14/07/2024
মুহাম্মদ বিন তুঘলক
মুহাম্মদ বিন তুঘলক। শাসনকাল ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর কর্মকান্ড থেকেই “তুঘলকি কান্ড” প্রবাদটির জন্ম হয়েছে। কেন এমনটা বলা হয়। তার অসাধারণ সব পরিকল্পনার জন্যে। অনেকের কাছেই তার পরিকল্পনাগুলো অসম্ভব, অবাস্তব এবং পাগলাটে ধরনের মনে হয়েছে। কিন্তু আসলেই কি ব্যাপারটা এরকম। শুরুতেই একটা কথা বলে রাখছি। মুহম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন অসময়ে জন্মানো সময়ের সবচেয়ে সাহসী সন্তান। তৎকালীন জনগোষ্ঠী যারা ঐ সময়ের গতানুগতিক জীবনধারায় অভ্যস্ত এবং আরামপ্রিয় আমির ওমরাহদের কাছে তাই এমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক।
মুহাম্মদ বিন তুঘলক অনেকগুলো মহা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। তার সেই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে তা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা করা হয়। কিন্তু কেউ কি একবারও খতিয়ে দেখেছেন তুঘলকের এই সব পরিকল্পনার মূলে কি ছিলো। আমরা আজকের এই আলোচনায় এই সব মহা পরিকল্পনার একটা একটা করে চুলছেড়া বিশ্লেষণ করে দেখাবো তিনি কতোটা দূরদর্শী ও প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। মূলতঃ সমস্যা যা হয়েছিলো তাকে বোঝার, অনুসরণ করার বা সঙ্গ দেওয়ার মতো কেউ তখনকার সময়ে ছিলো না।
তুঘলকের যে পরিকল্পনাটির সবচেয়ে বেশী সমালোচনা করা হয় তা হলো দেবগিরি অর্থাৎ দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তর। ভারতের মানচিত্রের দিকে যদি লক্ষ্য করেন দেখবেন দিল্লী একটা প্রান্তে অবস্থিত। কোন মুসলিম শাসকই দিল্লী থেকে সরে এসে ভারতের কেন্দ্রবিন্দুতে রাজধানী স্থাপন করে পুরো ভারতের উপর কর্তৃত্বকে সমভাবে বিস্তারের মতো সৎসাহসের অধিকারী ছিলেন না। এমনকি মহামতি আকবরও সেই সৎসাহস দেখাননি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। উত্তর ভারতে মুসলিম প্রাধান্য থাকলেও মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে মুসলমানদের তেমন কোন বিস্তার হয়নি। অন্যান্য সকল শাসকই অভিযান চালিয়ে কোন একটা দূরবর্তী এলাকা জয় করলেও আবার দ্রæত ফিরে গেছেন রাজধানীতে। এতে সুদূরপ্রসারী কোন প্রভাব পড়েনি। আর এ কারনেই পরবর্তীতে আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য অভিযানেই তার জীবনের একটা বড় সময় ও শাসনকালের বলতে গেলে একটা বিরাট অংশই ব্যয় করতে হয়েছে। অর্থও ব্যয় হয়েছে অনেক। কিন্তু তেমন কোন ফললাভ হয়নি। কারণ ততদিনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তুঘলকের সময়কাল ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ আর আওরঙ্গজেবের সময়কাল ১৬৫৮ থেকে ১৭০৭। এই সময়কাল দুটোর মধ্যে ৩০০ বছরের ব্যবধান।
তুঘলক চেয়েছিলেন ভারতের কেন্দ্রবিন্দু দৌলতাবাদে সদলবলে থেকে ধীরে ধীরে চারপাশের এলাকায় ইসলামী সংস্কৃতির বিস্তার করতে। কিন্তু এমন করে অন্য কেউই এটা উপলব্ধি করতে চাননি। কারণ তাতে কষ্ট ক্লেশ সহ্য করা ও ত্যাগ তিতিক্ষার প্রয়োজন ছিলো। এটা করার জন্যে অনেকেই তৈরী ছিলো না।
সেদিন যদি তুঘলকের পরিকল্পনা সফল হতো আজ ভারতের রাজনৈতিক চিত্র অন্যরকম হতে পারতো। হিন্দু পন্ডিত ও ঐতিহাসিকরা তাই তার ব্যর্থতা নিয়ে উপহাস করে পরবর্তী সকল মুসলিম শাসকদের নিরুৎসাহিত করেন। আর তাই কোন স¤্রাটই এই ঝুঁকিটি নিয়ে উপহাসের পাত্র হতে চাননি। তারা শুধু ঐ সব পরিকল্পনাই হাতে নিয়েছেন যাতে বাহবা মেলে। একথা তো আমরা জানি, মহামানবরা বলে থাকেন, তোমার পরিকল্পনা নিয়ে যদি কেউ হাসাহাসি না করে, জেনে নিও, এটা কোন বড় বা মহৎ পরিকল্পনাই না। তুঘলকের পরিকল্পনা নিয়ে যেহেতু অনেক কথা হয়, স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় তার পরিকল্পনা বড় ও মহান ছিলো। ছিলো সুদূরপ্রসারী। তবে তিনি সফল না হলেও তিনি যে ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন তার পথ ধরে অন্যরা হাঁটতে পারতেন। কিন্তু কারও সেই সুমতি হয়নি। অতোটা দূরদর্শীও কেউ আসেননি। আর আজও তাই প্রায় আটশত বছর রাজত্ব করার পরও ভারতে মুসলমানরা পশ্চাৎপদ। এর দায় শুধু হিন্দুদেরই নয়, মুসলমানদের নিজস্ব ব্যর্থতাও কম কিছু নয়। পরবর্তীতে ইংরেজ আগমনের পর চতুর ইংরেজরা মুসলমানদের এই সব ব্যর্থতা চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়েছে। তারা রাজ ক্ষমতায় না থাকা পিছিয়ে পড়া সংখ্যাগুরু হিন্দুদের কাছে টেনেছেন এবং পদ ও অর্থের লোভ দেখিয়ে গোলাম বানিয়ে কার্য হাসিল করেছেন। আর দীর্ঘ শতাব্দী ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা মুসলমানরা হয়েছে পদদলিত, পদপিষ্ট, অপমানিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত। অথচ মুহাম্মদ বিন তুঘলকের পরবর্তী শাসকরাও যদি তার এই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার গূঢ়ার্থ বুঝতে পারত এবং একটু একটু করে সামনে আগাত ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতো তাহলে ১৮৫৭ সালে এসে মোঘল সা¤্রাজ্যের কর্তৃত্ব শুধুমাত্র দিল্লীতে রাজপ্রাসাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো না।
অতএব, সবদিক দিয়ে লক্ষ্য করলে বলা যায়, মহান ও সুদূরপ্রাসারী পরিকল্পনা যদিও আপাতদৃষ্টে অসম্ভব ও কষ্টসাধ্য মনে হয় কিন্তু তার ফল মধুর হয়। মাটির উপর রক্ত না ঝরলে কোন স্বপ্নই গাছ হয়ে গজিয়ে ওঠে না। তুঘলকের ব্যর্থতার সমালোচনা নয় বরং পরবর্তীতে মধ্য ভারত ও দক্ষিণ ভারতে মুসলমানদের শক্তিশালী ঘাঁটি না হওয়ার কারণও অন্যান্য শাসকদের এই সব অঞ্চলে ইসলামী শাসনকে স্থায়ীত্ব দানে ব্যর্থতা। আর এর ফলে পরবর্তীতে যখন রাজপুত ও মারাঠাদের উত্থান হয় এবং বিশেষ করে মারাঠাদের হাতের পুতুলে পরিণত হয় দিল্লীর মুসলিম শাসকরা তখনকার দুরাবস্থা এতোটা শোচনীয় হয় যে আফগানিস্তান থেকে আহমদ শাহ দুররানীকে ভারতের মুসলমানদের রক্ষা করতে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের অবতারণা করতে হয়। ১৭৬১ তে সংঘটিত হওয়া এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ও মীমাংসাজনক যুদ্ধে মারাঠাদের তিনি এমন মার মারেন যে, পরবর্তীতে তারা আর মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। নইলে তাদের উৎপাত যে হারে বেড়েছিলো তাতে মুসলমানদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন ছিলো। এখানে উল্লেখ করে রাখতে চাই, বাংলার নবাব আলীবর্দী খাঁও বাংলায় অত্যাচার করা বর্গীদের কৌশলে পরাজিত করে বাংলার মানুষদের বর্গীদের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পন্ডিতকে হত্যা করে তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেন এবং পরবর্তীতে তাড়িয়ে বাংলা থেকে বের করে দেন।
তুঘলকের দ্বিতীয় সমালোচিত পরিকল্পনা হলো খোরাসান অভিযান। তার সময়কালটা ১৩২৫ - ১৩৫১। ঐ সময়টায় মধ্য এশিয়ায় মঙ্গোলদের শাসন চলছিলো। ঐ এলাকাটা ছিলো মঙ্গোল ইলখানাটের অধীন। চেঙ্গিজ খানের পুত্র তলুই খানের প্রতিষ্ঠিত ইল খানাটের শাসক ছিলেন হুলাগু খান। হুলাগুর পর ক্ষমতায় বসেন আবাচা। তারপর একে একে তেকুদার, আরগুন, গায়খাতু, বায়দু, গাজান, ওলজায়তু ক্ষমতায় বসেন।
ওলজায়তুর সময়কালটা ছিলো ১৩০৪ থেকে ১৩১৬। তার স্থলাভিষিক্ত হন আবু সাঈদ। তিনি ছিলেন নবম ইলখানি শাসক। খোরাসান ছিলো তার অধীনস্ত। তার শাসনকাল চলেছিলো ১৩৩৫ পর্যন্ত। ভারতীয় শাসকদের জন্যে এই ইলখানাটে এলাকাটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কারণ মধ্য এশিয়ার জটিল রাজনীতির উপর ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক কিছুই নির্ভর করতো। আমরা সবাই অবগত আছি যে, পরবর্তীতে এই এলাকা থেকেই উদ্ভব হয় মানুষ মারার যন্ত্র তৈমুর লঙের। তার জীবনকাল হলো ১৩৩৬ থেকে ১৪০৫। তার রাজধানী ছিলো সমরকন্দ। এটা ছিলো খোরাসানের পাশর্^বর্তী এলাকা। পরবর্তীতে তৈমুর লঙ পুরো এশিয়া জুড়ে তান্ডব চালান। সেদিন যদি মুহাম্মদ বিন তুঘলক মধ্য এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্থান খোরাসান জয় করতে পারতেন তাহলে তৈমুর লঙের উত্থানটাই হয়তো চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে যেত। এই ধরনের দূরদর্শী চিন্তাভাবনা করা কেবলমাত্র মুহাম্মদ বিন তুঘলকের দ্বারাই সম্ভব হয়েছিলো যা অন্য কারো পক্ষে কল্পনারও বাইরে ছিলো। মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসন কালটা সত্যিই একটা ঐতিহাসিক ক্রান্তিকাল ছিলো। তার সিদ্ধান্তগুলো যে কতোটা সুদূরপ্রসারী, দূরদর্শী ও সময়োপযোগী ছিলো তা পরবর্তীকালে যারা ইতিহাসের নিরপেক্ষ বিশ্লেষক ছিলেন তাদের বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়। মুহাম্মদ বিন তুঘলক এসব দৈবভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন।
তৈমুর লঙের শাসনকাল ছিলো ১৩৭০ থেকে ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দ। আর আগেও উল্লেখ করেছি মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শানকাল ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দে। স্বাভাবিকতাই তুঘলক এগিয়ে ছিলেন। ইলখানী শাসকদের ব্যর্থতার ফলেই তৈমুর লঙের উত্থান সম্ভব হয়েছিলো। আর ইলখানি শাসকদের ব্যর্থতা লক্ষ্য করেই মুহাম্মদ বিন তুঘলক খোরাসান দখল করতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন ইলখানি শাসক আবু সাঈদ একটা সময় অর্থাৎ ১৩১৫ থেকে ১৩১৬ সময় কালটাতে খোরাসানের গভর্নরও ছিলেন। পরবর্তীতে ১৩১৬ থেকে ১৩৩৫ পর্যন্ত তার সময়কালটাতে খোরাসান তারই অধীনে ছিলো।
তৈমুর লঙের শুরুটা হয়েছিলো মঙ্গোলদেরই একটা এলাকা চাগাতাই খানাটে দখল করার মাধ্যমে। পরবর্তীতে তিনি ধীরে ধীরে চারিপাশের্^ সা¤্রাজ্য বিস্তার করে অবশেষে একসময় ভারতে এসে পৌঁছান এবং দিল্লী বিধ্বস্ত করেন। অথচ এই কাজটাই মুহাম্মদ বিন তুঘলক তারও অনেক আগেই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের কাছে তা হাস্যকর লাগলো।
তার পরবর্তী পরিকল্পনাগুলো ছিলো তা¤্র মুদ্রার প্রচলন, চীন অভিযান ও দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধি। এগুলোও সমালোচনার সম্মুখীন হয়। মুদ্রা প্রচলনের কথায় আসি। তিনি তা¤্র মুদ্রা প্রচলন করতে চেয়েছিলেন বলে তার সমালোচনা করা হয়। অথচ তখন চীনে কাগজের মুদ্রার প্রচলন ছিলো। অথচ সেটা তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো। আর আমাদের এই উপমহাদেশের মানুষের অসততা, অসহিষ্ণুতা, অস্থিরতা, অসাধুতা ও অসহযোগিতার কারণে তার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। মূলতঃ সদিচ্ছার অভাবেই এই পরিকল্পনাটাও ব্যর্থ হয়।
চলবে