22/04/2025
- আব্বা, ঘাস লাগাইলে জ্বলে অইনে।
- ধুর ব্যাটা, পোলা মানুষ না তুই? পোলা মাইনষের এত নরম হইলে হয়? শক্ত হয়া বইসা থাক, এট্টু পরেই ব্যাথা যাইব গা দেহিস। ছুইলা যাওয়া যাগায় ঘাস লাগায়া দিলে ছুলা যাগা তাড়াতাড়ি ভালো হয়।
সোলাইমান আর কিছু বলে না। হাশেমের কথায় শক্ত হওয়ার একটা ভাব ধরে বসে থাকে কিন্তু চোখ বেয়ে পানি পড়তেই থাকে। একে তো অন্য বাচ্চাদের সাথে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে হোচট খেয়ে পড়ে গিয়ে কুনুই এর কাছে ছিলে গেছে তার উপর তার বাবা হাশেম মিয়া ক্ষত যায়গায় দুর্বা-ঘাস চিবিয়ে লাগিয়ে দিচ্ছে। দুর্বা-ঘাসের জন্য আরো জ্বলছে ক্ষত যায়গাটা। সোলাইমানের বয়স কেবল ৫ বছর। সোলাইমান যখন জন্ম নেয় তখন তারা কুড়িল বস্তিতে একটা ছোট খুপরিতে থাকতো। তার বাবা সোলাইমান নবীর নামের সাথে মিলিয়ে তার নাম রাখে। সোলাইমান নবী ছিলেন নবীদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী। সোলাইমান নবী ছিলেন তার আমলের রাজা। বলা হয় অর্ধেক দুনিয়া শাসন করেছেন তিনি। আর নবী হওয়ার কারণে আল্লাহওয়ালা ছিলেন। হাশেম মিয়ারও ইচ্ছা তার ছেলে একদিন মস্ত ধনী হবে তবে দিলের মধ্যে কোনো অহংকার থাকবে না ছেলের। ছেলে হবে আল্লাহওয়ালা।
- আব্বা, ক্ষিদা লাগছে।
- তোর মা আহুক। মায় আইলেই খাওনের ব্যবস্থা হইব নে। কেবল তো সন্ধ্যার আজান দিবো। এই ভর সন্ধ্যাকাইলে আজানের সময় খাওন লাগে না। পরেই খা এট্টু।
- আইচ্ছা।
সোলাইমান আর কিছু বলল না। সকালের দিকে তার বাবা তাকে ফড়িং ধরে দিয়েছিল একটা। সুতোয় বেঁধে সেই ফড়িং ঝুলিয়ে রেখেছিল ঘরের পিছনে। তারই খোঁজ নিতে লাফাতে লাফাতে ঘরের পিছনের দিকে চলে গেল সে। হাশেম মিয়া কিছুটা উদাস হয়ে পড়লো। বাচ্চা ছেলেটা। ক্ষুধা লেগেছে অথচ ঘরে কোনো খাবারই নেই। ঘরে কিছু মুড়ি ছিল, কিন্তু সেই মুড়িও দুপুরে খেতে দিয়েছিল ছেলেটাকে। খেতে দিয়ে ভেবেছিল ছেলেটা হয়তো তাকে একটু সাধবে। কিন্তু ছেলে একাই সব মুড়ি খেয়ে উঠেছিল। সকালে খায়নি ছেলেটা, দুপুরে ক্ষুধা একটু বেশি লাগবেই স্বাভাবিক । তার উপর খুব বেশি মুড়িও ছিল না। হবে হয়তো ২-৩ মুঠো। তবে সোলাইমান এর বড় বোনটা বেঁচে থাকলে এমনটা হতো না। মেয়েটা বড় আদরের ছিল। বাপ বলতেই পাগল ছিল মেয়েটা। বাবার সাথে ভাগ না করে কোনো কিছু খেত না। সোলাইমানের জন্মের ৬ মাসের মাথায় মেয়েটা মারা গেল। ডেঙ্গুজ্বরে সাত দিন ভুগে আট দিনের দিন সকালে মারা গেল। জমানো টাকা পয়সা যা ছিল সব খরচ করেও মেয়েটাকে বাঁচাতে পারেনি। এরপর থেকেই টানা দুর্দশা তাদের জীবনে। মেয়ে মারা যাওয়ার পরপরই হাশেমের অ্যাক্সিডেন্ট হয়। এক সিএনজি এসে ধাক্কা দেয় পেছন থেকে। হাসপাতালে ভর্তি হয়। অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকেই বাম পা টা প্যারালাইসিস হয়ে পড়ে রয়েছে। যেখানে কাজ করতো সেখান থেকে ছাটাই হলো সে। বস্তির ঘর ভাড়া জমলো ৬ মাসের। ভাড়া বকেয়ার জন্য ঘরের আসবাবপত্র রেখেই বস্তিছাড়া হতে হয় তাদেরকে। বাধ্য হয়ে এখন গাবতলিতে নদীর পাড়ে এখানে এসে উঠেছে। যায়গাটা বড্ড নোংরা। ঘরের পিছনেই এলাকার সব ময়লা এনে ফেলে সবাই। এখানেই মুখোমুখি দুই সিরিয়ালে ২০টা ঘর তোলা। তাদেরই একটায় থাকে হাশেমরা। যায়গাটা হাসেমের পছন্দ না। কিন্তু বাধ্য হয়ে থাকতে হচ্ছে। হাসেমের স্ত্রী মাজেদাই কীভাবে কীভাবে যেন এই যায়গার খোঁজ পেয়েছে। বস্তিছাড়া হবার পর সপ্তাহখানেক কমলাপুর রেলস্টেশনে থেকেছে তারা। কিন্তু খোলা যায়গায় ঘুমানো সমস্যা তাও আবার মেয়েছেলে নিয়ে। বাধ্য হয়ে এখানে এসে উঠেছে৷ তবে এই যায়গার সমস্যাই একটা, এখানে কয়েকটা ঘরে কিছু মেয়েছেলে থাকে, তারা ভালো না। খারাপ কাজ করে বেরায়। আল্লাহ তা'আলা এমন মেয়েছেলের জন্যই হয়তো বলেছেন যে জাহান্নামে মেয়েলোকের সংখ্যা বেশি হবে। এমন একটা যায়গায় থাকাটা নিরাপদ মনে হচ্ছে না হাশেমের। তার উপর ইদানীং তার বউটাও রাত করে বাড়ি ফিরছে। আগে যেখানেই কাজ করুক না কেন সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরতো। বিষয়টা খুব একটা ভালো লাগছে না হাশেমের। তার অ্যাক্সিডেন্টের পরে থেকেই হন্যে হয়ে কাজ খুঁজে বেরাচ্ছে মাজেদা। যেদিন যেখানে যে কাজ পাচ্ছে তাই করছে। সংসারটা তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তবে রাত করে ফেরাটা হাশেমের পছন্দ না। একদিন রাতে ঘুমানোর সময় জিজ্ঞেস করায় মাজেদা একটু রাগ দেখিয়েই বলেছিল,
- এই ঢাকা শহরে কাম পাওন কী এতো সোজা? রাত হইলে আমি কি করুম? কথা বাদ দিয়া ঘুমান। রাইত ম্যালা হইছে।
হাশেম আর কিছু বলতে পারেনি। মেয়েটা অনেক চেষ্টা করছে সংসারটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য। তার উপর আবার কিছু টাকা জমাচ্ছে কোথায় নাকি একটা দোকান দেখেছে। দোকান নিবে সে। কিন্তু এই যে, কথায় কথায় মাজেদা রাগ দেখায় এটা তো ভালো না। আল্লাহ নারাজ হন। হাজার হোক হাশেম মিয়া তো তার স্বামী। স্বামীর সাথে বেয়াদবি করলে আল্লাহর কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হওয়া লাগে। হাশেম মিয়া অবশ্য এসব নিয়ে কিছু মনে করে না, উলটো আল্লাহর কাছে দু'আ করে, আল্লাহ যেন মাজেদার ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দেন৷ মেয়েটার মেজাজ ইদানীং গরম থাকে। তবে তার মন পরিষ্কার। আগে মেজাজও ঠান্ডা ছিল। বাইরে কাজ করতে গিয়ে এখন মেজাজ চড়া হচ্ছে। হতেই পারে। হাশরের দিন পেয়ারের নবী (স.) ব্যতিত কেউই শাফায়াত করতে পারবেন না। নইলে হাশেম মিয়া এই মাজেদার জন্য শাফায়াত করতো। মাজেদাকে সে অনেক ভালোবাসে।
এতকিছু ভাবতে ভাবতে হাশেমের পেটেও হয়তো একটু ক্ষুধার ভাব হয়েছে। লুঙ্গি কোচর থেকে বিড়ির প্যাকেটটা বের করলো। আজকে সারাদিনে ৩ টা বিড়ি ছিলো। সকালে আর দুপুরে দুইটা শেষ। শেষ বিড়িটা এখন খাবে নাকি আরেকটু পরে খাবে বুঝতে পারছে না। বিড়ি খেলে ক্ষুধার ভাবটা একটু কমতো। সারাদিন ধরে না খাওয়া সে। মনে মনে ভাবছে মাজেদা যদি আজকেও খালি হাতে ফিরে তাহলে কি হবে? রাতটা তো ক্ষিধে নিয়েই পার করতে হবে। তার চেয়ে বিড়িটা পরে খাওয়াই ভালো হবে ভেবে আবার লুঙ্গির কোচরে গুজে রাখলো প্যাকেটটা।
রাত পৌনে দশটার দিকে মাজেদা ফিরে আসলো। ঘরে ঢুকতেই সোলাইমান দৌড়ে গেল মায়ের দিকে।
- মা, ক্ষিদা লাগছে।
- এট্টু পরেই খাওন দিতাছি বাপ।
হাসিমুখে দুইটা চুমু খেল ছেলের গালে। কিন্তু মাজেদার চোখে অস্থিরতা। কিছুটা শক্তভাবেই কিন্তু কম আওয়াজে হাশেম মিয়াকে বলল,
- সোলাইমানরে নিয়া এট্টু বাইরে যান তো। ঘুইরা আসেন নদীর পাড় থিকা। ঘন্টা খানেক পরে আসেন। আর এই দশ টাকা দিয়া ওরে কিছু কিন্না দেন গা। আমার কাম আছে এট্টু।
হাশেম মিয়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে স্ত্রীর দিকে। গত সপ্তাহেও একইরকম ভাবে এসে একই কথা গুলোই বলেছিল মাজেদা। কিছু বুঝতে না পেরে মজিদ উঠতে যাবে তখনই দেখলো এক মধ্য বয়স্ক লোক, পান চিবুতে চিবুতে ঘরে ঢুকলো মাজেদার পিছন পিছন। লোকটা জিজ্ঞেস করলো মাজেদাকে,
- কি ব্যাপার! হইছে নি?
মাজেদা জবাব দিল,
- খাড়ান একটা মিনিট।
হাশেম মিয়া মাথা নিচু করে বাশের লাঠিটায় ভর দিয়ে অনেক কষ্টে বের হলো ঘর থেকে। বা পায়ের জন্য হাটাচলাও ঝামেলা তার। মাজেদাও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো ঘরের ভেতরেই। সোলাইমানকে ডাক দিলে সেও বাবার পিছন পিছন বের হলো ঘর থেকে। গত সপ্তাহেও একই ঘটনা ঘটেছিল। পার্থক্য শুধু, গত সপ্তাহে বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল আর আজকে বাইরে অনেক চাঁদের আলো। একদম খাঁ খাঁ করছে দুনিয়াটা। পূর্নিমাই নাকি আজকে কে যানে। হাশেম মিয়া মুখ তুলে উপর দিকে চেয়ে রইলো। বিরবির করে কী যেন বলতে লাগলো সে। হয়তো আল্লাহর কাছে মাজেদার জন্য ক্ষমা চাচ্ছে অথবা তার নিজের জন্যই চাচ্ছে। অথবা নিজের অদৃষ্টের দোষ দিচ্ছে। কে যানে?
🔶 #ফড়িং🔶
#সাড়ে_সায়ত্রিশ_ডিগ্রী