20/09/2024
১৯৭১ সাল, দেশ স্বাধীন হল। পশ্চিম পাকিস্তুানের শাসনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী হলো এবং বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে পরিচিত হল। নতুন দেশ হবার সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তুানের সময়কার পুরানো অনেক কিছু পরিবর্তন হল,
পাক মোটর হল বাংলা মটর
জিন্নাহ এভিনিউ হল বঙ্গবন্ধু এভিনিউ
কায়েদে আজম কলেজ হল শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ
অনেক কিছু পরিবর্তন হল, অনেকে পলাতক হল, আত্মগোপনে গেল, কিন্তু সে সময়কার জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের খাতীব আগের মতই নিজের দায়িত্ব চালিয়ে যেতে লাগলেন। মজার বিষয় যিনি সে সময় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের খাতীব, যার জন্ম হিন্দুস্তানের বিহারের এবং জীবনের অন্যতম মূল অংশ হিন্দুস্তানে ছিল এবং সবচেয়ে বড় বিষয় তিনি ছিলেন উর্দূভাষী মানুষ বাংলা বুঝতেন কিন্তু বাংলায় কথা তেমন একটা বলতে পারতেন না। আর তিনি বায়তুল মুকাররমে শুধু আরবী খুতবা দিতেন ও নামায পড়াতেন।
একটাবার চিন্তা করে দেখুন যে উর্দূভাষার সাথে বিরোধোর জোর এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের আলোকে পুরো একটি নতুন দেশ বাংলাদেশ তৈরী হল, তার খাতীব একজন উর্দূভাষী মানুষ যিনি আরামেই গুলিস্তানে আওয়ামীলীগের মূল পার্টি অফিসের পাশে বায়তুল মুকাররমে তার দায়িত্ব চালিয়ে যাচ্চেন। তার গ্রহণযোগ্যতা এমন ছিল যে বিজয় অর্জিত হবার পর তিনি বায়তুল মুকাররমে খাতীবের দায়িত্ব চালিয়ে নিতে ইতস্ত বোধ করলে সে সময় মুক্তিযোদ্ধারা তাকে অভয়বাণী দিয়ে বলল হুজুর আপনি নির্ধিধায় আপনার খাতীবের দায়িত্ব চালিয়ে যান, ইনশাআল্লাহ কেউ আপনার কোন ক্ষতি করবেনা।
কিন্তু এরকম সর্বজন গ্রহণযোগ্য মানুষ বায়তুল মুকাররমের ভাগ্যে রইল না বেশীদিন। ১৯৭৪ সালে তার সাথে তৎকালীন মসজিদ কমিটির কিছু লোকের সাথে একটা সামান্য বিষয় নিয়েই একটা বড় কনফ্লিকট হয়েছিল যেটার কোন সুষ্ট সমাধান আসল না। ১৯৭৪ সালের সে বছর ঈদুল ফিতরের ঈদের জামাত জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমে ইমামতি করলেন এবং আসার সময় খাতীবের কামরার চাবি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ফেরত দিয়ে বললেন আমি আর বায়তুল মুকাররমে আসব না। তার সেই বক্তব্য “ আমি আর বায়তুল মুকাররমে আসব না” এই কথাই কিন্তু ছিল তার ইস্তফা এবং এটাই আল্লাহ কবুল করে নেন।
এর পর তার জীবনে মাত্র একটি জুমা এসেছে, সে জুমা তিনি বায়তুল মুকাররমে জান নি, নিজের মহল্লার মসজিদ আদায় করলেন তাও মুসল্লী হিসেবে, তার মেজ ভাইয়ের ইমামতিতে জীবনের সর্বশেষ জুমা আদায় করেন। তার পরের দিন শনিবার ভোর রাত ৪টার দিকে তিনি ইন্তেকাল করেন। ১ই শাওয়াল ঈদুল ফিতরের নামায যেটা তিনি বায়তুল মুকাররমে পড়িয়েছিলেন সেটাই তার জীবিত অবস্থায় শেষবার বায়তুল মুকাররমে যাওয়া, এরপর তার লাশই গিয়েছে তার জানাযা নামাযের জন্য।
একজন খাতীবের জন্য তার মিম্বার এর সম্মান দুনিয়ার যে কোন রাজা বাদশাহের সিংহাসনের চেয়েও প্রিয়। কিন্তু বর্তমানের আলিম সমাজের অবস্থা সমাজের যা হবার হোক, মসজিদে যা খুশী হোক মিম্বার ছাড়া যাবে না। জান চলে যাক, সম্মান চলে যাক কিন্তু ইমামতির জায়নামাজটা আমার।
এই আজীমুশান খাতীবের ভক্ত, ছাত্র, মুরীদের কোন কমতি ছিল না, চাইলে তাদের সাথে নিয়ে যে কোন রাজনৈতিক চাল প্রয়োগ করে অনায়সেই তার মত করে বায়তুল মুকাররমে থাকতে পারতেন। কিন্তু ছিলেন প্রচারবিমুখ এক নকশবন্দী মুজাদ্দেদী সিলসিলার সূফী মানুষ, তার উপরে একজন সাঈয়্যেদজাদা প্রবল আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি যিনি বায়তুল মুকাররমের খিতাবাতের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে আসেন। এবং জাতীয় মসজিদ বায়তুল মুকাররমের ইতিহাসে একমাত্র খাতীব যিনি আমৃত্যু খাতীব ছিলেন না বরং ইস্তফা করে আসেন। যেহেুতু তার ইস্তফার ১০ দিনের মাথায় তার ইন্তেকাল হয়ে যায় তাই অনেকে ভাবে তিনিও মনে হয় আমৃত্যু খাতীব ছিলেন, কিন্তু বিষয়টি মোটেই সেটা না।
অনেকে বায়তুল মুকাররমের ইমাম,খাতীব,মুয়াজ্জিন হবার কারণে পরিচিত লাভ পায়, সমাজে মাশহুর হয়, কিন্তু এই আজীমুশান ব্যক্তি বায়তুল মুকাররমের খাতীব হওয়ার পর বায়তুল মুকাররমের পরিচিতি আরো বৃদ্ধি পায়। এরকম একজন ক্ষনজন্মা আলেমেদ্বীনকে মাদ্রাসার উলামা, ছাত্র বাদে বর্তমানে জেনারল লাইনের খুব কম মানুষই চিনে। কারণ তিনি কোন কওমী-দেওবন্দী ঘরানা থেকে নয় পুরোপুরি আলিয়া নিসাবের একজন আলেম ছিলেন।
তাঁর সম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য যেনে নেয়া যাক
►তিনি একজন নাজিবুত্তারাফাইন (পিতা ও মাতা উভয়ই সাইয়্যেদ) এবং পিতা ও মাতা উভয়ই সূত্রেই প্রিয়নবীর বংশধর
►তিনি কলকাতায় ছিলেন বিখ্যাত নাখোদা মসজিদের GRAND M***I এবং ঢাকায় আগমনের পর মুফতী এ আযম নামে বিখ্যাত ছিলেন।
►তিনিই একমাত্র এমন ব্যাক্তি যিনি দুই বাংলার ঈদগাহতে (কলকাতা এবং ঢাকা) ইমামতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
►তিনি আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি যিনি আলীয়া মাদ্রাসারই ছাত্র ছিলেন এবং পরবর্তী তিনি সেই মাদ্রসার হেড মাওলানা হোন।
►তিনি মাদ্রাসার সিলেবাসভুক্ত বিভিন্ন কিতাব, মিজানুল আখবার, কাওয়াদুল ফিকহ, ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার কিতাবের রচয়িতা
►তিনিই বাংলাদেশে নামাযের চিরস্থায়ী কালেন্ডার প্রণয়ন করেন
এই মহান ইসলামী ব্যক্তির নাম হচ্ছে মুফতী এ আযম সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আমীমুল ইহসান বারকাতী নকশবন্দী মুজাদ্দেদী (রহ:)। বাংলাদেশের সৌভাগ্য তার মত এমন এক উজ্জল দীপ্তীমান নক্ষত্র যিনি বাংলার জমীনেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।