23/05/2025
“স্মৃতির পথ ধরে”-২
ঘুরে দাঁড়ানোর ঠিক পরের মুহূর্তটা যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে।
আরশার চোখে মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, কিন্তু চোখের গভীরে চলেছে এক অনবরত আলোড়ন। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা—আয়ান—একটু বদলে গেছে, হয়তো সময়ের ভারে, হয়তো অপরাধবোধে।
চারপাশে কৃষ্ণচূড়া ঝরছে নীরবে। পেছনে শহরের কোলাহল, সামনে একটা অসমাপ্ত গল্প।
আয়ান প্রথম বলে, “ভাবিনি তুই আসবি। অথচ প্রতিদিন ভেবেছি, যদি কোনোদিন আসিস, কী বলব তোকে।”
আরশা চুপ। তার চোখে এখনো কোনো অভিযোগ নেই, কেবল খুঁজে পাওয়া একরাশ বিস্ময়—এতদিন পরেও আয়ানকে দেখার ভেতরে যে অনুভব জেগে ওঠে, তা ভাষায় ধরা যায় না।
হাওয়ায় শাড়ির আঁচল উড়ে গিয়ে এক পাশে পড়ে। আয়ান নরম গলায় বলে, “তুই আগের মতোই আছিস।”
আরশা এবার বলে, “তুইও—একই কথা বলছিস, যেটা শুনতে শুনতে একসময় বিশ্বাস করতে ভয় পেতাম।”
একটা দীর্ঘ নীরবতা ছুঁয়ে যায় তাদের মাঝখান দিয়ে। সেই নীরবতায় ভেসে আসে পুরোনো দিনগুলোর ছায়া, ভুল বোঝাবুঝি, হারিয়ে ফেলা মুহূর্ত—আর একটা প্রশ্ন, যা আজ উত্তর চায়।
হঠাৎ চোখে পড়ে সেই জায়গাটা—পুকুর ঘাট, যেখানে একদিন আয়ানের সাথে সারাদিন ঘুরেছিল আরশা।
সেদিন বৃষ্টি হয়নি, তবু বাতাস ছিল মেঘলা। ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যরশ্মি খেলছিল জলরঙের মতো। কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে, আয়ান তখন হঠাৎ বলেছিল, “চল, আমি ছবি তুলি !”
আরশা প্রথমে না করেছিল। কিন্তু আয়ানের চোখে ছিল এমন একটা শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস, যে উচ্ছ্বাসের সামনে কোনো যুক্তি দাঁড়াতে পারে না।
সেইদিন, নীল-সবুজ রঙের লম্বা ফ্রকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল আরশা। শাড়ির আঁচলের মতো ওড়নাটা বাতাসে দুলছিল, চুলে একটা লাল ফুল, মুখে একরাশ হাসি।
আয়ান পেছনে দাঁড়িয়ে মোবাইল তুলে ধরে বলেছিল, “এই মুহূর্তটা ধরে রাখি। যদি তুই ভুলে যাস একদিন, আমি দেখাব।”
আরশা হেসে বলেছিল, “তুই যদি ভুলে যাও, আমি কাঁদব না... আমি আবার এমন করেই ঘুরে দাঁড়াব।”
তারা একসাথে হেসেছিল তখন।
এই ছবির মতোই—সবুজ পাতার ফাঁকে লুকানো এক চুপচাপ ভালোবাসা, দুধারে নিরব পাখির বসে থাকা, আর মাঝখানে দু’জন মানুষের মুগ্ধ সময়।
আজ এতদিন পর সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, আরশার মনে হয়, এইসব মুহূর্ত তো হারায় না... এরা থেকে যায়, পাখির পাখনায়, পাতার দোলায়, কিংবা কোনো পুরনো ছবির ভেতর...
আয়ান ভাঙা গলায় বলে, “আমার কি আর কোনো অধিকার আছে তোর পাশে দাঁড়ানোর?”
এইবার, আরশা চোখ তুলেই বলে ফেলে— “তুই যদি সত্যিটা বলতি, হয়তো থাকত। কিন্তু তুই নীরব ছিলি, যখন আমাকে সবচেয়ে বেশি জানতে হত।”
আয়ান এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর শুধু বলে, “আমি তোকে কষ্ট দিতে চাইনি, তাই চুপ ছিলাম।”
আরশা চোখ ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। তারপর নিচু গলায় বলে, “তুই জানিস, কষ্ট তখনই বেশি হয় যখন আমরা প্রশ্ন করতে পারি না। আমি কষ্ট পেয়েছি, কারণ আমি তোর নীরবতাকে ভুল করে নিজের দোষ ভেবেছিলাম।”
হাওয়ায় কৃষ্ণচূড়ার পাঁপড়ি উড়ে আসে। আয়ান কিছু বলতে যায়, কিন্তু আরশা থামিয়ে দেয়।
সে বলে, “আজ আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি তোকে ক্ষমা করে দিচ্ছি, আয়ান। কারণ আমি ক্লান্ত... আর এই গল্পটা আমি বুকের ভেতর নিয়ে চলতে পারছি না।”
আয়ান কিছু বলতে চায়, হাত বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু আরশা এক পা পিছিয়ে যায়। তার চোখে অদ্ভুত এক শান্তি, যেন দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষে সে নিজেকেই ফিরে পেয়েছে।
আরশা বলে, “তুই যদি কোনোদিন সত্যি ভালোবেসে থাকিস, তবে আমার মুক্তি তুইই চাইবি। আমি ভালোবাসা দিয়ে তোকে ধরে রাখতে চাই না, আমি ভালোবাসি বলে তোকে মুক্তি দিচ্ছি।”
তারপর ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে সে—পুরনো পথ ধরে, একা।
আয়ান দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে। তার চোখ থেকে একফোঁটা জল পড়ে মাটিতে। পেছনে কৃষ্ণচূড়ার গন্ধ, সামনে একা রিকশা চলে যায় ধীরে ধীরে।
হঠাৎ সেই একাকীত্বের মাঝে, আয়ানের ফোনে বেজে ওঠে একটা পুরনো রিংটোন—আরশার প্রিয় গান। হাত কাঁপতে কাঁপতে সে ফোনটা দেখে, স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটা মেসেজ:
"তুই একদিন যদি ফিরে আসিস, আমি ঠিক থাকব—অন্যভাবে, অন্য কারো জন্য নয়, নিজের জন্য।"
আয়ানের চোখে জল গড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ সে পেছনে তাকায়—আরশা তখন দূরে চলে গেছে....
আয়ান হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে।
চারপাশে ঝরা কৃষ্ণচূড়ার নিচে বসে, এক অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প শেষ হয়ে যায় না—সে রয়ে যায় বাতাসে, পাতায়, আর একটা ছুঁয়ে যাওয়া চিরন্তন নীরবতায়।
বহুদিন কেটে গেছে।
শহর বদলেছে, রাস্তাঘাটের চেহারা পাল্টেছে, তবু কিছু নাম—কিছু মানুষ—ভুলে যাওয়া যায় না। এক বিকেলের শেষ আলোয়, একা হেঁটে চলে আসা এক নারী থেমে দাঁড়ায় একটি ছোট বইমেলার স্টলের সামনে। তার পরনে সাদা-কালো ছাপার শাড়ি, চুলে হালকা পাক ধরা, চোখে ক্লান্তি আর তবু কোথাও এক গভীর আত্মস্থতা।
সে বইয়ের ঠাসা সারির মাঝে একটা বই টেনে নেয়।
"স্মৃতির পথ ধরে"
লেখক: আয়ান আহমেদ
কবিতা না গল্প, সে বুঝতে পারে না প্রথমে। কিন্তু ভেতরের পাতায় চোখ রাখতেই তার নিঃশ্বাস আটকে যায়।
প্রথম অধ্যায়: ফিরে দেখা এক সকাল
তার আঙুল কাঁপে। পাতার ফাঁকে শুকিয়ে রাখা একটি কৃষ্ণচূড়ার পাঁপড়ি খসে পড়ে।
সে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ। চারপাশে কোলাহল, মাইক থেকে ভেসে আসা ঘোষণা, লোকজনের হাঁটাচলা—সব কিছু থেকে দূরে, বইয়ের পাতার ভেতর যেন সে আবার ফিরে যায় সেই পুরোনো বিকেলে, সেই সিদ্ধান্তের মুহূর্তে।
একটা অদ্ভুত হাসি খেলে যায় তার মুখে।
সে বইটা কিনে নেয় না। কিছু না বলেই রেখে দিয়ে চলে যায়, শুধু স্টলের পাশের টেবিলে পড়ে থাকে কৃষ্ণচূড়ার সেই শুকনো পাঁপড়িটা।
কেউ খেয়াল করে না, কেউ জানে না—