03/07/2025
. একদিন রাত্রিবেলা বাঁধের ধারে বাঁশের মাচাং- এর উপর তিনি শুয়ে আছেন। কেষ্টদার কোলের উপর মাথাটি ন্যস্ত ক'রে দিয়েছেন। আশেপাশে কোন লোক নেই। একান্ত নিভৃতে আলাপ-আলোচনা চলছে। মাথার উপর নক্ষত্রখচিত কালো আকাশ। চতুর্দিক অন্ধকারে ঢাকা। আলাপ-আলোচনার মধ্যেই কেষ্টদা সেদিন জিজ্ঞাসা করলেন- সবাই বলে আপনি ভগবান। লোকে যাঁকে ভগবান ব'লে মানে, ভগবান ব'লে জানে, সেই তাঁর মুখ থেকেই আমার শুনতে ইচ্ছে করে, সত্যই কি আপনি ভগবান?
এই প্রশ্ন ঠাকুরের কাছে কতবার তোলা হয়েছে। তিনি কেমন ক'রে যেন কেবলই পাশ কাটিয়ে গেছেন। ভগবান কথার ধাতুগত অর্থ কি, কিভাবে শব্দটা নিষ্পন্ন হয়েছে, ভগবান মানে ভজমান, ইত্যাদি কত কি আলোচনা ক'রে, প্রশ্নকর্তার আসল জিজ্ঞাসাটা কৌশলে তিনি এড়িয়ে গিয়ে নিজের পরিচয়টা প্রচ্ছন্ন রাখতে বরাবর চেষ্টা করেছেন। কেষ্টদা নিজেও কি তা জানেন না? তাঁর সামনেই তো কতবার এ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সেদিন তাঁরই বা কি হ'ল। সেই বহু উচ্চারিত পুরাতন জিজ্ঞাসাটি আবার ঠাকুরের সামনে একান্তে তু'লে ধরলেন- 'আপনি কি ভগবান?'
প্রশ্ন শোনার সঙ্গে-সঙ্গে ঠাকুরের দৃষ্টি প্রখর হয়ে উঠলো, তীব্র চক্ষে কেষ্টদার দিকে তাকিয়ে থেকে প্রত্যয়দৃঢ় কণ্ঠে সমস্ত শক্তি দিয়ে ব'লে উঠলেন- হ্যাঁ, আমিই সেই। এই জবাব শোনার সঙ্গে-সঙ্গে কেষ্টদার সারা দেহে একটা অভূতপূর্ব তীব্র শিহরণ ব'য়ে গেল। যদিও তাঁর সম্বন্ধে এমন একটা ধারণা মনের মধ্যে বরাবরই ছিল, কিন্তু তাঁরই মুখ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা শোনার সঙ্গে-সঙ্গে কেমন একটা শঙ্কামিশ্রিত অনুভূতি, একটা অজানা ভয় ও ত্রাস তাঁকে এমন আচ্ছন্ন ক'রে ফেলল যে অত বড় নাস্তিক এবং দক্ষ কূটতার্কিক তিনিও বাক্যহারা হ'য়ে স্তব্ধ বিস্ময়ে শঙ্কিত দৃষ্টি মেলে ঠাকুরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেই অচিন্ত্যনীয় শক্তির সত্যিকারের অধিকারীর কণ্ঠ থেকে যখন সত্য ঘোষণা বেরিয়ে আসে, তখন তা' এমন দুর্বার শক্তি নিয়ে নির্গত হয় তাকে আর কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না।
কেষ্টদার মুখে শুনেছি, তিনি বলছিলেন ভাই, এ তো শুধু তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত একটি শব্দ মাত্র নয় এ যেন একটি শব্দকে ভর ক'রে বিশ্বাত্মার নিজের স্বরূপ উদ্ঘাটন, তাঁর আত্মপ্রকাশ। তার শক্তি যে কি প্রচণ্ড এবং অমোঘ, সে-ধ্বনি যে কি বাত্ময় এবং অন্তর্ভেদী, সে ব্যঞ্জনা কি দৃপ্ত এবং ভীষণ, সে অভিব্যক্তি কি সুন্দর এবং ভয়াল যে বিশ্বাস- অবিশ্বাসের কোন প্রশ্নেরই সেখানে অবকাশ নেই, শুধু এই বোধটাই জেগেছিল, আমি একান্ত নিরালা নিভৃতে সেই নিস্তব্ধ, নিশীথ রাত্রে এমন একজন মানুষের দেহ স্পর্শ ক'রে ব'সে আছি, যিনি আমাদের বিচার-বুদ্ধি, হিসেব-নিকেশ, যুক্তি-তর্ক, অনুমান-প্রমাণ সব কিছুর উর্দ্ধে- যিনি মানুষ নন, যাঁর ঐ সার্দ্ধত্রিহস্ত পরিমিত দেহের মধ্যে সংহত হ'য়ে আছে ভগবৎ-সত্তা, তিনি মানুষের ভগবান।
ঠাকুরের শ্রীমুখে এই স্পষ্ট স্বীকারোক্তি শোনার পরেও ভয়ে-ভয়ে কেষ্টদা তখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, 'এই যে মাথার উপর এত সব গ্রহ-নক্ষত্র, এই যে সামনে পরিদৃশ্যমান বিশ্বজগৎ, এ সবকিছু তবে আপনি সৃষ্টি করেছেন?
ঠাকুর অত্যন্ত সহজ কণ্ঠে উত্তর দিলেন হ্যাঁ।
কেষ্টদা তারপরেও জিজ্ঞাসা করেন, 'আপনি ইচ্ছে করলে এ সবকিছু নষ্ট করেও ফেলতে পারেন?'
ঠাকুর বললেন, হ্যাঁ, পারি।
------ কিন্তু কই নষ্ট তো করেন না।
------ইচ্ছে করে না, তাই।
অর্থাৎ, ইচ্ছা করলে যে কোন মুহূর্তে প্রলয় ঘটাতে পারেন।
কিন্তু বিধাতা যিনি তিনিও যে বিধানের মধ্যেই বিধৃত। বিশিষ্ট বিধানে বিধৃত হ'য়ে ব'য়ে চলেছে এই বিশ্বচক্র সেই বিধানের নিয়ামক এবং সংরক্ষক যিনি তিনিই বিধাতা। তবু এই বিধানেরও একটু-আধটু ব্যতিক্রম ঘটাবার প্রয়োজন মাঝে-মাঝে ঘটে বই কি? তা নইলে সংশয়াত্মা যারা তারা সংশয়মুক্ত হবে কেমন ক'রে?
~ ~ ~ চুনীলাল রায়চৌধুরী
তথ্যসূত্রঃ - আলোচনা # ফাল্গুন , ১৪৩১ / মার্চ , ২০২৫
Ashok sarkar
North 24 pargana
West Bengal