12/06/2025
অপেক্ষার পহর
(পলাশ দেব নাথ)
১
সকাল ন’টার আগেই কল্যাণী উঠে পড়ে, বিছানার চাদরটা গুছিয়ে রাখে, একটা হালকা শাড়ি পরে রান্নাঘরে যায়। আজ অনেকগুলো কাজ আছে, কিন্তু তার মন পড়ে আছে ঘড়ির কাঁটার দিকে।
সে জানে, আজও রুদ্র আসবে না। তবু সে চায়ের কাপটা বানিয়ে বারান্দার ছোট্ট টেবিলটায় রাখে। দুটো কাপ—একটা নিজের, আরেকটা রুদ্রের।
পাঁচ বছর ধরে এমনই চলছে।
পাড়া-প্রতিবেশীরা একসময় হাসত। কেউ বলত, "অবসাদে ভুগছে বোধহয়", কেউ বলত, "বয়স তো তেমন হয়নি, আবার বিয়ে করলে ক্ষতি কী?"
কিন্তু কল্যাণী জানে, সে অপেক্ষা করে। যে প্রতীক্ষার নাম—"পহর"।
রুদ্র বলেছিল, "একদিন ফিরব। হয়তো ঠিক সময়মতো না, কিন্তু ঠিক ফিরব। ততদিন অপেক্ষা কোরো, কল্যাণী।"
সে বলেছিল, “আমি থাকব, ঠিক বারান্দার কোণটায়।”
২
রুদ্র আর কল্যাণী একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। রুদ্র ছিল সাহিত্যের ছাত্র, আর কল্যাণী ইতিহাসের। প্রথম দেখা হয়েছিল ক্যাম্পাসের পুরনো লাইব্রেরিতে।
কল্যাণী বইয়ের তাক থেকে একটি পুরোনো পাণ্ডুলিপি নামাতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। পেছন থেকে রুদ্র হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলে তাকে।
প্রথম স্পর্শেই যেন লেখা হয়ে গেল এক অসমাপ্ত কবিতা।
তারপর কথা, চিঠি, নীরবতা, ভালোবাসা—সব মিলিয়ে সাত বছর কেটেছিল। রুদ্র চেয়েছিল লেখক হবে, আর কল্যাণী বলত, “তোমার লেখা একদিন Nobel পাবে।”
তবে বাস্তব ছিল কঠিন। সংসারের টান, চাকরির অভাব, আর পারিবারিক চাপ।
একদিন হঠাৎ রুদ্র বলেছিল,
"আমি চলে যাচ্ছি। উত্তরবঙ্গে, একটা ছোট পত্রিকার কাজ পেয়েছি। সময় লাগবে। তুই ততদিন থাকিস। আমি একদিন ঠিক ফিরব—তুই অপেক্ষা করবি তো?"
কল্যাণী শুধু মাথা নেড়েছিল।
৩
এভাবে কেটে গেছে দশ বছর।
কল্যাণীর বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। একা বাড়ি, একা সকাল, একা রাত।
প্রতিদিন দুপুরবেলা কল্যাণী খোলে সেই পুরোনো চিঠিগুলো—রুদ্রের হাতের লেখা, হলুদ হয়ে আসা কাগজে ভালোবাসার প্রতিটি শব্দ আজও জ্বলজ্বল করে।
মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করে, “সে কি বেঁচে আছে?”
কখনও ভাবে, “হয়তো কোথাও ভুল করে গেছে সে। হয়তো সে ফিরত, যদি পারত।”
তবু তার অপেক্ষা থামে না।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে প্রতিদিন দেখে রিকশা থামে, গাড়ি আসে, ছেলে-মেয়েরা হাসে, কেউ নামে, কেউ যায়—কিন্তু রুদ্র আসে না।
৪
একদিন হঠাৎ পাড়ার এক ছেলে এসে বলল,
“কল্যাণী দিদি, তোমার নামে একটা পার্সেল এসেছে, রুদ্র ঘোষ নামের একজন পাঠিয়েছেন।”
কল্যাণী ধাক্কা খেয়ে যায় যেন।
সিঁড়ি ভেঙে দৌড়ে নামে। হাতে নেয় প্যাকেটটা। কাঁপা হাতে খোলে—
ভেতরে আছে একটা ডায়েরি, কিছু চিঠি, আর একটা ছোট নোট:
“আমার লেখা শেষ হয়নি, কল্যাণী। কিন্তু শরীরটা পেরে উঠছে না। ডাক্তার বলেছে সময় কম। শেষ চিঠিটা তোমার জন্যই রেখে গেলাম। জানি, তুই অপেক্ষা করেছিস—আমি ফিরতে পারিনি, কিন্তু বিশ্বাস কর, তোকে আমি একদিনের জন্যও ভুলিনি।”
ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা—
“কল্যাণী, তুই আমার প্রতীক্ষার পহর। সময় তোর কাছে হেরে গেছে, কিন্তু তুই জিতেছিস। তোর ভালোবাসা যে অমর। আমি আসতে পারিনি, তবু তুই যেন জানিস, আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে তুই ছিলিস, আছিস, থাকবি।”
৫
সেদিন বারান্দায় শুধু এক কাপ চা রাখা ছিল।
রুদ্রের কাপটা আজ আর রাখেনি কল্যাণী।
সে জানে, অপেক্ষারও শেষ আছে।
কিন্তু কিছু অপেক্ষা পেরিয়ে যায় মৃত্যুকেও।
সেই পহর বয়ে চলে—নিঃশব্দে, অশ্রুতে, আর ভালোবাসায়।
---
শেষ।
(একটি অমর প্রতীক্ষার কাহিনি)
---
গল্পটি যদি আপনার কাছে ভালো লাগে তাহলে লাইক কমেন্ট শেয়ার করে যাবেন। নতুন কিছু দেখতে পেইজে ফলো করে রাখবেন।ধন্যবাদ আপনাকে।