07/07/2022
পারফিউম: একজন খুনীর গল্প!
নট ফর সেল ক্লাব থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে প্যট্রিক সাসকিন্ড এর "পারফিউম: একজন খুনীর গল্প" এর অনুবাদ।
মুভির সুবাদে বইটির মুল থিম অনেকেরই জানা। মুভির খাতিরে চিত্রনাট্য একটু ভিন্নভাবে তৈরি হয়। বাণিজ্যকরণের কারণে মুল বইয়ের সাহিত্যরস কিছুটা বিঘ্ন হয়। সাহিত্য আর মুভির এ পার্থক্য সঙ্গত কারণেই হয়ে থাকে।
আমি মুভিটি দেখেছি। মুখবন্ধ লেখার সুবাদে অনুবাদটিও পড়েছি। মুভি থেকে যা আমি বুঝতে পারিনি বই থেকে তা আমি পুরোটাই আত্মস্থ্য করেছি- তা হলো গ্রেনোয়ের মনস্তত্ব। বন্ধুদের জন্য আমার বোধগত উপলব্ধি শেয়ার করছি।
সৃষ্টির খেয়ালে স্বতন্ত্র এক প্রতিভা নিয়ে জন্মানো পারফিউম গল্পের নায়কের স্বাভাবিক মানুষের মত কোনো চাহিদা নেই। তার মনোজগতে ভিন্ন এক আলোড়ন। ভিন্ন এক অনুসন্ধিৎসা যা সৃষ্টি করতে চায় পৃথিবীর সেরা পারফিউম। অথচ সৃষ্টিশীল এই মানুষটি বোঝে না নৃশংসতার অর্থ। তার কেবল এক ধ্যান। জগতের সেরা পারফিউম তৈরির ধ্যান। নিষ্ঠুরতম, অমানবিক উপায় সে বেছে নেয় তার উদ্দেশ্য সফল করতে। সমাজ মেনে নিবে কেন? যত সাবধানীই সে হোক দেশের আইন তার পক্ষে থাকতে পারে না। শুরু হয় তাকে আটকের খোঁজ।
সমাজের আউটকাস্ট একজন মানুষ - জগতের প্রতি যার কোনো আগ্রহ নেই, নেই ক্ষুধা, তৃষ্ণা, যৌনতার আহ্বান। গন্ধহীন শরীরে অস্বাভাবিক এক প্রতিভা এবং বোধ নিয়ে সে সফল হয় তার সেরা পারফিউম তৈরির গোপন প্রজেক্টে। আবার তেমনি যেনো মুক্তি পায় অমানবিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নিজের নামহীন জীবন থেকে।
বইটি পড়তে পড়তে ক্রমান্বয়ে গ্রেনোয়ের প্রতি যে রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা তৈরি হয় পড়া শেষ হলে কখন যেন স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ না পাওয়া প্রকৃতির আশীর্বাদ বঞ্চিত বা অভিশপ্ত এই বোধ প্রতিবন্ধী মানুষটির জন্য ভিন্ন এক অনুভূতি তৈরি হয় মনন জুড়ে। চিন্তারা অস্থির হয়। প্রকৃতি কেন কিছু মানুষকে এত অভিশপ্ত করে? সভ্যতা কি এইভাবেই বিবর্তিত হয়েছে কিছু মানুষের আত্মত্যাগে?
পাঠকের মন ভারাক্রান্ত ভাবনায় আত্মমগ্ন হয়ে পড়বে বইটির শেষ লাইনে এসে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও থমকে যাবে উপলব্ধমান পাঠকের চিন্তাশক্তি। এখানেই লেখকের স্বার্থকতা। স্বার্থকতা অনুবাদকের। গভীর মনস্তত্ত্বাত্বিক বইটির মনস্তত্ব ভিন্নভাষার পাঠকের কাছে তিনি সঠিক আবেদনে তুলে ধরতে পারঙ্গম হয়েছেন।
মানুষের ব্যতিক্রমী প্রতিভা এবং মনস্তত্ব নিয়ে লেখা এই বইটি বিশ্ব নন্দিত হয় কোয়ালিটি পাঠকের সমাদরে। বইটি ৪৯ টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এই কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। এই বইয়ের অনুপ্রেরণায় জার্মানীতে টিভি সিরিজ এবং আমেরিকায় টিভি সিরিজের একটি এপিসোড হয়েছে এবং রাশিয়ায় মঞ্চ নাটক হয়েছে।
বইটি পড়তে পড়তে একজন চিহ্নিত অপরাধীর জন্মগত পাওয়া প্রতিভার প্রতি যেমন অনুরক্ত হয়ছে আমার হৃদয় তেমনি তার বিবেচনাহীন নিষ্ঠুরতায় আমার বিবেকবোধকে সমান আলোড়িত করেছে তার শাস্তি কামনায়। কিন্তু শাস্তি পেতে দেখে আবার গ্রোনয়ের প্রতি দরদে ভরেছে মন। মনে হয়েছে এমনি নাম না জানা কত গ্রোনোয়ে প্রকৃতির বৈষম্যমূলক খেলার শিকার। তার দোষ কোথায়? বইটি পাঠ শেষে ব্যথিত মনে হৃদয়ের গভীরে ভিন্ন এক আলোড়নে নিস্তব্ধ দেখেছি নিজের বোধের অনুরণনকে।
আশা করি একজন খুনীর পাশাপাশি সৃষ্টির বৈষম্যের শিকার একজন গ্রেনোয়কে জানতে নট ফর সেল ক্লাবের এ যাত্রায় সঙ্গী হয়ে বইটি সংগ্রহ থেকে নিজেকে দূরে রাখবেন না।
*******
আউট অফ দ্যা ডার্ক - বোহেমিয়ান এক প্রেমিকের গল্প
হাই বন্ধুরা,
আজ বাংলা নববর্ষ। সবাই কত কত শুভেচ্ছা পাঠায়। ভালবাসার কথা বলে। ভাল থাকার কথা বলে। আমি না হয় এক অন্যরকম ভালবাসার কথা শুনাই।
নট ফর সেল ক্লাব নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত ফ্রেঞ্চ লেখক প্যাট্রিক মোদিয়ানি'র উপন্যাস আউট অফ দা ডার্ক এর অনুবাদ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে আর এক বিখ্যাত সাহিত্য "পারফিউমের" সঙ্গে out boxed conjoined twins book হিসেবে।
ডামি প্রচ্ছদে ক্লাব একটি দু'মুখি মুখোশ দেখিয়েছে।
আমার মনে হয়, দুটি বইয়ের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রকে বোঝাতেই এই প্রচ্ছদ। পারফিউম - এক খুনীর গল্প। পক্ষান্তরে আউট অফ ডার্ক - এক প্রেমিকের গল্প। এই দুই বিপরীত চরিত্রের উপন্যাস নিয়ে ক্লাবের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ - conjoined twins book.
নববর্ষের শুভেচ্ছা স্বরূপ আমি যে প্রেমিকের কথা বলব, তার নামটিও জানি না। কারণ নোবেলজয়ী লেখক প্যাট্রিক মোদিয়ানী তার 'আউট অফ ডার্ক' - এ উত্তম পুরুষের মনোলগে বলা অধরা প্রেমের গল্পে মুল চরিত্রের নামটি পুরো বইয়ের কোথাও বলেননি।
২০১৪ সালে নোবেল একাডেমীর স্থায়ী সেক্রেটারি পিটার ইংলাউন্ড বলেন 'আউট অফ দা ডার্ক' এর প্যাট্রিক মোদিয়ানোকে বেছে নেয়ে হয়েছে এই কারণে যে তাঁর লেখা –“স্মৃতির শিল্পের জন্য, যার সঙ্গে জাগরুক করেছেন মানুষের চূড়ান্ত অধরা নিয়তি, এবং উন্মোচিত করেছেন দখলদারিত্বের জীবন-বিশ্ব”।
মানুষ তার নিজেকে খোঁজে। অন্তরাত্মাকে খোঁজে। কারো হয়তো সারাজীবন ধরে চলে অনন্ত সে খোঁজ। উত্তম পুরুষের মনোলগে লেখা এই উপন্যাসের কোথাও প্রধান চরিত্রের নাম উল্লিখিত হয়নি। ধরে নেই লেখক নিজেকেই খুঁজেছেন পুরো উপন্যাস জুড়ে। প্রধান নারী চরিত্র জ্যাকুলিন সেই খোঁজের এক উপলক্ষ। জ্যাকুলিনকে নয়, জ্যাকুলিনের মাঝে লেখক হয়তো খুঁজে ফিরেছেন তার নিজেকেই। নিজের ভিতরাত্মার সন্ধান। এ সন্ধান কখনো শেষ হয় না। এখানে একটু, ওখানে আধাটুকু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। পূর্ণাঙ্গ চিত্র কখনোই হয় না। কারোই কি হয়? নিজেকে প্রশ্ন করলেই সেই উত্তর পাওয়া যায়।
লেখক মোদিয়ানো এই উপন্যাসে অল্প সংখ্যক চরিত্রের মাধ্যমে অখণ্ডিত প্লটে শুধু ঘটনা বর্ণনা করেছেন, মনস্তত্ব বিবৃত করেননি। শুধুমাত্র চরিত্রদের দিনলিপির বর্ণনায় পাঠকদের মনে কেন্দ্রীয় চরিত্রদের অন্তর্জগতের ধারণা স্পষ্ট করতে পারার সক্ষমতা মোদিয়ানোকে অন্য লেখকদের থেকে আলাদা করেছে।
এই উপন্যাসের চরিত্ররা আগাগোড়া বোহেমিয়ান। তাদের কারো স্থায়ী কোন বাসস্থান নেই। মানুষের অন্তর্জগতের সাথে তা যেনো অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। মানুষের মনের কি আসলেই কোনো আবাস আছে? স্থায়ী আবাস? না, নেই। অন্তর্জগতে, নিজের অধরা অস্তিত্বে মানুষের মনও চিরকালীন বোহেমিয়ান। পাঠক নিবিড়ভাবে নিজের অন্তরসায়রে ডুব দিয়ে এই সত্যটি নিজেই অনুধাবন করতে পারেন।
উপন্যাসটির পটভূমি প্যারিস ও লন্ডন শহর কেন্দ্রিক। পড়াশোনা ছেড়ে প্যারিস শহরে পুরানো আর্ট বই বিক্রিকালীন সময়ে লেখক পরিচিত হন জেরার্ড ভ্যান, বিভার ও জ্যাকুলিনের সাথে, যাদের স্বপ্ন ছিল রুঁলেতে একটা বড় বাজিমাত করে দ্রুত অর্থ উপার্জন করার। শুরুতেই লেখক জ্যাকুলিনের প্রেমে পড়েন, অথচ এটা স্পষ্ট হয় না যে- জ্যাকুলিন তার প্রেমে পড়েছে।
বিভার, কার্টুডের সাথেও ভিন্ন ভিন্ন ফর্মে জ্যাকুলিনের ছিল প্রেমের সম্পর্ক। শারীরিক সম্পর্কে জড়ালেও লেখকের প্রেম প্রকাশ্যে আসে না। কিন্তু ধ্যানে, জ্ঞানে, সৌন্দর্যে, আকর্ষণে জ্যাকুলিন তাকে এমনি অদৃশ্য বাঁধনে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে যে জ্যাকুলিনের আজ্ঞাবহ হয়ে সে চুরি করতেও দ্বিধা করে না। এত করেও জ্যাকুলিনকে লেখকের পাওয়া হয় না।
জ্যাকুলিনের সাথে পনের বছর পর লেখকের আবার দেখা হয় লন্ডনে। তখনও তারা আগের মতই বোহেমিয়ান। তবে এই দেখা এবং জ্যাকুলিনের সাথে লেখকের স্বল্পকালীন বসবাস লেখককে লেখক হওয়ার উপযোগ যোগায়।
পড়াশোনা ছেড়ে পুরানো আর্ট বই বিক্রি দিয়ে জীবন চালানো একজন বোহেমিয়ান হঠাৎ করেই লেখার উপাদান পায় এবং সে লেখা হয় উঁচু মানের। হঠাৎ করেই বা দৈবাৎ কিছু কি হয়? মানুষের জীবন যাপনের অভিজ্ঞতাই একজন মানুষকে তৈরি করতে থাকে অলক্ষ্যে এবং তার বেস্টটি বের হয়ে আসে একদিন, আচানক। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের লেখক তৈরি হওয়ার এই যে উপলক্ষ এটাও প্রণিধানযোগ্য। জ্যাকুলিন সেই উপলক্ষ। সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য কোনো না কোনো একজন বা নিজের মতো একজন জ্যাকুলিন থাকা অপরিহার্য।
ঘটনার পরম্পরা প্যারিস থেকে লন্ডন হয়ে আবার প্যারিস শহর।
লেখক মোদিয়ানো যেন জ্যাকুলিনের মাঝে দেখিয়ে দেন আজকের মানুষদের এ্যলিয়েনেসনের ক্রাইসিস, যেখানে মানুষ নিজেই জানে না যে সে কী করবে। পাঠকের মনোজগত আলোড়ন তুলে লেখক গল্পটি শেষ করেন রুঁ দ্যা প্যারিসের ক্যাফের অনবদ্য কাব্যিক বর্ণনায়।
প্যারিস শহর ঘুমায় না; জেগে থাকে রাতের আঁধারে কোনো কারণ ছাড়াই, আলো জ্বেলে! এই গল্পের চরিত্ররা পথচারী। পথেই যেন বেড়ে ওঠে। তারা জানে না যে তারা কী চায়, কী তাদের উদ্দেশ্য, জীবনের লক্ষ্যই বা কী? মোদিয়ানো গল্পটি শেষ করেন এক চূড়ান্ত অসম্পূর্ণতায়। ঠিক যেন আজকের বিশ্বায়িত পৃথিবীর অনিশ্চিত যাপিত জীবনের মত।
নোবেলজয়ী সাহিত্যিকের সাহিত্যের উৎকর্ষতা নিয়ে বেশিকিছু বলার প্রয়োজন থাকে না। নিজের দেশের বাইরে পৃথিবীটা আরও অনেক বড়। সেখানে অন্য মানুষ অন্য কালচারে অন্য সুখ-দুঃখ নিয়ে বাঁচে। বিশ্ব সাহিত্যকে আমার মনে হয় যেন নিজের সামনে এক আয়না যাতে ভিন্ন দেশের ভিন্ন কালচারে জীবন যাপন করা অচেনা চরিত্ররাও পরিচিত হয়ে ওঠে।
কথিত আছে, মূল বইয়ের স্বাদ অনুবাদ গ্রন্থে পাওয়া যায় না। কথাটি খুব সত্য। কিন্তু এই অনুবাদক আক্ষরিক অনুবাদ অর্থাৎ ট্রানশ্লেট করেন না। তিনি ভাবানুবাদ করেন তার অনন্য সাহিত্যগুণের পরিচয় রেখে। সে আঙ্গিকে বলা যায় যে, অসাধারণ এই ভাবানুবাদ গ্রন্থটি মুল বইয়ের অ্যাসেন্স ধরে রাখতে সম্পূর্ণই সক্ষম হয়েছে। অক্ষরে, ভাষায়, বর্ণনার সৌন্দর্যে, উপলব্ধির গভীরতায়।
একজন সাহিত্যানুরাগী হিসেবে আমি খুবই আনন্দিত নোবেলজয়ী লেখকের এই সাহিত্যটি পাঠকের জন্য মলাটবন্দি করার নট ফর সেল ক্লাবের ব্যতিক্রমী প্রয়াসে।
অনুবাদক এবং ক্রয় নয় অর্জনে উৎসাহী নট ফর সেল ক্লাবের প্রতি প্রত্যাশার কলেবর কেবল বেড়ে গেল।
.… শিরিন শবনম