03/09/2025
গল্প: কালরাত্রি এক্সপ্রেস
রাত তখন গভীর, কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা। ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে থিকথিকে ভিড়, কিন্তু এই ভিড় অন্য দিনের মতো সাধারণ নয়। সবার চোখেমুখে এক অদ্ভুত মিশেলের উত্তেজনা আর ভয়, কারণ আজ সেই রাত, যখন "কালরাত্রি এক্সপ্রেস" দেখা যায়। ট্রেনটি নিয়ে শহরে মুখে মুখে ফেরে অসংখ্য গল্প – ভৌতিক, রোমাঞ্চকর, আর লোমহর্ষক। অনেকেই বলে এটি নাকি এক অতৃপ্ত আত্মার বাহন, আবার কেউ বলে সময় আর স্থানের ফাটল দিয়ে আসা এক রহস্যময় ট্রেন।
এই ভীড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে ছিল আবির। বয়স তিরিশের কোঠায়, চোখে চশমা, পেশায় একজন সাংবাদিক। তার উদ্দেশ্য একটাই – কালরাত্রি এক্সপ্রেসের রহস্য উদঘাটন করা। আবিরের ছোট বোন রিমু বছরখানেক আগে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। সেদিনও ছিল অমাবস্যার রাত, আর রিমু উঠেছিল 'সেই' ট্রেনে। আবির পুলিশের কাছে গিয়েছিল, কিন্তু সবাই তার কথা উড়িয়ে দিয়েছিল। তাই, নিজের তাগিদেই আজ সে এখানে।
ঘড়িতে রাত বারোটা বাজতেই প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে এক অদ্ভুত শব্দ হতে শুরু করলো। প্রথমে মৃদু, তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো সেই যান্ত্রিক গর্জন। কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে হঠাৎ করেই যেন কোথা থেকে উদয় হলো এক পুরনো ট্রেন। ট্রেনটির রঙ কালচে লাল, জানালার কাঁচগুলো ঘোলাটে আর লোহার ফ্রেমে মরিচা ধরা। ইঞ্জিনের ওপর থেকে এক শীতল বাষ্পের কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশে উঠছিল। স্টেশনের ইলেক্ট্রনিক সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বল করে উঠলো – "কালরাত্রি এক্সপ্রেস, গন্তব্য: অজানা"।
যাত্রীরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ট্রেনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। আবিরও তাদের মাঝে মিশে গেল। ট্রেন যখন প্রায় ভরে গেছে, তখন আবির দেখলো, একজন বৃদ্ধা ভিক্ষুক, যার পরনে শতচ্ছিন্ন শাড়ি, ট্রেনের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। আবিরের মনটা খচখচ করে উঠলো, কিন্তু রহস্যের হাতছানি তাকে এগিয়ে নিয়ে গেল। আবির ট্রেনে উঠলো এবং একটি ফাঁকা সিটে বসলো। ট্রেনের ভেতরটা বাইরে থেকে যেমনটা জরাজীর্ণ লাগছিল, ভেতরটা ঠিক ততটাই ভুতুড়ে। পুরনো মরচে ধরা বগি, ধূসর রঙের আসন, আর বাতাসে এক অদ্ভুত স্যাঁতসেঁতে গন্ধ।
ট্রেন চলতে শুরু করলো। স্টেশনের আলো দ্রুত মিলিয়ে গেল আঁধারের অতল গহ্বরে। ট্রেনের একমাত্র আলো ছিল হলুদটে বাল্ব, যা এক রহস্যময় আভা ছড়াচ্ছিল। আবির দেখলো, তার পাশের সিটে বসে আছে এক যুবক, যার হাতে একটি পুরনো ডায়েরি। যুবকটি আনমনা হয়ে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে আছে। আবির কথা বলার চেষ্টা করলো। "কোথায় যাচ্ছেন ভাই?"
যুবকটি চমকে উঠলো। তার নাম রবিন, সে একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ। রবিন জানালো, সে কালরাত্রি এক্সপ্রেস নিয়ে গবেষণা করছে। তার মতে, এই ট্রেনটি আসলে কোনো ভৌতিক সত্তা নয়, বরং এটি এক প্রাচীন সভ্যতার প্রযুক্তি, যা সময় আর স্থানের মধ্যে যাতায়াত করতে পারে। তার হাতে থাকা ডায়েরিটি ছিল তার দাদার। তার দাদা নাকি এই ট্রেন নিয়ে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন এবং তিনিও একদিন এই ট্রেনে চড়েই নিখোঁজ হয়েছিলেন। রবিন তার দাদাকে খুঁজতেই এই ট্রেনে উঠেছে।
আবিরের মনে এক নতুন আশার সঞ্চার হলো। রবিন যদি তার দাদাকে খুঁজে বের করতে পারে, তাহলে হয়তো সে তার বোন রিমুকেও খুঁজে পাবে। তারা দু'জন মিলে ট্রেনের রহস্য উদঘাটনের সিদ্ধান্ত নিলো।
রাত বাড়তে লাগলো, ট্রেনের গতিও বাড়লো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে শুধু গাঢ় অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। হঠাৎই ট্রেনের ভেতর নিস্তব্ধতা ভেঙে এক শিশুর কান্নার শব্দ ভেসে এলো। আবির আর রবিন একে অপরের দিকে তাকালো। এই পরিবেশে এমন একটি শব্দ সত্যিই হাড় হিম করে দিচ্ছিল। শব্দটা অনুসরণ করে তারা ট্রেনের পেছনের বগির দিকে এগোলো।
ট্রেনের একেবারে শেষ বগিতে গিয়ে তারা যা দেখলো, তা তাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। সেখানে শত শত মানুষের কঙ্কাল স্তূপ করে রাখা। কঙ্কালগুলোর গায়ে তখনও পোশাকের ছেঁড়া অংশ লেগে আছে। আর সেই কঙ্কালগুলোর মাঝেই বসে ছিল এক অদ্ভুত শিশু, যার চোখগুলো যেন জ্বলছিল এক অলৌকিক আভায়। শিশুটি অনবরত কাঁদছিল।
আবিরের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এলো। সে রবিনকে টেনে নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে সরে এলো। ভয় আর বিস্ময়ে তাদের শরীর কাঁপছিল। রবিন দ্রুত তার দাদার ডায়েরি খুলে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। ডায়েরির এক পাতায় লেখা ছিল, "কালরাত্রি এক্সপ্রেস, সে শুধু যাত্রী নেয় না, সে তাদের আত্মাকেও গ্রাস করে। এই ট্রেন কোনো গন্তব্যে পৌঁছায় না, এ শুধু অসীম শূন্যতায় পরিভ্রমণ করে।"
হঠাৎই ট্রেনটি এক ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ট্রেনের ভেতরকার সমস্ত আলো নিভে গেল। আবির আর রবিন একে অপরের হাত ধরে ভয়ে কাঁপতে লাগলো। আবির তার ফোন বের করে টর্চ জ্বালালো। আলোয় দেখলো, ট্রেনের সব যাত্রীই যেন কেমন নীরব, নিশ্চল হয়ে বসে আছে। তাদের চোখগুলো অপলক, যেন তারা প্রাণহীন পুতুল।
সেই সময় ট্রেনের স্পিকারে এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, "আপনারা সবাই কালরাত্রি এক্সপ্রেসের অংশ। এই ট্রেন আপনাদের নিয়ে যাবে এক নতুন দিগন্তে, যেখানে জীবনের কোনো অর্থ নেই, শুধু আছে অনন্ত যাত্রা।"
রবিন চিৎকার করে উঠলো, "এটা একটা বিভ্রম! আমাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে!" সে আবিরকে টেনে নিয়ে ইঞ্জিনের দিকে ছুটতে লাগলো। তাদের বিশ্বাস, ইঞ্জিনের কাছেই এই ট্রেনের রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে।
অনেক কষ্টে তারা ইঞ্জিনের কাছে পৌঁছালো। সেখানে ছিল একটি বিশাল কক্ষ। কক্ষের মাঝখানে একটি অদ্ভুত যন্ত্র, যা থেকে নীলচে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। যন্ত্রটির চারপাশে অনেকগুলো লিভার আর বোতাম। রবিন তার দাদার ডায়েরিতে লেখা নির্দেশাবলী অনুসরণ করে যন্ত্রটি বন্ধ করার চেষ্টা করলো। আবির তাকে সাহায্য করলো।
যখন তারা যন্ত্রটি বন্ধ করতে যাচ্ছিল, তখন তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো একটি ছায়ামূর্তি। মূর্তিটি দেখতে হুবহু আবিরের বোন রিমুর মতো। আবির হতবাক হয়ে গেল। "রিমু!"
ছায়ামূর্তিটি হাসলো। সেই হাসিটা ছিল বিভীষিকাময়। "আমি রিমু নই, আবির। আমি এই ট্রেনের আত্মা। এই ট্রেনই রিমুকে গ্রাস করেছে, যেমনটা সে গ্রাস করেছে আরো হাজারো মানুষকে। তোমরাও এর অংশ হতে যাচ্ছ।"
আবিরের হৃদয় ভেঙে গেল। সে রিমুকে বাঁচাতে পারলো না। কিন্তু সে হাল ছাড়লো না। রবিনকে ইশারা করলো যন্ত্রটি চালু রাখার জন্য। আবির সেই ছায়ামূর্তির দিকে ঝাঁপিয়ে পড়লো, তাকে বাধা দেওয়ার জন্য। রবিন এই সুযোগে যন্ত্রের একটি লিভার টেনে দিলো।
এক তীব্র আলোয় ঝলসে উঠলো পুরো ইঞ্জিন কক্ষ। আবির চোখ বন্ধ করলো। যখন সে চোখ খুললো, তখন দেখলো, সে একটি জনশূন্য প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। কালরাত্রি এক্সপ্রেস সেখানে নেই। রবিনও নেই। আবির একা, সম্পূর্ণ একা। তার হাতে একটি ভাঙা ডায়েরি।
আবির তার হাতে থাকা ডায়েরিটি দেখলো। সেটি ছিল রিমুর ডায়েরি। তার ভেতর এক পাতায় রিমুর হাতের লেখায় লেখা ছিল – "দাদা, তুমিও এখানে এসেছো? আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাকে ফেরাতে পারবো না।"
চমকে উঠলো আবির। তাহলে কি রিমু নিজেই এই ট্রেনের অংশ হয়ে গিয়েছিল? আর তাকে বাঁচানোর চেষ্টায় সেও কি কোনো এক ফাঁদে পা দিয়েছে? এই যাত্রার কি কোনো শেষ নেই? প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকাতেই আবির দেখলো, দূরে একটা লাইনে আবার সেই কালচে লাল আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। ট্রেনটি আবার আসছে... তার দিকে। আবির কি সত্যিই ফিরে এসেছে, নাকি সে এখন কালরাত্রি এক্সপ্রেসের এক অনন্ত যাত্রী?
অমাবস্যার রাত তখনো শেষ হয়নি, আর কালরাত্রি এক্সপ্রেসের রহস্যও অমীমাংসিতই রয়ে গেল।