26/08/2025
আপনার মাস্টার্স সার্টিফিকেটটা ছিঁড়ে ফেলুন! হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। যে কাগজ আপনার পেটের ভাত জোগাতে পারে না, আত্মসম্মান বাঁচাতে পারে না, সেই কাগজকে বুকে জড়িয়ে ধরে আর কতদিন কাঁদবেন? লজ্জা আপনার নয়, লজ্জা এই পচে যাওয়া সমাজের, যে আপনার মেধার দাম দিতে জানে না। বাবার হোটেলে খাচ্ছেন? বেশ করছেন! চোরের মতো নয়, রাজার মতো খান। কারণ এই সমাজ আপনার সাথে প্রতারণা করেছে।
আপনার হাতে ধরা ঐ দামি সার্টিফিকেটটা কি এখন একটা বোঝা মনে হচ্ছে? অনার্স-মাস্টার্সের সোনালী রঙের-এ বাঁধানো কাগজটা কি রাতের অন্ধকারে আপনাকে বিদ্রূপ করে? চারপাশের মানুষের প্রশ্নে জর্জরিত হতে হতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কি নিজেকেই প্রশ্ন করেন—"আমি কি সত্যিই অযোগ্য? আমার জীবনের কি কোনো দাম নেই?"
যদি এই প্রশ্নগুলো আপনার মগজের ভেতরে সারাদিন হাতুড়ি পেটায়, যদি সমাজের বিষাক্ত মন্তব্য আপনার আত্মবিশ্বাসকে সাপের মতো দংশন করে, তবে এই লেখাটি আপনার জন্য। প্রতিটি শব্দ আপনার ভেতরের জমে থাকা আগুনকে প্রকাশ করার জন্য।
আমরা এক অভিশপ্ত প্রজন্মের নাম, যারা পুঁথিগত বিদ্যায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেও বাস্তবতার কঠিন মাঠে পরাজিত সৈনিক। আমাদের অপরাধ? আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম, ভালো করে পড়াশোনা করলে, ভালো রেজাল্ট করলে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ পাওয়া যাবে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—সকলেই তো এই স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু আজ সেই স্বপ্ন ভাঙা কাঁচের মতো আমাদের পায়ে বিঁধছে। আর সমাজ? সেই সমাজই আজ আমাদের দিকে আঙুল তুলে বলছে, "এত পাশ করে কী লাভ হলো? বাবার হোটেলে বসে খাচ্ছে!"
কিসের লজ্জা? আমি ফারহানা হিসেবে আপনাকে সরাসরি প্রশ্ন করতে চাই, লজ্জাটা ঠিক কিসের? যে বাবা-মায়ের টাকায় আপনি পড়াশোনা করেছেন, আজ বিপদে পড়লে তাদের অন্ন গ্রহণ করাটা লজ্জা? নাকি লজ্জাটা সেই সিস্টেমের, যে লক্ষ লক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করে, কিন্তু তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে না? যে সমাজ আপনাকে চাকরি দিতে পারে না, সেই সমাজের খোঁটা শোনার কোনো নৈতিক দায় আপনার নেই। যে আত্মীয় আপনার বিপদের দিনে এক টাকা দিয়ে সাহায্য করেনি, সে যখন আপনার বেকারত্ব নিয়ে কুমিরের কান্না কাঁদে, তখন বুঝে নেবেন—এটা সহানুভূতি নয়, এটা পৈশাচিক আনন্দ।
একবার ভেবে দেখুন তো, এই সমাজ কতটা দ্বিচারী। যখন আপনি দিনরাত এক করে লাইব্রেরিতে পড়ে থাকতেন, তখন তারাই বলত, "আহা! ছেলেটা/মেয়েটা কত কষ্ট করছে, একদিন ঠিক বড় কিছু হবে।" আজ যখন সেই "বড় কিছু" হওয়ার দৌড়ে আপনি হোঁচট খেয়েছেন, তখন তারাই আপনার ক্ষতস্থানে নুন ছিটিয়ে দিচ্ছে। এই দ্বিচারিতাই আমাদের সবচেয়ে বড় মানসিক কারাগার। আমরা সমাজের চোখে "সফল" হওয়ার জন্য বাঁচি, নিজের জন্য নয়।
"কী করছো এখন?"—এই নিরীহ প্রশ্নটা এখন একটা ধারালো অস্ত্রের মতো লাগে। কারণ প্রশ্নকর্তা উত্তরটা জানে। সে আপনার অসহায়ত্ব দেখতে চায়, আপনার ভাঙা স্বপ্নকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে চায়। তাদের চোখে আপনি একজন "ব্যর্থ"। কিন্তু আমি ফারহানা বলছি, আপনি ব্যর্থ নন। ব্যর্থ এই সমাজ, এই কাঠামো, যা মেধার মূল্যায়ন করতে জানে না, যা আপনাকে শুধু একজন কর্মচারী হওয়ার শিক্ষা দিয়েছে, উদ্যোক্তা বা স্বাবলম্বী হওয়ার নয়।
আপনার সার্টিফিকেট কোনো অভিশাপ নয়। এটা আপনার দীর্ঘদিনের পরিশ্রম, আপনার মেধা আর ধৈর্যের প্রতীক। কিন্তু মনে রাখবেন, "সার্টিফিকেট পুঁজি, আত্মবিশ্বাস নয়"। আপনার সার্টিফিকেট আপনার জ্ঞান এবং যোগ্যতার একটা প্রমাণপত্র, কিন্তু এটা আপনার সম্পূর্ণ পরিচায়ক নয়। আপনার আসল পরিচয় আপনার ভেতরের শক্তি, আপনার ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা, আপনার নতুন কিছু শেখার আগ্রহ। একটা কাগজের টুকরো আপনার লাইফ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, যদি না আপনি তাকে সেই ক্ষমতা দেন।
যারা আপনাকে "বাবার হোটেলে খাচ্ছেন" বলে খোঁটা দেয়, তাদের দিকে তাকিয়ে হাসুন। কারণ তারা জানে না, এই "বাবার হোটেল" কোনো লজ্জা নয়, এটা আপনার দুর্গ। এটা সেই নিরাপদ আশ্রয়, যেখানে আপনি বাইরের পৃথিবীর ঝড় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নতুন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে পারেন। বাবা-মা আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি, বোঝা নন। তাদের ছায়ায় থেকে যদি আপনি নিজেকে আরও ধারালো করতে পারেন, নতুন কোনো দক্ষতা অর্জন করতে পারেন, তবে সেটাই হবে আপনার সবচেয়ে বড় জয়।
লজ্জা পেয়ে ঘরকুনো হয়ে বসে থাকবেন না। এই সময়টাকে কাজে লাগান। আপনার পুঁথিগত বিদ্যার বাইরেও একটা বিশাল পৃথিবী আছে। নিজেকে প্রশ্ন করুন:
আমি নতুন কী শিখতে পারি? (গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, কনটেন্ট রাইটিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, ভিডিও এডিটিং—হাজারো পথ খোলা আছে)
আমার কোন শখ বা আগ্রহকে আমি পেশায় পরিণত করতে পারি?
আমি কি ছোট করে হলেও নিজে কিছু শুরু করতে পারি? (একটি অনলাইন পেজ, একটি ছোটখাটো ব্যবসা, টিউশনি বা কোচিং)
আমার মতো সমস্যায় আর কারা আছে? আমরা কি একসাথে মিলে কিছু করতে পারি?
মনে রাখবেন, যে আপনাকে চাকরি দেবে, সে আপনার সিজিপিএ-এর থেকে বেশি দেখবে আপনার দক্ষতা এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা। আপনার মাস্টার্সের সার্টিফিকেট আপনাকে ইন্টারভিউ বোর্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে, কিন্তু চাকরিটা পাইয়ে দেবে আপনার আত্মবিশ্বাস আর প্রায়োগিক জ্ঞান। তাই এই সময়টাতে হতাশায় ডুবে না থেকে নিজেকে পরবর্তী যুদ্ধের জন্য সেরা অস্ত্রে সজ্জিত করুন।
সমাজ বদলাবে না। অন্তত আজকের এই লেখায় বা আপনার একার চেষ্টায় তো নয়ই। তাই সমাজকে বদলানোর বৃথা চেষ্টা না করে নিজেকে বদলান। নিজের চিন্তার পদ্ধতিকে বদলান।
১. তুলনা করা বন্ধ করুন: ফেসবুকে বন্ধুর ইউরোপ ভ্রমণের ছবি বা কর্পোরেট জীবনের আপডেট দেখে নিজের জীবনকে অর্থহীন ভাবা বন্ধ করুন। প্রত্যেকের পথ আলাদা, প্রত্যেকের যাত্রার সময়কাল ভিন্ন। আপনার সময়ও আসবে।
২. নেতিবাচক মানুষ এড়িয়ে চলুন: যে আত্মীয় বা বন্ধু আপনার মনবলে আঘাত করে, তার থেকে সচেতনভাবে দূরত্ব বজায় রাখুন। আপনার মানসিক শান্তি এখন সবচেয়ে দামি।
৩. ছোট ছোট পদক্ষেপে বিশ্বাস রাখুন: প্রতিদিন নতুন কিছু শেখা, নিজের সিভি আপডেট করা, নতুন কোনো স্কিলের উপর কোর্স করা—এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলোই একদিন আপনাকে বড় সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে।
৪. শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন: বেকারত্বের হতাশা শরীর ও মনকে ভেঙে দেয়। নিয়মিত ব্যায়াম করুন, বই পড়ুন, ভালো সিনেমা দেখুন বা এমন কিছু করুন যা আপনাকে আনন্দ দেয়। মনে রাখবেন, সুস্থ শরীর আর স্থির মস্তিষ্ক ছাড়া কোনো যুদ্ধই জেতা যায় না।
আমি ফারহানা আবারও বলছি, আপনার লড়াইটা একান্তই আপনার। এই লড়াইয়ে সমাজ আপনাকে বাহবা দেবে না, বরং সুযোগ পেলেই টেনে নামানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু যেদিন আপনি সফল হবেন, সেদিন এই লোকেরাই আপনার সাফল্যের ভাগিদার হতে ছুটে আসবে।
তাই সার্টিফিকেটটাকে সিন্দুকে তুলে রাখুন। ওটা আপনার অর্জন, আপনার বোঝা নয়। এবার নিজের আত্মবিশ্বাসকে জাগিয়ে তুলুন। পৃথিবীকে দেখিয়ে দিন, একটা চাকরি আপনার পরিচয় নয়। আপনি নিজেই নিজের পরিচয়। আপনি শিক্ষিত, কিন্তু বেকার নন। আপনি একজন সুযোগের অপেক্ষায় থাকা যোদ্ধা, যিনি সঠিক সময়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছেন।
আজ থেকে নিজের পরিচয় দিন এভাবে—"আমি শিখছি, আমি নিজেকে প্রস্তুত করছি, আমি আমার সময়কে বিনিয়োগ করছি এক নতুন ভবিষ্যতের জন্য।"
লড়াইটা চলুক। আপনার ভেতরের আগুনটা নিভতে দেবেন না। এই আগুনই একদিন সব অন্ধকারকে পুড়িয়ে দিয়ে আপনার জন্য নতুন ভোরের আলো নিয়ে আসবে।
, ゚