে পায়ে.... মারুফ এবার ওদের বলে তোরা এসেছিস আমি খুশি হয়েছিরে... জানিস আমি এখন বন্দিজীবন যাপন করছি।
তমালিকা যদিও এ পরিবর্তন দেখে মনে মনে যেনো হাসছে যা পারুর দৃষ্টি এড়াতে পারেনি, তাই সে বলে উঠলো এতে তোর কি দোষরে মারুফ তুই আমাদপর বন্ধু ছিলি থাকবি। তা ঘরে বন্দী হয়ে থকতে হবে কনো? প্রকৃতির উপরতো কারো হাত নেই...
তার কথা শুনে জাহানারা নলেন মারে তেমরা যদি তোমাদের বন্ধুকে এতোটুকুও ভালবেসে থাকো তো মারুফের এই পরিবর্তনের কথা কাউকে জানিওনা। এ ভাবে চলতে থাকে কথাবার্তা এক সময় ওরা ও ফিরে যায় নিজনিজ বাড়িতে।
দিন যায় মাস যায় মারুফের সু চিকিৎসা আর হয়না অর্থের অভাবে। আর গোপন থাকেনা তার এই পরিবর্তনের কথা। অবশেষে লাজ লজ্জা দুরে সরিয়ে সমাজের ভয় ভিতিকে উপেক্ষা করে মারুফ বেরিয়ে আসে নতুন পরিচয়ে। অন্যদিকে মারুফের সন্ধান পেয়ে তাকে তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের লোকেরা একের পর এক বাড়িতে আসতে থাকে। হিজড়া সম্প্রদায় তকে না দেওয়ায় দিতে থাকে হুমকি ধামকি। সমাজও ভাল চোখে দেখেনা মারুফকে। মারুফের জন্যই গ্রামের নানান জন মারুফের মাবাবা কে আজেবাজে কথা বলতেও পিছপা হয়না।
যদিও মাঝে মধ্যে পারু ওদের বাড়িতে আসে, সঙ্গদেয় মারুফের সাথে। অভয় দেয় তাকে কিন্তু কি করবে মারুফ ভেবে পায়না। সমাজের মানুষের আজেবাজে মন্তব্য মা বাবার কষ্ট সব মিলিয়ে মারুফের জীবনটা বিষিয়ে ওঠে। এক সময় সে সকলকে মুক্তি দিতে পিতামাতার অমতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বাদ্ধ হয়। সন্তানকে হারিয়ে মারুফের পিতা-মাতার দিন গুলি যেমন কষ্টে কাটছে...তেমনি কষ্ট পাচ্ছে প্রিয় বন্ধু পারু.....
আজ মারুফ হিজড়া সর্দার রুহিতনের আনৃডারে অপরেশন করিয়ে তৃতীয় লিঙ্গ ধারন করে ওদের সমাজে মারুফা হয়ে মিশে গেলেও অতীত তাকে হাতছানি দিয়ে কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। বস্তবতা মেনে নিয়ে মারুফ মারফা হয়ে গান বাজনা আর হিজড়াদের সাথে তাদপর সমাজে বেচে থাকার নিরলস চেষ্টা করে চলছি প্রতিনিয়ত.......