মণিপুরী এবং মীতৈ দুটি সমার্থক শব্দ।
মণিপুরী জাতিগোষ্ঠীর লোক নিজেদের মধ্যে মীতৈ আর অন্য জাতিগোষ্ঠীর কাছে মণিপুরী হিসেবে পরিচিত। মণিপুরীদের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা আছে। মণিপুরী ভাষাকে মীতৈ লোন বা ভাষা এবং বর্ণমালাকে মণিপুরী লিপি বা মীতৈ ময়েক বলা হয়।
অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, মণিপুরীদের পূর্ব পুরুষরা মঙ্গোলীয় মহাজাতির তিব্বত ব্রহ্ম শাখার কুকি-চীন গোষ্ঠী হতে আগত । তাই এই মীতৈ লন বা মণিপুরী ভাষাও তিব্বত
ব্রহ্ম শাখার কুকি-চীন ভাষার অন্তর্গত।
মণিপুরীদের আদি বাস ভূমি বর্তমান ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মণিপুর যা প্রাচীনকালে "পৌইরেই মৈতৈ", "কাংলৈপক", বা "মৈত্রবাক" নামে পরিচিত ছিল। তেমনি মণিপুরী বা মীতৈ তার প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর কাছেও বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। যেমন- অসমীয়াদের (আসাম রাজ্য) কাছে মেখলী বা মেখলে, কাছাড়ীদের কাছে মোগলী, বার্মীজদের কাছে কথে ইত্যাদি।
বর্তমানে মণিপুরীরা সারা বিশ্বে কম বেশী ছড়িয়ে আছেন। সবচেয়ে বেশী ভারত, বাংলাদেশ ও মায়ানমারে (বার্মা)। কয়েক বছর আগের এক বেসরকারী জরিপ মতে সারা বিশ্বে প্রায় ১৮ লক্ষ ৫০ হাজারের উপরে মানুষ মণিপুরী ভাষায় কথা বলে, যেখানে বাংলাদেশে প্রায় ২৫,০০০।
পূর্বে মণিপুরীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে বসবাস করলেও বর্তমানে বেশির ভাগ মণিপুরী সিলেট বিভাগে বসবাস করছে।
মণিপুরীরা খুবই সৌখিন ধরনের। তাই মণিপুরীদের শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য সেই প্রাচীনকাল হতে অনেক প্রসিদ্ধ। এর মধ্যে মণিপুরী নৃত্য, মণিপুরী বুনন শিল্প বিশেষ করে মণিপুরী কাপড় জগৎবিখ্যাত। তালোয়ার বাজি বা মার্শাল আর্ট শাস্ত্রেও মণিপুরীরা খুবই দক্ষ।
প্রাচীন কালে মণিপুরীদের পূর্বপুরুষরা বিভিন্ন বিষয়ে অনেক পুঁথি (মণিপুরী ভাষায় পুয়া) লেখেছেন যার মধ্যে সবচেয়ে আদি ও গুরুত্বপুর্ণ পুঁথি হচ্ছে "চৈথারল কুম্বাবা"। "চৈথারল কুম্বাবা" মূলত মণিপুরী রাজামালা। এই পুঁথিতে মণিপুর রাজ পন্ডিতেরা সাল তারিখ সহ কোন রাজা কখন সিংহাসনে বসেছেন, কত বছর রাজত্ব করেছেন, তাদের রাজত্বকালে কী কী উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে , মণিপুরীদের বিভিন্ন প্রথা, শাসন ব্যবস্থা, কখন কারা এ রাজ্যে প্রবেশ করেছে সব কিছুর তথ্য মণিপুরী লিপিতে লিখে রাখতেন। তাই মণিপুরীদের আদি ইতিহাস জানার জন্য "চৈথারল কুম্বাবা" পুঁথি বা গ্রন্থটি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। এই গ্রন্থ মতে মণিপুর রাজ্যের প্রথম রাজা ছিলেন 'নংদা লাইরেন পাখাংবা' যিনি ৩৩খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৫৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ১২১ বছর মণিপুর রাজ্য শাসন করেন। যদিও বহু ঐতিহাসিক ও পন্ডিতগণের মতে 'নংদা লাইরেন পাখাংবা' এর অনেক আগে থেকে মণিপুরে বিভিন্ন রাজা শাসন করেছেন কিন্তু তাদের সঠিক কোন তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। তাই সুনির্দিষ্ট তথ্যসূত্র মতে 'নংদা লাইরেন পাখাংবা'-কে মণিপুরের প্রথম রাজা ধরা হয়। 'চৈথারল কুম্বাবা' গ্রন্থে এরকম আরও ৭৬ জন রাজার নাম ও তাদের রাজত্ব কালের আলোচিত ঘটনাপুঞ্জির একটি সূক্ষ্ম ধারণা পাওয়া যায়।
মণিপুরীদের বহু প্রাচীন প্রায় সাড়ে তিন হাজার পুরনো নিজস্ব একটি বর্ষ গণনা পঞ্জি রয়েছে। এই পঞ্জি মূলত চান্দ্র গণনা রীতির পঞ্জি। এ থেকেও জানা যায় মণিপুরীরা জ্ঞানে বিজ্ঞানে সমসাময়িক যেকোনো উন্নত সভ্যতা থেকে পিছিয়ে ছিলো না।
ঐতিহাসিক কিছু ঘটনা এই সমৃদ্ধ মণিপুরী জাতির পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা, অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে (১৭০৯-১৭৪৮) মণিপুরের রাজা পামহেইবা (গরীবনেওয়াজ) রাজত্বকালে মণিপুরীদের আদি ধর্ম "সানামাহি" বা "অপোকপা" থেকে হিন্দু বৈষ্ণব ধর্মকে রাজ ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা। পরবর্তীতে হিন্দু ধর্মের প্রচারক শান্তিদাস গোস্বামীর কুপ্ররোচনায় রাজা মণিপুরী বা মীতৈদের সকল আদি পুঁথি বা পুয়া পুড়িয়ে ফেলার আদেশ মণিপুরীদের ইতিহাসে এক কলঙ্কের অধ্যায় রচনা করে।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী মণিপুরীদের সংখ্যা অতি নগণ্য। বহু বছর ধরে মূল ভূখন্ড মণিপুর থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেও আজও মুল ধারার বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে নিজেদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ও ভাষাকে স্বসম্মানে বাঁচিয়ে রেখেছে। সাথে বাঙালি সংস্কৃতিকেও সমান তালে লালন করে চলছে। বাংলা ও মণিপুরী ভাষায় সাহিত্য চর্চা করছে। এসব যেন 'বাংলাদেশী মণিপুরী'-দের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করার এক মহান লড়াই। এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে পারবে কিনা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না।
তথ্যসূত্র-
চৈথারোল কুম্বাবা,
A Short History of Manipur - R. Brown,
The Meitheis - T. C. Hodson,
Gazetteer of Manipur - E. W. Dun,
A History of Manipur - J. Roy,
History of Manipur(1826-1949) - Lal Dena,
A History of Manipuri Literature - Ch. Manihar Singh
ইতিহাসের আলোকে ত্রিপুরা - মণিপুর - এল বীরমঙ্গল সিংহ, পান্নালাল রায়।
e-pao.net