05/07/2025
হালাল-হারামের খোঁজে
প্রায় ২০ বছর আগের কথা। ঢাকায় একটি মার্কেটিং কোম্পানিতে চাকরি করতাম, থাকতাম মুগদার কমিশনার গলির এক মেসের চার তলার একটি রুমে। যেহেতু মার্কেটিংয়ের কাজ, তাই সকাল ও বিকাল—এই দুই সময়েই কাজ করতে হতো।
প্রতিদিন বিকেলে যখন কাজে বের হতাম, তখন এক লোককে দেখতাম রাস্তার পাশে একটি ছোট টেবিলের ওপর ৪টি লম্বা, চারকোনা স্টিলের ফুড কন্টেইনার নিয়ে বসতেন। এসব কন্টেইনার আমরা সাধারণত বুফে রেস্টুরেন্টে দেখি। তিনি ছোলাবুট, আলুর চপ, পিয়াজুসহ নানা রকম স্ন্যাক্স বিক্রি করতেন, যা আমরা বিকেলে বা সন্ধ্যায় নাশতা হিসেবে খেয়ে থাকি। মাগরিবের আগেই তার সব বিক্রি হয়ে যেত। অনেক সময় দেখতাম, তিনি আসেননি—তবু মানুষ তার দোকানের সামনে ভিড় করছে।
পরে শুনেছি, তিনি সচিবালয়ে একটি ছোট চাকরি করতেন। সামান্য বেতনে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ায় তিনি সৎভাবে বাড়তি আয় করতে বিকেলে এ কাজ করতেন। তার স্ত্রী আগে থেকেই সব রান্না করে প্রস্তুত করে রাখতেন, আর তিনি অফিস শেষে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েই বক্সগুলো নিয়ে বের হয়ে যেতেন। জানি না, তিনি এখন কোথায় আছেন। আল্লাহ্ যেন এই সৎ মানুষটিকে ভালো রাখেন।
আরও একটি ঘটনা বলি। বহু বছর আগের কথা তখন ৯-৫টার অফিস ছিল না, শুক্রবার ছিল একমাত্র ছুটির দিন। এক সরকারি নিম্নপদস্থ কর্মচারী, অফিস শেষে বাসায় এসে, দুপুরের খাবার খেয়েই গুলিস্তানের ফুটপাতে গেঞ্জি-টিশার্ট নিয়ে দাঁড়াতেন বিক্রির জন্য। মাগরিব পর্যন্ত বিক্রি করে, নামাজ পড়ে বাসায় আসতেন। এর পর ছেলেমেয়েদের পড়াতে বসতেন। হারামের টাকা যেন কখনো তার ঘরে না ঢোকে—এই ছিল তার নীতি। তিনি জীবনে পুরাপুরি সফল ছিলেন। তার ৫ সন্তানই পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিসিএস ক্যাডার—সবই আছে তাদের মধ্যে। তার সেই কষ্ট সার্থক হয়েছে। হালাল ইনকামের বরকত এমনই। তিনি যদি হারাম টাকায় সন্তান লালন পালন করতেন তবে মনে হয়না তার সন্তানদের মানুষ করতে পারতেন।
কিন্তু এখন সময় বদলেছে। এখন আর তেমন কাউকে দেখি না যিনি অতিরিক্ত আয়ের জন্য সৎপথে পরিশ্রম করেন। কারণ এখন আর সেই প্রয়োজন পড়ে না। আমার দেখা বাস্তব একটি ঘটনা বলি। সরকারের কোন ডিপার্টমেন্টের এক ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী—চলাফেরা করেন ৩৫ লাখ টাকার প্রাইভেট কারে, বাড়ি-গাড়ি সবই আছে। দেখা হলে বলবেন, তিনি কতটা সৎ; সহকর্মীদের মতো তিনি ‘কিছুই’ করতে পারেননি বলে আফসোস করেন।
তার এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেটা মাদকাসক্ত, কয়েকবার বিয়ে করেও সংসার টেকেনি, শেষমেশ গরিব ঘরের এক মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছে—সেই বউ এখনো আছে। তার নিজের মেয়েটিও কয়েকবার একাধিক বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে, প্রত্যেকবারই জোর করে ধরে এনে বাড়িতে ফিরিয়েছেন।
একদিন জুমার নামাজের পর বিশাল খাওয়া দাওয়ার আয়োজন। ছেলের জন্য ৩৫ লাখ টাকা দিয়ে নিজেরই ডিপার্টমেন্টে তৃতীয় শ্রেণির চাকরি নিয়ে দিয়েছেন। এই উপলক্ষে গ্রামে কয়েক হাজার মানুষ খাওয়াচ্ছেন। সবাই তার আতিথেয়তার প্রশংসা করছে, তিনি যে কত বড় মনের আর ভাল মানুষ সেটা গ্রামবাসী বলছে। আর তিনি অন্যদের সাথে কথা বলার সময় গর্ব করে ঘুষের টাকার অঙ্কটাও বলে বেড়াচ্ছেন, আরো বলছেন, এই চাকরিটা ম্যানেজ করতে তার খুব কষ্ট হয়েছে। সবাই তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। ঘুস দিয়ে চাকরি নেয়ার ব্যাপারটা সবাই খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে।
কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা পোষ্টে দেখলাম একজন সরকারি চাকরি পেয়ে গ্রামের ২ হাজার মানুষকে মিষ্টিমুখ করিয়েছেন। অথচ ওই চাকরির মাসিক বেতন মাত্র ৩৫ হাজার টাকা!
আসলে আমাদের সমাজে এখন আর কেউ হালাল-হারামের চিন্তা করে না। একসময় সুদখোর, ঘুষখোরদের মানুষ ঘৃণার চোখে দেখত। তারা সমাজে মাথা নিচু করে চলত। এখন সময় পাল্টেছে—তারা বুক ফুলিয়ে ঘোরে, সম্মান আর সমীহ পায় সমাজে।
আজ যারা সৎ, কষ্ট করে হালাল পথে চলে—তারা যেন জাদুঘরে বন্দি হয়ে গেছে। চাইলেও এখন আপনি তাদের খুঁজে পাবেন না।