14/11/2025
তিন উপদেষ্টাকে অপসারণসহ তিন দাবি ৮ দলের
সংবাদ সম্মেলনে
সেন্ট্রাল ডেক্স, দৈনিক নোয়াখালী সময় ডট নেটঃ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে তিনজন উপদেষ্টা ‘বিপথে চালিত’ করছেন বলে দাবি করেছেন জামায়াতের ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। এই উপদেষ্টাদের কারো নাম না বলে আট দলের তরফে তাদের অপসারণ, আলাদাভাবে গণভোটের তারিখ ঘোষণাসহ তিন দফা দাবি তুলে ধরেছেন তিনি। শুক্রবার সকালে আট দলের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের নায়েবে আমির তাহের বক্তব্য রাখছিলেন। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিতে আট দলের কর্মসূচির ফাঁকে বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস একই দিনের জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে গণভোট আয়োজনের ঘোষণা দেন।তার পরপরই জামায়াত তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে ‘জনআকাঙ্ক্ষা পূরণ’ হয়নি। শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে দলটির নায়েবে আমির তাহের বলেন, “আমরা পরিষ্কার করে এখন বলতে চাই, এক. প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন…একই দিনে নির্বাচন গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান, সেটা পরিবর্তন করে অনতিবিলম্বে আলাদাভাবে গণভোট করার তারিখ উনি ঘোষণা করবেন, এটা আমরা আশা করি।
“দুই. সরকারে কমপক্ষে তিনজন উপদেষ্টা আছেন যারা প্রধান উপদেষ্টাকে মিসগাইড করছেন, আমরা তাদের অপারেশন দাবি করছি। আপনারা হয়ত প্রশ্ন করবেন যে তাদের নাম বলেন। আমরা আজকেও নাম বলতে চাই না। তবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের নাম আমরা প্রেরণ করব।”তিন নম্বর দাবি তুলে ধরে তিনি বলেন, “প্রশাসনের যে সমস্ত পরিবর্তন হচ্ছে সেখানে নিরপেক্ষ, বিশেষ করে সৎ এবং জবাবদিহির আওতায় থাকতে পারে এরকম মনোভাবের লোকদেরকেই নিয়োগ করতে হবে। নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার জন্য সেখানে চেষ্টা করতে হবে…আমরা এই তিন দাবি জানাচ্ছি।”মঙ্গলবার ঢাকায় সমাবেশ করে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনসহ পাঁচ দাবি পূরণ না হলে রোববার প্রধান উপদেষ্টা বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করে আট দল।
সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে নেতা তাহের বলেন, আগামী ১৬ নভেম্বর ঢাকায় ৮ দলের শীর্ষ বৈঠকে পরবর্তী কর্মকৌশল ঠিক করে তা জানানো হবে।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে শুক্রবার মগবাজারে আল-ফালাহ মিলনায়তনে আট দলের উদ্যোগে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। জামায়াত ছাড়া অন্য দলগুলো হল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপার একাংশ ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি)।
‘ব্যালেন্স করা সরকারের কাজ না’
এক প্রশ্নের জবাবে তাহের বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে একটি দলের প্রতি আনুগত্যে প্রকাশ পেয়েছে। এর মাধ্যমে জাতি যে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করেছিল জাতির সে আকাঙ্ক্ষা ব্যাহত হয়েছে।
“বিএনপি শুরু থেকে উচ্চকক্ষ, নিম্নকক্ষ- কোথাও পিআর মানে না বলেছিল। গতকালকে ভাষণে পিআর সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন যে, এক্সেপ্টেড হবে।”
প্রধান উপদেষ্টা বিএনপি ও জামায়াতের দাবি পূরণ করে দুই পক্ষের কথা রাখার চেষ্টা করেছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আসলে কোনো ব্যক্তির বা রাষ্ট্রের বা কোনো সরকার প্রধানের কোনো দলের সাথে ‘ব্যালেন্স’ করা, তার কোনো কাজ না, এটা দায়িত্বও না।
“যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে, দেশের জন্য, জাতির জন্য যেটা উত্তম কোনো সরকারকে সেটাই করতে হবে।”
গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একদিনে করার পেছনে ব্যয় সাশ্রয়ের যে কথা বলা হচ্ছে তা ‘খোঁড়া যুক্তি’ বলে মন্তব্য করে জামায়াত নেতা তাহের বলেন, “আমরা আবার বলছি, আমরা চাই, গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন যদি একই দিনে করা হয়, তাহলে গণভোটের গুরুত্ব একেবারেই ম্লান হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে সংস্কার ইস্যুটি আছে সেটাও প্রশ্ন বোধক হতে পারে, এমনকি ‘মাইরও’ খেয়ে যেতে পারে।”
‘প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে হতাশাজনক’
তাহের বলেন, “গতকালকে উনার (প্রধান উপদেষ্টা) ভাষণে আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি, সরকার তার নিয়োজিত কমিশনের সুপারিশকে গ্রহণ না করে সেখানে যথেষ্ট কাটছাট দিয়ে, একটি দলের সাথে ব্যাপক সমঝোতা করে জনগণের স্বার্থে নয়, একটি বিশেষ দলের স্বার্থে অনেক পরিবর্তন এনে তিনি ভাষণ দিয়েছেন। যার ফলে জনগণ এবং দেশবাসী অত্যন্ত হতাশ হয়েছে।
“একটা বিষয়ে উনি কিছুটা দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে পেরেছেন। সেটা হচ্ছে আদেশের বিষয়। বিএনপি কখনোই আদেশের মাধ্যমে এটাকে সাংবিধানিক ভিত্তি দেওয়ার ব্যাপারে একমত ছিল না, তারা বিরোধিত করেছিলেন, তারা একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই সংস্কারগুলোকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব করেছিল। এখানে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত আদেশ দেওয়ার যে সুপারিশ, সেটার উপরে উনি দৃঢ় ছিলেন। এজন্য উনাকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।”
তিনি বলেন, “তবে আমাদের সংস্কার কমিশন যে আঙ্গিকে প্রস্তাব করেছিল, সেখান থেকে তার (প্রধান উপদেষ্টার) ভাষণে সনদের ব্যাপারে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। সেটা সঠিক হয়েছে বলে আমরা মনে করি না।
“আমরা মনে করি, আমাদের সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাব দিচ্ছিল হুবহু সেটার ভিত্তিতে আদেশ দেওয়াটা বাঞ্ছনীয় ছিল। তারপরও যতটুকু আদেশ দিয়েছেন সেটাকে আমরা গ্রহণ করছি এবং সেজন্য তাকে আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি।”গণভোটের প্রশ্ন নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হবে মন্তব্য করে জামায়াতের এই নেতা বলেন, “আমাদের যে সংস্কার কমিশন ছিল, তারা প্রস্তাব দিয়েছিল ‘ওয়ান সেট অফ ওয়ান প্যাকেজিং’ ‘হ্যাঁ’/‘না’ ভোট নেওয়ার জন্য। কিন্তু কালকে আমরা বিস্ময়ের সাথে দেখলাম যে সংস্কার কমিশনের একটি প্যাকেজকে চারটা ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। যেটি জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে অনেকটাই জটিলতার ভিতরে ফেলে দেবে। “কারণ আমাদের দেশের মানুষ এতগুলা পয়েন্টে বিশ্লেষণ করে তাদের মতস্থির করাটা, এটা কঠিন হবে এবং এখানে একটা জটিলতা তৈরি করা হয়েছে।”‘একটি দলের অবৈধ আবদার’
তাহের বলেন, “ঐক্যমত্য কমিশন যে প্রস্তাব করেছিল যে সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার কোন সুযোগ তারা রাখে নাই। এটি একটি দল তার নোট অব ডিসেন্টকে ভোটের আনার জন্য প্রস্তাব করেছিল। আপনারা জানেন যেটা একেবারেই একটি অবৈধ আবদার ছিল। কারণ নোট অব ডিসেন্ট হচ্ছে, কোনো একটি দলের তার মত ভিন্নতা আছে।”
‘একটি দলের দাবিই পুরণ করা হয়েছে’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব করা তাহের বলেন, “ঐকমত্য কমিশন বলেছে যে এই সনদের আদেশের পরে যারাই নির্বাচিত সরকারে আসবে তারা ১৮০ কার্য দিবসের মধ্যেই এগুলোকে সাংবিধানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আর যদি না করে এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে গৃহীত হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। এখানে এটা গ্রহণ করার একটা স্বয়ংক্রিয় বাধ্যবাধকতার সুযোগ এখানে ছিল এবং এটাই বাঞ্ছনীয়। “কোনো দল ক্ষমতায় গিয়ে যদি এটা করতে না চায়, তাইলে তার উপরে বাধ্যবাধকতা থাকার সুযোগ না থাকলে, তাহলে এই যে সনদ এতদিনের ঐকমত্য কমিশনের যে প্রচেষ্টা সেটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে পরিপূর্ণভাবে।” কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে এই বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি তুলে ধরে তিনি বলেন, “এটাও বিএনপির দাবিকেই পূরণ করা হয়েছে। তারা বলেছেন করতে হবে এবং করতে হওয়ার যে আইনি ব্যাখ্যাটা এটা সরকার সেখানে দেয়নি।…তাহলে বাধ্যবাধকতার যে পয়েন্টটা ছিল সেখান থেকেও সরকার সরে আসছে এবং এটাও বিএনপির দাবিকেই পক্ষান্তরে পূরণ করা হয়েছে।”
‘প্রধান উপদেষ্টাকে বিভ্রান্ত করছেন তিন উপদেষ্টা’
জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, “আজকে আমি খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, প্রধান উপদেষ্টাকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করছেন তিনজন উপদেষ্টা। তারা ভুল তথ্য দিয়ে নানাভাবে বুঝিয়ে একটি দলের হয়ে কাজ করে সরকারকে একটি সুষ্ঠ নির্বাচন যাতে হতে না পারে সেদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সুকৌশলে অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।”
‘আট দল ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত’
তাহের বলেন, “আমরা এই মুহূর্তে স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিতে চাই, আমরা আট দল এবং আমাদের সাথে আরো কিছু দল আছে যারা ফরমালি না আসলেও আমাদের সাথে যোগাযোগ আছে, আমরা সকলেই আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে রোজার আগেই একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক…এ ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞবদ্ধ। সেজন্যই আমরা আমাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করার জন্য আমরা মাঠে কাজ করছি।
“কিন্তু যেই কারণে জনগণ বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের আমলে বঞ্চিত হয়েছিল ভোট থেকে এবং সেরকম অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আজকে বাংলাদেশের এই দুরবস্থা তৈরি হয়েছে। ঠিক একইভাবে আরেকটি নির্বাচনের মহড়া চলছে কিনা? আরেকটি পরিকল্পিত এবং পূর্বনির্ধারিত নির্বাচনের রায়ের ভিত্তিতে নির্বাচন হচ্ছে কি না, এ ব্যাপারে আমাদের মনে এবং জনগণের মনে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে “তিনি বলেন, “সরকারের আচরণ আমাদেরকে এই কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য করছে যে এই সরকারের অধীনেও কোন সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার সম্ভব নয়, নির্বাচন অবাধ হওয়ার ব্যাপারে আমাদের ভিতরে যথেষ্ট শঙ্কা এবং আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। “আমরা দেখছি এই সরকার আসার পর থেকে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’, যেটা তৈরির জন্য আমরা বলেছি সেটার ব্যাপারে সরকার আদৌ মনোযোগী নন। “বরং সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার সহযোগিতায় একটি বিশেষ দলের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে দলীয় প্রশাসনে রূপান্তর করার জন্য চেষ্টা হচ্ছে।”