25/07/2025
১
২১ জুলাই ২০২৫ তারিখে দুপুর ১টার কিছু পরে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিয়াবাড়ি ক্যাম্পাসের একটি দোতলা ভবনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি F-7 BGI প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এটি দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা। কেউ পাইলটের অদক্ষতা, আবার কেউ হাইড্রোলিক ফেইলিউর বা ইঞ্জিনের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলে মনেকরেন। তবে পাইলট যে জনবহুল এলাকা এড়িয়ে অপেক্ষাকৃত কম জনবসতিপূর্ণ এলাকার দিকে বিমানটি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, এবিষয়ে সন্দেহ নেই। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই দুর্ঘটনায় ৩২ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু-শিক্ষার্থী (অন্তত ২৫ জন), দুজন শিক্ষক এবং বিমানের পাইলট। দেড় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, যাদের অনেকেই গুরুতরভাবে দগ্ধ হয়েছেন। বর্তমানে ঢাকার পাঁচটি হাসপাতালে বিমান দুর্ঘটনায় দগ্ধ ৬৮জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। মাইলস্টোনের দুজন শিক্ষিকা মাহেরিন চৌধুরী এবং মাসুকা বেগম নিপু শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেরা গুরুতরভাবে দগ্ধ হন এবং পরে মারা যান। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করার কারণে অনেক শিশু-কিশোরের মনে গভীর মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে। তাদের দীর্ঘমেয়াদী মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। দুর্ঘটনার পর শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সাধারণ জনগণ সুষ্ঠু তদন্ত, দায়ীদের শাস্তি, নিহত ও আহতদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ এবং পুরনো ও অনিরাপদ বিমান ব্যবহার বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করেছে।
দুর্ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স, সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর সদস্যরা দ্রুত উদ্ধার অভিযানে নামেন। তারা ধ্বংসস্তূপ থেকে আহত ও নিহতদের উদ্ধারের কাজ করেন। তবে প্রাথমিক উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে কিছুটা সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা গেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ঘটনাস্থলে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সীমিত করা এবং উদ্ধারকারীদের মধ্যেও তথ্যের আদান-প্রদানে কিছুটা জটিলতা ছিল। কিছু ক্ষেত্রে উদ্ধারকাজে প্রয়োজনীয় আধুনিক সরঞ্জামের সংকট দেখা গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অব্যবস্থাপনাগুলো দুর্ঘটনা পরবর্তী পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে এবং জনমনে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ভবিষ্যতের জন্য এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি সমন্বিত এবং সুসংগঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। এরকম পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁর সময়ে সামরিক ও অসামরিক বিভিন্ন সংস্থা, এজেন্সির সমন্বয়ে ১৯৭৯ সালে জাতীয় পর্যায়ে একটা অনুশীলনের আয়োজন করেছিলেন। সেই অনুশীলনের নাম ছিল ‘অপারেশন নবদিগন্ত’। তবে এই প্রসঙ্গে যাবার আগে বহুল আলোচিত দুটি প্রশ্নে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। একটা হলো বিমানবাহিনীর ঘাঁটি ঢাকা শহরের মাঝে কেন এবং অন্যটা, ঢাকা শহরের মাঝে সেনানিবাসের অবস্থান কেন?
২
১৯৪১ সালে ব্রিটিশ সরকার ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় একটা সামরিক এয়ারস্ট্রিপ নির্মাণ কাজ শুরু করে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) বার্মা ফ্রন্টে সামরিক বিমান ওঠানামার সুবিধা নিশ্চিত করা। একই উদ্দেশ্যে তারা দেশব্যাপী অসংখ্য এয়ারস্ট্রিপ নির্মাণ করেন যার কিছুকিছু এখনো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। সময় এসেছে সেগুলো সচল করে ব্যবহার উপযোগী করার। ১৯৪৩ সালে নির্মাণাধীন তেজগাঁও বিমানবন্দরে প্রথম একটা হালকা যুদ্ধবিমান অবতরণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, ১৯৪৫ সাল থেকে এটি সামরিক কাজের পাশাপাশি অসামরিক বিমানবন্দর হিসেবেও ব্যবহৃত হতে থাকে। সীমিত সম্পদ সর্বোচ্চ ব্যবহারের নীতিমালার আলোকে একই বিমানবন্দর সামরিক এবং অসামরিক কাজে ব্যবহারের পথচলার সেইযে শুরু তা এখনও বলবৎ আছে। ১৯৪৬ সালে ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ নামে একটি এয়ারলাইন্স করাচি থেকে ঢাকা পর্যন্ত ফ্লাইট পরিচালনা করে। দেশ ভাগ হলে তেজগাঁও বিমানবন্দর পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম অসামরিক বিমানবন্দর হিসেবে কাজ শুরু করে। কিন্তু ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর একটি নতুন ও বিকল্প বিমানবন্দর নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলে ১৯৬৬ সালে কুর্মিটোলার বর্তমান স্থানটি বিমানবন্দরের জন্য নির্বাচিত হয়। ফরাসি বিশেষজ্ঞরা এই বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন ও রানওয়ে নির্মাণে কারিগরি সহায়তা প্রদান করেন। এখানে উল্লেখ করতে চাই, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে তেজগাঁও বিমানবন্দরে একটি কার্গো বিমানের দুর্ঘটনা ঘটে, যেখানে ৪ জন ক্রু এবং ৩ জন স্থানীয় বাসিন্দা নিহত হন। সেটাই কি প্রথম সিভিল ক্যাজুয়ালটি! হতে পারে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা, উভয় এয়ারস্ট্রিপ এয়ারস্ট্রাইকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রয়োজনীয় মেরামত শেষে ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দরে পুনরায় বিমান চলাচল শুরু হয়। এর পাশাপাশি ১৯৭২ সালে সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত কুর্মিটোলা বিমানবন্দরের নির্মাণ কাজ পুনরায় শুরু করে। সেসময় সরকার এটিকে দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফরাসি সংস্থা Aéroports de Paris কে নতুন পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ করে। এরমাঝেই, ১৯৭৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর একটি বিমান দুর্ঘটনায় এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার শহীদ হলে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তেজগাঁও এয়ারস্ট্রিপের বিএএফ ঘাঁটি বাশার নামকরণ করা হয়। ১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কুর্মিটোলা বিমানবন্দরের মূল রানওয়ে ও বর্তমান টার্মিনাল ভবনের কেন্দ্রীয় অংশ ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ নামে উদ্বোধন করেন এবং ১৯৮১ সাল থেকে এটি চালু হয়। এই বিমানবন্দর চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত বিএএফ ঘাঁটি বাশার বিমান বাহিনীর পাশাপাশি দেশের প্রধান অসামরিক বিমানবন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানে এটি বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার, সামরিক বিমান ওঠানামা এবং প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। বিমান বাহিনীর পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও এই ঘাঁটিটি ব্যবহার করে থাকে। এছাড়াও কিছু বেসরকারি উড়োজাহাজ প্রশিক্ষণ কোম্পানিও এটি ব্যবহার করে।
১৯৮৩ সালে ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’- এর নির্মাণকাজ সম্পূর্ণরূপে শেষ হলে প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তার এটিকে ‘জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ নামে পুনরায় উদ্বোধন করেন। তেজগাঁও-এর বিএএফ ঘাঁটি বাশার যেরকম সামরিক এবং অসামরিক, উভয় কাজে ব্যবহার করা হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে কুর্মিটোলার বিমানবন্দরটাও আজো সামরিক ও অসামরিক বিমান চলাচলের কেন্দ্রবিন্দু। ১,৯৮১ একর আয়তনের এই বিমানবন্দরের রানওয়ে ভাগাভাগি করে এটি আজ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশাপাশি বিমানবাহিনী ঘাঁটি বীর উত্তম এ.কে. খন্দকার নামেও পরিচিত। আশাকরি প্রথম প্রশ্নের উত্তর মিলেছে। এবার দেখি সেসময়ে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরের আশেপাশের এলাকা কীরকম ছিল?
৩
সপ্তম থেকে অষ্টম খৃস্টাব্দের দিকে ঢাকার জনবসতি গড়ে ওঠে। চতুর্দশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত এই অঞ্চলে সেন রাজাদের শাসন ছিল, এরপর শুরু হয় সুলতানি আমল। গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে মূলত সেসময়ে ঢাকার জনবসতি গড়ে ওঠে। মুর্শিদকুলি খান তার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করলে ঢাকার রাজনৈতিক গুরুত্ব হ্রাস পায়। ১৮ শতকের শেষ ভাগে ঢাকা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে এলে তারা নতুন প্রশাসনিক কাঠামো, বিচার ব্যবস্থা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি কার্জন হল, আহসান মঞ্জিল, হাইকোর্ট ভবন ইত্যাদি নির্মিত হলে এই অঞ্চলে জনবসতির ঘনত্ব বেড়ে যায়। এখন যেটা পুরান ঢাকা তখন সেটাই ছিল মূল ঢাকা। ১৮৮৪ সালে ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর ফ্রেডরিক ওয়্যারকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটা পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা স্থাপনের দায়িত্ব দেয়। এখন যে এলাকাটা ওয়ারী নামে পরিচিত সেটা সেসময়ে প্রায় জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। তবে মুঘল আমলে সেখানে সেনানিবাস থাকায় সৈন্যরা বড় বড় তাঁবুতে বাস করতো বলে জানা যায়। ওয়্যারের তত্ত্বাবধানে এলাকাটিকে তিন ভাগে ভাগ করে উন্নয়ন কাজ শুরু হয়। জঙ্গল পরিষ্কার করে উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম বরাবর ৩০ ফুট প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ এবং আবাসিক প্লট তৈরি করা হয়। প্রতিটি প্লটের জন্য ১ বিঘা (কিছু ক্ষেত্রে ২ বিঘা) জমি নির্ধারিত ছিল। এই প্লটগুলো সরকারি কর্মচারী, স্থানীয় অভিজাত, ব্যবসায়ী ও শিক্ষিত লোকদের কাছে বিক্রি করা হয়। এটি ছিল ঢাকার প্রথম অভিজাত এলাকা।
দেশ ভাগের পর ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে পরিণত হলে আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ঢাকায় ভিড় জমায়। শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নতুন আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক ভবন, রাস্তাঘাট ইত্যাদি নির্মিত হতে থাকে। ১৯৫৪ সালে মোহাম্মদপুর ঢাকার আরেকটা পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নামানুসারে এই এলাকার নামকরণ করা হয় এবং রাস্তাগুলোর নাম মুঘল ব্যক্তিত্বদের নামে রাখা হয়, যেমন - তাজমহল রোড, হুমায়ুন রোড, বাবর রোড ইত্যাদি। এটি সেসময়ে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য একটি আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচিত হতো। তখন পর্যন্ত ঢাকা বলতে দক্ষিণের এসব এলাকাই বোঝাতো।
১৯৬১ সালে ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট বা ডিআইটি (বর্তমানে রাজউক) ঢাকা সেনানিবাসের কাছাকাছি এলাকায় পরিকল্পিত মডেল টাউন হিসেবে গুলশান, বনানী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। পাকিস্তানের করাচি শহরের একটি অভিজাত আবাসিক এলাকার অনুকরণে ‘গুলশান’ আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার জন্য ভোলা গ্রামকে বেছে নেয়া হয় যা ছিল মূলত কৃষিজমি এবং জলাশয়পূর্ণ। আদি বাসিন্দাদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করে আবাসিক এলাকা নির্মিত হলেও শুরুর দিকে গুলশানে জনবসতি ছিল খুবই কম। তবে আশির দশকের পর থেকে গুলশানের নাগরিক চরিত্র বদলাতে শুরু করে। কেননা ইতিমধ্যে ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর’ সহ রাস্তা-ঘাট, বেশকিছু অবকাঠামো ইত্যাদি নির্মিত হয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে একতলা-দোতলা বাড়ির পরিবর্তে বহুতল ভবন গড়ে উঠতে থাকে এবং বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানির আগমনে আবাসন খাতের দ্রুত বিকাশ ঘটে। একসময় মতিঝিল ঢাকার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র থাকলেও, নব্বইয়ের দশকের পর থেকে গুলশান এবং বনানীর আশেপাশের এলাকা নতুন বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বনানী আবাসিক এলাকার গল্পটাও গুলশানের মতোই, ডিআইটি ১৯৬০-এর দশকে ঢাকা সেনানিবাস এবং গুলশানের মাঝে বনানী মডেল টাউনের পরিকল্পনা করে জমি অধিগ্রহণ করে এবং প্লট আকারে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বরাদ্দ দেয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্রমবর্ধমান ঢাকাবাসীর জন্য একটি সুপরিকল্পিত আবাসিক পরিবেশ তৈরি করা। আবাসিক এলাকা হিসেবে নির্মিত হলেও ৮০-এর দশকের পর থেকে গুলশানের মতোই বনানীর চরিত্র দ্রুত বদলাতে থাকে। নগরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমের বিস্তৃতির কারণে বনানী কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯৯০-এর দশকের শুরু থেকে বনানীতে বহুতল ভবন নির্মাণ দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে এবং আবাসিক প্লটগুলো বাণিজ্যিক প্লটে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। বর্তমানে ঢাকার বাণিজ্যিক ল্যান্ডস্কেপে গুলশান ও মতিঝিলের পরেই তৃতীয় স্থানে রয়েছে বনানী।
এবার আসি ঢাকার আরেকটা বড় আবাসিক এলাকা উত্তরার গল্পে। উত্তরা এলাকার পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল ১৯৬৬ সালে, গুলশান-বনানী থেকে কয়েকবছর পর। ডিআইটি ‘নর্থ স্যাটেলাইট টাউন’ প্রকল্পের অধীনে একটি স্যাটেলাইট টাউন (উপশহর) নির্মাণের পরিকল্পনা করে। এরও মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্রমবর্ধমান ঢাকার জনসংখ্যার চাপ কমানো এবং একটি সুপরিকল্পিত আবাসিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ১৯৮০ সালে প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে ‘উত্তরা আবাসিক মডেল টাউন প্রকল্প’ রাখা হয়। প্রকল্পটি বিভিন্ন ধাপে বাস্তবায়িত হয়েছে, ১৯৯২ সালে প্রকল্পের প্রথম ধাপে উত্তরা ১ থেকে ১০ নম্বর সেক্টর পর্যন্ত গড়ে ওঠে। দ্বিতীয় ধাপের কাজ ১৯৯২ সালে শুরু হয়ে ১৯৯৮ সালে শেষ হয় এবং ১১, ১২, ১৩, ১৪ নম্বর সেক্টর গড়ে ওঠে। ১৯৯৯ সালে দিয়াবাড়ি এলাকায় উত্তরা মডেল টাউনের তৃতীয় ধাপের কাজ শুরু হয়, ১৫, ১৬, ১৭ এবং ১৮ নম্বর সেক্টর এই ধাপের অংশ। তবে আমার মতে তৃতীয় ধাপের একটা বড় অংশ বিমানবন্দরের জন্য হুমকি স্বরূপ।
বিমানবন্দরের আশেপাশের জলাশয় ভরাট করে ডিআইটি এবং পরবর্তীতে রাজউক যে একটি নগরকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, সেটা গত ৪০ বছরের ৩টি স্যাটেলাইট চিত্রতেই পরিষ্কার। ১৯৮৫ সালেও বিমান ঘাঁটির চারপাশে বাফারিং জোন হিসেবে জলাশয় ছিল, এখন সেখানে বহুতল ভবনের ছড়াছড়ি। আলোচিত মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ দিয়াবাড়ি এলাকায় অবস্থিত। মাইলস্টোন স্কুলটি সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে রানওয়ের এক্সটেন্ডেড লাইনে নির্মিত হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ‘উত্তরা আবাসিক মডেল টাউন প্রকল্প’-এর তৃতীয় ধাপের কাজ সম্পূর্ণরূপে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। একটা শহরকে ধ্বংস করার জন্য রাজউকের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান থাকলে আর কিছুর দরকার হয়না। খোলাহাটি সেনানিবাসের দৃষ্টান্ত থেকে বলতে পারি, যদি দুবলার চরে বিমানবন্দর কিংবা সেনানিবাস স্থাপন করা হয় তাহলে সেখানেও বন্দর ও সেনানিবাসের চারপাশ ঘিরে বসতি গড়ে উঠবে। একসময় জনবিরল কুর্মিটোলায় নির্মিত বিমানবন্দরটি রাজউকের ভুল প্ল্যানের কারণে বর্তমানে ঢাকার একটা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং প্রতিনিয়ত শব্দ দূষণ তৈরি করছে।
৪
গুলশান, বনানী এবং উত্তরা আবাসিক এলাকার পাশাপাশি বিমানবন্দর এলাকার আরেকটা বৃহৎ দাপ্তরিক, আবাসিক এবং বহুল আলোচিত সামরিক এলাকা হলো ঢাকা সেনানিবাস। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলেই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলেও ঢাকা সেনানিবাস আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে সেনানিবাস এলাকাটাও কৃষিজমি এবং জলাশয়পূর্ণ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী এখানে অস্থায়ীভাবে কিছু সামরিক স্থাপনা তৈরি করে, যা পরবর্তীকালে সেনানিবাসের প্রাথমিক কাঠামো হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দেশভাগের পর সামরিক বাহিনীর জন্য পূর্ব পাকিস্তানে সুসংগঠিত সামরিক ঘাঁটির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ঢাকার কৌশলগত অবস্থান এবং প্রশাসনিক গুরুত্ব বিবেচনা করে, বর্তমান অবস্থানেই সেনানিবাস প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শুরুর দিকে ঢাকা সেনানিবাসের আয়তন ছিল ৪৯০.৩১ একর। প্রাথমিক পর্যায়ে সীমিত সম্পদ এবং অবকাঠামো নিয়ে সেনানিবাসের উন্নয়ন কাজ শুরু হয়। ব্যারাক, প্রশাসনিক ভবন এবং প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ করা হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ঢাকা সেনানিবাস সদ্য স্বাধীন দেশের সামরিক বাহিনীর প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সময়ের সাথে সাথে ঢাকা সেনানিবাসের আয়তন এবং কার্যকারিতা উভয়ই উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে এটি প্রায় ৩৮০৪.৯১৪৫ একর ভূমির ওপর বিস্তৃত একটি বিশাল স্থাপনা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বিমানবাহিনী ঘাঁটি বীর উত্তম এ.কে. খন্দকার, ঢাকা সেনানিবাস এবং বিএএফ ঘাঁটি বাশার মিলে যে বিস্তৃত এলাকা তার পেছনে রয়েছে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সামরিক বাহিনীর ক্রমবর্ধমান চাহিদা, নতুন ইউনিটের সংযোজন এবং অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তির সমন্বয়। এই প্রয়োজন দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং মানুষের নিরাপত্তার জন্যই। প্রায়ই ঢাকা শহরের মাঝে সেনানিবাস থাকা নিয়ে অনেকে মন্তব্য করেন। তাদের জন্য বলি, ১৯৫২ সালে যখন ঢাকা সেনানিবাসের পত্তন হয় তখন গুলশান (১৯৬০), বনানী (১৯৬০), উত্তরা (১৯৬৬)র অস্তিত্ব ছিল না। কুর্মিটোলা (১৯৬৬)তে বিমানবন্দরের কাজ তখনো শুরু হয়নি। মূলত ঢাকা সেনানিবাসের অবকাঠামোগত সুবিধার দিকে লক্ষ্য রেখে এসব আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়। এখনও যেখানে সেনানিবাস স্থাপন করা হয় সেখানেই সেনানিবাস ঘিরে আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠে। বিজয়নগর মোর থেকে শুরু করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল এলাকা পর্যন্ত যে আটলেনের রাস্তা সেটা নগরবাসীর সুবিধার্থে একসময় সেনানিবাসের বুক চিড়েই বানানো হয়েছিল। কোথাও সেনানিবাস নির্মিত হলে তার আশেপাশের এলাকার অবকাঠামোগত সুবিধা যে আপনাআপনিই বেড়ে ওঠে সেটা প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ খুব ভালোভাবেই বুঝেছিলেন। আর তাই, সেনাবাহিনীর অপারেশনাল প্ল্যানে না থাকলেও শুধুমাত্র হাওরাঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ২৭৫ একর জায়গার ওপর বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ সেনানিবাস নির্মিত হয়। পরে বিষয়টাকে হালাল করার জন্য নাম বদলে মিঠামইন রিভারাইন সেনানিবাস বলা হচ্ছে। এই সেনানিবাসের আওতায় নাকি একটি কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল রিসেলও থাকবে, যা থেকে যুদ্ধকালীন সময়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। একসাথে ৫,০০০ সেনা এই সেনানিবাসে অবস্থান করতে পারবে। এরফলে তাদেরকে ঘিরে সেখানে গড়ে উঠবে স্কুল-কলেজ-ব্যাংক-মার্কেট-থানা ইত্যাদি মিলে বিশাল এক অর্থনৈতিক চক্র।
দেশের ৫/৭ বছরের জাতীয় বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ঢাকা সেনানিবাসসহ অন্যান্য স্থাপনা দেশের অন্য কোথায় সরালে সশস্ত্রবাহিনী নিজেদের প্রয়োজনে স্থাপিত ব্যাংক-বীমা-মার্কেট, বিশ্ববিদ্যালয়- স্কুল- কলেজ সবই সাথে নিয়ে যাবে। সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যদের ঘিরে এই যে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ সেটা কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই তখন থেমে যাবে। অনেক সিভিলিয়ানের চাকরির সংস্থান বন্ধ হবে। তাই জেনেবুঝে এসব নিয়ে কমেন্টস করা দরকার বলে মনেকরি।
৫
বিগত সরকার 'বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর' নামে একটি নতুন বৃহৎ বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয়, যার উদ্দেশ্য ছিল শাহজালাল বিমানবন্দরের উপর চাপ কমানো এবং ভবিষ্যতের ক্রমবর্ধমান বিমান চলাচল চাহিদা মেটানো। প্রকল্পের জন্য ২০১১ সালে প্রাথমিকভাবে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর, দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলার প্রায় ১০ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে স্থানীয় জনগণের তীব্র আন্দোলন ও বিরোধিতার মুখে সরকার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। এই আন্দোলন এতটাই তীব্র ছিল যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছিল। এটি ছিল সবচেয়ে আলোচিত এবং প্রথম নির্বাচিত স্থান। আড়িয়াল বিলের ঘটনার পর, সরকার পদ্মা সেতুর ওপারে একটি নতুন স্থান নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দেয়। মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার চর জানাযাত এবং মুন্সিগঞ্জের সিরজাদিখানের কিয়াইন ও ঢাকার দোহারের চর বিলাশপুরকে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রীরাও বিভিন্ন সময়ে এই স্থানে বিমানবন্দর নির্মাণের সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন। স্থানটি পদ্মা সেতুর কাছে হওয়ায় যোগাযোগ সুবিধার দিক থেকে বেশ সম্ভাবনাময় বলে মনেকরা হয়েছিল। পরে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার কিছু অংশ এবং টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর উপজেলার নদীতীরবর্তী চর এলাকাও প্রাথমিক বাছাইয়ের মধ্যে ছিল। এগুলোর মধ্যে মুন্সিগঞ্জের আড়িয়াল বিল ও পদ্মা পাড়ের এলাকাগুলোই বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। এই স্থানগুলোতে নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে অনেক আলোচনা ও সম্ভাব্যতা যাচাই করতে ১৩৬ কোটি টাকা ব্যয় হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়নি।
১৯৯১/৯২ সালের দিকে খোলাহাটি, পার্বতীপুর এলাকায় যখন নতুন সেনানিবাস নির্মাণের কাজ শুরু হয় তখন জায়গাটাতে মরুভূমির মতো ধূধূ বালুচর ছিল। অথচ বর্তমানে এলাকাটা এতটাই ঘন জনবসতিপূর্ণ যে এলাকাটা একসময় যে রেলের পরিত্যক্ত ইয়ার্ড ছিল তা আর বোঝার উপায় নেই। এই সেনানিবাসে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য বেশ কয়েকটা ফায়ারিং রেঞ্জ আছে, সেখানে দিন-রাত বিভিন্ন ইউনিট ফায়ারিং প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে। এরকম অবস্থায় কোন এক অনভিজ্ঞ সৈনিকের বন্দুকের ব্যারেল সরে গিয়ে বুলেট আবাসিক এলাকার কাউকে বিদ্ধ করলে দোষটা কার হবে? অনভিজ্ঞ সৈনিক কি? কিন্তু তাকে তো প্রশিক্ষণ দিয়েই অভিজ্ঞ করতে হবে। সেনানিবাস? কিন্তু সেনানিবাস যখন স্থাপিত হয় তখন তো সেখানে কিছুই ছিল না। আবাসিক এলাকার জনসাধারণ? কিন্তু জনসাধারণ তো যেখানে স্কুল-কলেজ-ব্যাংক-মার্কেট ইত্যাদি অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা থাকবে সেখানেই বসতি গড়বে। একজন সৈনিক যেমন কাঠের বন্দুক দিয়ে ফায়ারিং প্রশিক্ষণ নেয়না, একজন পাইলট তেমনি খেলনা যান দিয়ে ফাইটার জেট চালানোর প্রশিক্ষণ নেয়না। যুদ্ধক্ষেত্রে যা ব্যবহৃত হবে তা নিয়েই প্রশিক্ষণ নেয়া হয়। এই প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে যদি কিছু ঘটে তবে সেটা স্রেফ দূর্ঘটনা। এতে অযথা রঙ চড়িয়ে লাভ নেই।
বিমান চলাচলের ল্যান্ডিং ফানেল বা গ্লাইড পাথ ঘেঁষে নির্মিত মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ দিয়াবাড়ি এলাকায় উত্তরা মডেল টাউনের তৃতীয় ধাপের ১৫, ১৬, ১৭ এবং ১৮ সেক্টরে বসবাসরত জনসাধারণের বেসিক চাহিদা মেটাতেই নির্মিত হয়েছে। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ সিভিল এভিয়েশনের রুলের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। বিমানের ল্যান্ডিং এবং টেকঅফ রুটে বহুতল স্থাপনা নির্মাণে সিভিল এভিয়েশনের কিছু বিধিনিষেধ আছে। একারণেই নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকার প্লট মালিকরা আন্দোলন করেও বাড়িঘরের উচ্চতা বাড়াতে পারেনি। একারণেই বিমানবন্দরে প্রবেশ পথের ডানদিকের স্থাপনা অনেকদিন অসম্পন্ন অবস্থাতেই পড়ে ছিল। বিগত সরকারের আমলে ওসবের মালিকানা পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমানের নান্দনিক অবস্থায় এসেছে শুনতে পাই। একইরকম ভাবে অদৃশ্য ক্ষমতাবলে মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ বিমানের ল্যান্ডিং ফানেলে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে বলে শুনেছি। এখানে দোষটা কার? দোষটা আসলে কারো না। দোষটা ভাগ্যের, এই দেশে জন্ম নিয়েছি বলে। এখানে একদল অশিক্ষিত লোকের হাতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। এখানে আছে একটা বেকুব ইউটিউবার-টিকটক প্রজন্ম, যারা উদ্ধার কাজে হাত না লাগিয়ে ভিডিও করাতে ব্যস্ত থাকে। সেদিন ঘটনাস্থলে আর্মি কিছু স্টুডেন্টদের উপরে লাঠিচার্জ করতে বাধ্য হয় উদ্ধারকাজে বিঘ্ন ঘটানো এবং মোবাইলে আহত-নিহত শিশুদের ভিডিও করার কারণে। এটা যে শিশুদের অধিকারহরণের সামিল তা জানা না থাকলে ইউনিসেফ-এর বিবৃতি পাঠ করেন। যারা সঠিকভাবে তথ্য যাচাই না করে গুজব ছড়াতে ব্যস্তছিলেন তারা কিন্তু ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। যারা সংশ্লিষ্ট ফিল্ডের লোক না হয়েও সবকিছু জেনে বসে আছে্ন তারা আসলে উচ্চমাত্রার জ্ঞানী, তাদের নিয়ে কিছু বলার নেই।
৬
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিমান দুর্ঘটনার পর কিছু ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা দ্রুত উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করলেও কিছু দিক থেকে সমন্বয়হীনতা ও ত্রুটি লক্ষ্য করা গেছে। দূর্ঘটনা যেভাবেই ঘটুক না কেন আমাদের উদ্ধার ব্যবস্থায় আসলেই কোন সমন্বয় নেই। সেনা সদস্যরা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর তাগিদে যৎসামান্য প্রস্তুতি নিয়ে যেতে পেরেছিলেন ঠিকই কিন্তু সেখানে জরুরী চিকিৎসা দেয়ার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা ছিলনা। ফায়ার ব্রিগেডের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা প্রযোজ্য। দুর্ঘটনার সময়ে সেনাসদস্যদের সহযোগিতা না করে অনেকেই মোবাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলেন। আগেই লিখেছি, উদ্ধার কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করায় একপর্যায়ে সেনাসদস্যরা উপস্থিত শিক্ষার্থী ও জনগনকে মারধর করেছে। কোন কম্যান্ড সেন্টার অথবা তথ্যকেন্দ্র স্থাপন না করার কারণে জনগণ যার তার কাছ থেকে তথ্য পেয়ে বিভ্রান্ত হয়েছে। চারদিকে গুজব ছড়িয়েছে বাতাসের বেগে। দুর্ঘটনার পর হতাহতের সঠিক সংখ্যা নিয়ে শুরু থেকেই বিভ্রান্তি ছিল। বিভিন্ন সূত্র থেকে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য আসছিল, যা পরিবার ও জনসাধারণের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছিল। এমনকি দুঃখজনক হলেও সত্যি, সেনাবাহিনী এবং সরকারের বিরুদ্ধে মৃতদেহ গুম করার অভিযোগ পর্যন্ত এসেছে। আমি জানিনা, মৃতের সংখ্যা গোপন বা গুম করে সেনাবাহিনী বা সরকারের কি লাভ? দুর্ঘটনার প্রথম কয়েক ঘণ্টায় নিহত ও আহতের সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। কখনও নিহতদের সংখ্যা কম বলা হয়েছে, আবার কখনও তা হঠাৎ করে অনেক বেড়ে গেছে। স্কুলে কতজন শিক্ষার্থী ছিল, কতজন আহত বা নিখোঁজ—এই তালিকা প্রকাশে বিলম্ব হয়েছে। অনেক পরিবার তাদের সন্তানের খবর জানতে গিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। দুর্ঘটনার জন্য কারা দায়ী, সেই বিষয়ে দ্রুত এবং সুস্পষ্ট জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে। যদিও তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, তবে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এর ফলাফল এবং দায়ীদের শাস্তি নিয়ে সংশয় রয়েছে। আবার আইসিইউ বা হাসপাতালে রাজনৈতিক শোডাউনের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এক কথায় চরম লেবেলের অব্যবস্থাপনা দেখা গিয়েছে।
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে দক্ষিন কোরিয়ার জেজু এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৩৭-৮০০ বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে ১৭৬ জন যাত্রী নিহত হন, ১২ জুন ২০২৫ তারিখে এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিম লাইনার উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারতের আহমেদাবাদে শিক্ষার্থীদের একটি হোস্টেলে আছড়ে পড়ে বিধ্বস্ত হয়, এতে প্রাণ হারান ২৭০ জনের বেশি যাত্রী এবং হোস্টেলের শিক্ষার্থী। অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এসব কমার্শিয়াল এয়ারক্রাফট ক্র্যাশ করেছে। তাই অত্যাধুনিক ফাইটার কিনলেও এরকম দুর্যোগ আসতেই পারে কিন্তু আমরা এরকম পরিস্থিতি হ্যান্ডেল করার জন্য মোটেই প্রস্তুত নই। ‘Miracle on the Hudson’ আসলে সবসময় ঘটেনা, আর দেশটা যখন বাংলাদেশ তখন কখনই সেটা ঘটেনা।
৭
ফিরে আসি যেখানে শুরু করেছিলাম সেখানে। এই বিশ্বে কোন কোন দেশ প্রস্তুত থাকে, যাতে দূর্ঘটনা থেকে প্রাণহানি কমানো যায়, আবার কোন কোন দেশে বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থাপনা আর দায়িত্বহীনতার কারণে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাটা বেড়ে যায়, যেমন বাংলাদেশ। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই ১৯৭৯ সালে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সামরিক এবং অসামরিক প্রশাসনের মধ্যে যুদ্ধকালীন সমন্বয় সাধনের জন্য ‘অপারেশন নবদিগন্ত’ মহড়া বা অনুশীলন পরিচালিত হয়েছিল। এটি ছিল একটা বড় আকারের সমন্বিত মহড়া, যা সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি অসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, আনসার, ফায়ার সার্ভিস, রেড ক্রিসেন্ট এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে যুক্ত করে পরিচালিত হয়েছিল। এর মূল লক্ষ্য ছিল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলা (সম্ভাব্য যুদ্ধ বা জাতীয় সংকটের সময় সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের মধ্যে দ্রুত ও কার্যকর সমন্বয় গড়ে তোলা), সম্পদ ব্যবস্থাপনা (সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা ও জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করা), জনগণের সম্পৃক্ততা (দুর্যোগ বা সংকটে জনগণের ভূমিকা ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কৌশল অনুশীলন করা) এবং কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ (সামরিক ও বেসামরিক কমান্ড চেইনের মধ্যে স্পষ্ট যোগাযোগ এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া স্থাপন করা)।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীর একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা হিসেবে দেশের প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা বিষয়ে বিশেষভাবে জোর দিতেন। তিনি সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সুসংহত করতে চেষ্টা করেছিলেন। ‘অপারেশন নবদিগন্ত’ ছিল সেই প্রচেষ্টারই একটি অংশ, যার মাধ্যমে যুদ্ধকালীন কিংবা জরুরি পরিস্থিতিতে অসামরিক প্রশাসনের সাথে সামরিক বাহিনীর সমন্বয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হয়েছিল। বিমান দূর্ঘটনা পরবর্তী বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখে আমি আবারও এরকম অনুশীলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করছি। ধন্যবাদ।