09/10/2025
শুক্রাণু নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত মোটিভেশন হলো-
জন্মের শুরুতেই মিলিয়ন মিলিয়ন শুক্রাণু থেকে, সবার আগে ছুটে গিয়ে ডিম্বানু নিষিক্ত করেছি আমরা। জীবনের প্রথম শুক্রাণু রেসে যদি ফার্স্ট হতে পারি, তাহলে জীবনের ঘটনাগুলো তো ব্যাপারই না। লেটস হ্যাভ আ গুড রেস।
ডিম্বানুর কথা কেউ বলে না।
এই গল্পের কাউন্টার আছে আমার কাছে।
প্রথমত জেনে রাখো- শুক্রাণু মানেই পুরুষ বা মানুষ নয়। শুক্রাণু থেকে ছেলে বা মেয়ে জন্মাতে পারে। একই সাথে ডিম্বানু মানেই মেয়ে নয়। ডিম্বানু থেকে ছেলেও জন্ম নিতে পারে, মেয়েও জন্ম নিতে পারে।
বায়োলজি হেটার্সে যখনই 'মানবজীবনের ধারাবাহিকতা' ক্লাস নিই, আমার সমস্ত দৃষ্টি ডিম্বানুতেই ফোকাসড হয়ে যায়। আমার চোখে মানবজন্মের সবচেয়ে সুন্দরতম আয়োজন হলো- ডিম্বানুর উৎসবমুখর জন্ম।
মায়ের দেহে ডিম্বাশয়ে যখন ডিম্বানু জন্ম নেয়, সেও এক রেস করে। তার সাথে ২০-২৫ টা ফলিকল ডিম্বানু হবার জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু হরমোনের খেলা বড় নিষ্ঠুর। এখানে ছাড় নেই। হরমোনের ওঠানামার খেলায় একটিমাত্র ডিম্বানু পরিপক্কতা লাভ করে। বাকীগুলো আমাদের দেহের ফ্যাগোসাইটিক কোষ (ম্যাক্রোফেজ) দ্বারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
ডিম্বানুর সৃষ্টি মানেই হরমোনের পর হরমোনের ক্রমিক কম্পিটিশন।
কখনো FSH বাড়ে, কখনো Estrogen। ইস্ট্রোজনের আধিক্যে FSH দমিত হয়। আবার ইস্ট্রোজেনের অতি আধিক্যে LH বেড়ে যায়। ডিম্বাশয় থেকে নেমে আসে অনিন্দ্য সুন্দর ডিম্বানু (সেকেন্ডারি উওসাইট)। হাত নেই, পা নেই, নেই কোনো ফ্ল্যাজেলা। চলনের জন্য অন্যের ধাক্কা খেতে হয়। টিকে থাকার জন্য নিজের মাঝে পুষ্টি সঞ্চয় করতে হয়। নিউক্লিয়াসকে বাঁচিয়ে রাখতে চারদিকে শক্ত আবরণ জোনা পেলুসিডা নামক চীনের মহাপ্রাচীর তৈরি করতে হয়।
এরপর পেলভিক গহ্বরের নিকষ অন্ধকারে ডিম্বানুর পথ চলা শুরু হয়। সেখান থেকে উঠে আসে ডিম্বনালিতে। কখনো ডিম্বনালির পেশির ধাক্কায় (পেরিস্ট্যালসিস), কখনো সিলিয়ার ধাক্কা খেয়ে খেয়ে পৌছে যেতে হয় অ্যাম্পুলায়। অপেক্ষা শুক্রাণুর জন্য। সে এক দীর্ঘ অপেক্ষা।
শুক্রাণু আসে মিলিয়নে মিলিয়নে। সেই শুক্রাণুর আসা পথ সৃষ্টি করতে ডিম্বানু নিজ দায়িত্বে (কর্পাস লুটিয়ামের ক্ষরণ- প্রোজেস্টেরন দ্বারা) সাঁতারের জন্য তরল মিউকাস ছড়িয়ে দিতে হয় জরায়ুর এপার থেকে ওপার পর্যন্ত। শুক্রাণু আসলে, শুক্রাণুর সাথে মিলিত হলে, ঘর বাঁধলে (এন্ডোমেট্রিয়ামের প্রাচীরে) যেন পুষ্টি আর সিকিউরিটি অনবরত থাকে, সেজন্য ডিম্বানু আগের কৌশলেই তৈরি করে রক্তনালি, গ্রন্থি।
কী করে না ডিম্বানু?
শুক্রাণু তো মিলিয়নে মিলিয়নে অথচ ডিম্বানু একা। শুক্রাণুরা ঝাঁকেঝাঁকে মরে যায়, ধুয়ে যায়, ডিম্বানু একা অপেক্ষা করে অন্ধকার ডিম্বনালিতে।
একদিন শুক্রাণু আসবে, তার জন্য সব প্রস্তুত করতে হবে। ডিম্বানু জানে, শুক্রাণু কিছুই আনবে না। এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম আনবে না, রাইবোসোম আনবে না, নিউক্লিয়াস আনবে না। শুক্রাণুর নিজের কোনো পানি নেই, সেই পানিও ডিম্বানুকেই দিতে হবে।
শুক্রাণুর শুধু নিউক্লিয়াস নেই তাই নয়, নেই কোনো RNA। ভবিষ্যতে (নিষেকের আধ ঘন্টা পর) জাইগোট বিভাজিত হওয়া শুরু করবে, এরপর মরুলা বা ভ্রুণ তৈরি করবে, সেই বিভাজনের জন্য ক্রোমাটিন বা স্পিন্ডল তন্তুও দিতে হবে ডিম্বানুকে।
কোষের শক্তির উৎস মাইটোকন্ড্রিয়া। শুক্রাণুর সেই মাইটোকণ্ড্রিয়াও দেবার সুযোগ নেই। একজন মানবশিশুর জন্ম মানেই একটি ডিম্বানুর বৈচিত্র্যময় জার্নি। দীর্ঘ একাকীত্ব। নিজের সমস্ত কিছুর শেয়ার করা।
ডিম্বাণু স্থির। ডিম্বানু রেস করে না।
ডিম্বানু মাস্টারপ্ল্যানার। ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু জমা রাখে। আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখে।
ডিম্বানু নিজের ঘর ছেড়ে আসে, শুক্রাণুকে নিয়ে ঘর বাঁধবে বলে।
ডিম্বানু ভয়ংকর একা, মনোগ্যামী। একটিমাত্র শুক্রাণু ছাড়া তার কোনো উদ্দেশ্যে নেই।
ডিম্বানু ইঞ্জিনিয়ার। ভবিষ্যতের জন্য আবাসস্থল তৈরি করে রাখে।
হয়তো ডিম্বানু কিছুটা অভিমানী। শুক্রাণু না আসলে সে একদিনের বেশি বেঁচে থাকে না। ধ্বংস হয়ে যায়। ঘরবাড়ি (এন্ডোমেট্রিয়াম) বিলিন হয়ে যায়। অভিমানী হলেও ডিম্বাণু মানেই একটা মা। একটা ভয়ংকর সুন্দর কোষের ভবিষ্যত প্রস্তুতি।
আজ যে শরীর তুমি-আমি-আমরা বহন করে চলছি, এই দেহের সমস্ত বহিঃক্রোমোসোমীয় কাঁচামাল প্রথমবার ডিম্বানুই দিয়েছিল। শুক্রাণু কিছুই দেয়নি।
পৃথিবীতে টিকে থাকা মানে হয়তো রেস।
কিন্তু স্থিরতা, ভবিষ্যত প্ল্যান কিংবা সবকিছু গুছিয়ে রাখাও এক ধরণের ক্ষমতা। যা আছে, তার কেয়ার করো। ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকো। অপেক্ষা করো অনিশ্চিত কিন্তু প্ল্যানড ভবিষ্যতের। ভবিষ্যতের জন্য একটু একটু করে দৈনিক কাজ করে যাও।
এই শিক্ষা ডিম্বানুর চেয়ে ভালো কেউ দেয় না। ডিম্বাণু মানেই একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ডিম্বাণু মানেই একজন শিক্ষক।
নোটঃ তুমি-আমি-আমরা যে ডিম্বানু থেকে জন্ম নিয়েছি, সেই ডিম্বানু মায়ের ডিম্বাশয়ে তৈরি হয়েছিল, আমাদের মা যখন ছিল আমাদের নানীর পেটে। সেই সুত্রে আমাদের নানিজানরাও আমাদের মায়ের একটা বড় পার্ট। পৃথিবীর সমস্ত মা, নানীজান এবং আমি-তুমি-তোমরা ভালো থাকুক।
ভালোবাসা ডিম্বানু এবং বায়োলজির জন্য।
-বিনীত
রাজীব হোসাইন সরকার
বায়োলজি হেটার্স