13/06/2025
৬ হাজার টাকা বেতনের ইমাম, অভাব যখন বউ তালাকের কারণ হয়। আজ গিয়েছিলাম গফরগাঁও উপজেলার এক গ্রামীণ সালিশে, আমার বাড়ি থেকে ৪০ কিলো, দূরে ছোটখাটো একটা পারিবারিক সমস্যা দেখতে গিয়েছিলাম নিরপেক্ষভাবে। তবে সেখানে গিয়ে চোখ খুলে দিলো এক করুণ বাস্তবতা।
একজন মসজিদের ইমাম আমাকে ডেকেছিলেন তার পক্ষে কথা বলার জন্য যেহেতু আমিও একজন আলেম সাংবাদিক। তিনি চেয়েছিলেন, আমি তাকে একটু সহানুভূতির চোখে দেখে বউটাকে সহজে ছাড়াছাড়ির ব্যবস্থা করে দেই । আমি ও মাসিক নকিবের সহযোগী সম্পাদক তাশরিফ আহমাদ কে নিয়ে গেলাম সেখানে।
কিন্তু সালিশে বসে যখন তার সংসারের বিবরণ শুনলাম, তখন নিজের অবস্থান বদলে গেল, তাশরিফ ভাইকে মোবাইলে লিখে দেখালাম মেয়েটা নির্যাতিত ও অসহায় এবং জামাই পাগল মেয়ে। শেষে ইমামের বিপক্ষেই রায় দিয়ে চলে আসতে হলো।
এই ইমাম সাহেবের মাসিক বেতন মাত্র ৬ হাজার টাকা। এই টাকায় তিনি একটি সংসার চালান।
চালান মানে—হাঁপিয়ে বেঁচে থাকা।
তার স্ত্রী—একজন পর্দানশীল গৃহিণী,
অসুস্থ হয়েও ঔষধ আনতে পারেন না।
চিকিৎসা করা তো স্বপ্ন।
টানা এক মাস আধা-কেজি সিলবার মাছ ও শুধু চেপা শুটকি আর ভাত খেয়ে কাটিয়েছেন মেয়েটি। ইমাম সাহেব মসজিদে থাকে সেখানেই খায়, সপ্তাহে বৃহস্পতিবার রাতে বাড়িতে যায় ।
এভাবেই দারিদ্র্য তাদের ভালোবাসার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। তালাক পর্যন্ত গড়িয়েছে সম্পর্ক। সংসারে অভাব অনটন ঝগড়াঝাটি বাড়িয়ে দিয়েছে। একে অপরের শত্রুর মতো আচরণ করছে।
তবুও, সেই স্ত্রী—সব সহ্য করেও—তার স্বামীকে ছাড়তে চান না।
তিনি তাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চান, কারণ স্বামী আলেম।
কারণ, সেই মানুষটিকে তিনি ভালোবাসেন। বাবার বাড়িতে যখন শুনেছেন স্বামী তাকে তালাক দিবে পাগলের মতো ছুটে এসেছে স্বামীর মসজিদে। হাতে পায়ে জড়িয়ে ধরেছে ক্ষমার আশায়। এটাই সমাধান নয়, পারিবারিক ভাবে ঝগড়া ছড়িয়ে পরেছে। এই বউ রাখবে না, বউয়ের অনেক দোষ।
বউটা কেঁদে উঠে বলে আমি অসুস্থ হলেও উনি একহালি ডিম অথবা ৫ টা ওরস্যালাইন এনে দিতে পারেন না, কিছু চাইলে বলেন উনার কাছে টাকা নাই।
একটা প্রশ্ন বারবার মনে ঘুরপাক খায়—
এভাবে কি কেউ বাঁচতে পারে?
এই সমাজ, এই ধর্মপ্রাণ লোকজন, এই মসজিদের ট্রাস্টি ও কমিটিরা—
সবাই কী চোখে দেখে একজন ইমামকে, যে মাস শেষে মাত্র ছয় হাজার টাকা পায়?
এতটুকু আয় নিয়ে কীভাবে চালানো যায় সংসার? এই মানুষটি কোনো অসুস্থ, কর্মহীন বা অক্ষম নন। তিনি সুস্থ, পরিশ্রমী।
তিনি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ান,
মানুষকে ধর্ম শেখান, মৃত্যুর সময় পাশে থাকেন, জানাজা পড়ান, কবর পর্যন্ত যান—
কিন্তু যখন তার স্ত্রীর জ্বর হয়, তখন তার ঘরে প্যারাসিটামল কেনার টাকাও থাকে না।
রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেও পরিশ্রম করতেন, অন্যের বাগানে কাজ করতেন, তাঁর স্ত্রী ছিলেন ঘরের ভেতরে সম্মান নিয়ে বসবাসকারী রমণী। তাঁরা একে অপরের পরিপূরক ছিলেন।ইমাম সাহেব কী অন্য কাজ করতে পারেন না?
কিন্তু আজকের দিনে?
একজন ইমামকে আমরা দিয়েছি শুধু দায়িত্ব,
কিন্তু দেইনি তার জন্য ন্যায্য মর্যাদা,
দেইনি তার স্ত্রীর জন্য সামান্য সম্মান,
দেইনি ভালোবাসা টিকিয়ে রাখার ন্যূনতম সামর্থ্য।
এই সমাজে ইমাম শুধু নামাজ পড়ায় না,
সে একটা পরিবারের একমাত্র ভরসা,
একজন স্ত্রীর আশ্রয়, এক শিশুর নিরাপত্তা।
তাকে ৬ হাজার টাকায় বেঁধে রেখে আমরা তাকে তার সম্মান থেকে বঞ্চিত করি।
আর সেই কষ্টে একদিন ভালোবাসাও শুকিয়ে যায়, সম্পর্কও ফাটল ধরে।
সালিসের শেষ করলাম, হুজুরকে বললাম আপনি ইমামতির পাশাপাশি অন্য কিছু করুন, আর এই মেয়েকে তালাকের কথা বললে মনে করবেন ওর একটা ভাই হিসেবে ওর পাশে আমি আশরাফ দাঁড়াবো। এই কথা শেষ করতেই মেয়েটাকে বললাম রাগ করে চলে যাওয়াটা আপনার অপরাধ ছিলো, বলার সাথে সাথে স্বামী ও শশুরের পায়ে পরে মাফ চাচ্ছে।
সব শেষে তাদের একসাথে মিলিয়ে দিয়ে আসলাম।
আজকের সেই সালিশ থেকে ফিরে আসার পর আমার মনে একটাই কথা বাজছে—
এভাবে চলতে পারে না।
ইমামতির পেশা পবিত্র।
কিন্তু সমাজ যদি এই পবিত্র মানুষগুলোর পেট ভরতে না পারে, তাহলে এই সমাজের বিবেকের ইমামতিও প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়।
Asraf Ali faruki vair wall theke