21/08/2025
বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান: বিস্তৃত জীবনকথা
পরিচিতি
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান (১৯৪১–১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অনন্য বীর। তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর (PAF) প্রশিক্ষক পাইলট হয়েও জীবনবাজি রেখে একটি T-33 জেট নিয়ে পূর্ববাংলায় (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) যোগ দিতে চেয়েছিলেন। সেই অভিযানে তিনি শহীদ হন এবং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাহসিকতা পদক “বীরশ্রেষ্ঠ” লাভ করেন। 
জন্ম ও শৈশব
অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে তাঁর জন্ম ২৯ অক্টোবর ১৯৪১; জন্মস্থান পুরনো ঢাকার আগা সাদেক রোডের ১০৯ নম্বর বাড়ি ‘মোবারক লজ’। (কিছু সূত্রে ২৯ নভেম্বরও উল্লেখ আছে; জন্মতারিখ নিয়ে সামান্য মতভেদ রয়েছে।) পৈতৃক নিবাস নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার রামনগর গ্রাম। প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে, পরে ওয়েস্ট পাকিস্তানের সারগোধা PAF পাবলিক স্কুলে পড়েন।   
সামরিক জীবন
১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তান এয়ার ফোর্স একাডেমি (রিসালপুর)–এ যোগ দেন; ২২ জুন ১৯৬৩ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে করাচির মরিপুর (বর্তমান মাসরুর) এয়ারবেসের নং–২ স্কোয়াড্রনে পোস্টিং পান। সেখানেই T-33 জেটে জেট কনভার্সন সম্পন্ন করেন, পরে F-86 স্যাবরে ফাইটার কনভার্সনও শেষ করেন। 
১৯৭১: দেশপ্রেমের প্রকাশ
১৯৭১–এর মার্চে অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলে তিনি ঢাকায় এসে সাধারণ তরুণদের নিয়ে বৈরাব অঞ্চলে একটি প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তোলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন—পরে করাচিতে পরিবারসহ ফেরত যেতে বাধ্য হলেও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যোগদানের সংকল্প করেন। 
‘টি-৩৩’–এর ঐতিহাসিক অভিযান (২০ আগস্ট ১৯৭১)
করাচির মাসরুর ঘাঁটি থেকে নবীন পাইলট অফিসার রশিদ মিনহাসের একক প্রশিক্ষণ ফ্লাইটে ওঠেই তিনি বিমানটি ভারতের দিকে ঘোরান—উদ্দেশ্য ছিল সীমানা অতিক্রম করে পূর্বাঞ্চলে যোগ দেওয়া। মাঝআকাশে ককপিটের দ্বৈত কন্ট্রোলে টানাটানির মধ্যে মিহনাস ক্যানপি জেটিসন করলে অসংবদ্ধ সিটবেল্টের কারণে মতিউর রহমান বাইরে ছিটকে পড়েন। T-33টি পাকিস্তানেই ভূপাতিত হয়; দুজনই নিহত হন। পাকিস্তান মিনহাসকে নিসান-ই-হায়দার দেয়, বাংলাদেশ মতিউর রহমানকে দেয় বীরশ্রেষ্ঠ। 
মরদেহ, প্রত্যাবর্তন ও দাফন
দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে তাঁর মরদেহ করাচির মাসরুর ঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণির কবরস্থানে পড়ে ছিল। বিস্তর কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর ২৪ জুন ২০০৬–এ তাঁর কফিন ঢাকা পৌঁছায়; রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ২৫ জুন মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পুনর্দাফন করা হয়।   
ব্যক্তিজীবন ও উত্তরাধিকার
স্ত্রী মেলি (মিলি) রহমান; তাঁদের দুই কন্যা—মাহিন (মাহিম/মাহিন) ও তুহিন (তুহিন/তুহিনে) সম্পর্কে সংবাদসূত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁর স্মরণে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যশোর ঘাঁটির নাম “বিএএফ বেস মতিউর রহমান”, আরও নানা পুরস্কার/স্টেডিয়াম নামাঙ্কন হয়েছে। তাঁর জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র ও নাট্যচিত্র নির্মিত হয়েছে।  
কেন তিনি ‘বীরশ্রেষ্ঠ’
• নিজের পেশা, ক্যারিয়ার ও প্রাণ—সবকিছু বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে রণকৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
• দখলদার রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিতর থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সাহসিকতা দেখিয়েছেন—যা বিরল।
• তাঁর অভিযানের প্রতিটি ধাপ তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম, শৃঙ্খলা ও আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা জাগায়। 
⸻
দ্রুত তথ্য (সংক্ষেপে)
• জন্ম: ২৯ অক্টোবর ১৯৪১ (কিছু সূত্রে ২৯ নভেম্বর) — পুরনো ঢাকা, আগা সাদেক রোড; পৈতৃক নিবাস: রায়পুরা, নরসিংদি।  
• কমিশন: ২২ জুন ১৯৬৩; নং–২ স্কোয়াড্রন, মরিপুর/মাসরুর, করাচি। 
• শহীদত্ব: ২০ আগস্ট ১৯৭১, T-33 দুর্ঘটনা, ঠাঠ্টা (সিন্ধ)।  
• পুনর্দাফন: ২৫ জুন ২০০৬, শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, মিরপুর, ঢাকা।