06/09/2025
মৌলভীবাজার শহরের নামকরা এক বেসরকারি হাসপাতালের অভিজ্ঞতা আমাকে ভিতরে ভিতরে নাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম আধুনিক ভবন, বড় বড় ডাক্তারদের নাম আর পরিচিত ব্র্যান্ডের হাসপাতাল মানেই হয়তো নিরাপদ সেবা। কিন্তু ভেতরে গিয়ে বুঝলাম—এটা হাসপাতাল নয়, আসলে এক ধরনের ব্যবসার আখড়া। এর বাস্তব অভিজ্ঞতা হলো আমার সন্তানের জন্মের সময় ‘লাইফলাইন হাসপাতাল’-এ কাটানো চারদিন।
গত মাসের শেষ বৃহস্পতিবার রাত তিনটার দিকে গর্ভবতী স্ত্রীকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাই। শহরের অন্যতম “চকচকে” এই হাসপাতালে ভেবেছিলাম সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পাবো। কিন্তু সেখানে পেলাম বয়সে তরুণ একজন মাত্র কর্তব্যরত চিকিৎসক। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তো দূরের কথা, কোনো ধরনের জরুরি সহায়তাও পাওয়া গেল না। শুধু এক-দু’টি ট্যাবলেট দিয়ে রোগীকে কেবিনে ফেলে রাখা হয়। পরদিন শুক্রবার সকাল ১১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পেলাম না। এমনকি রাত ১২টা থেকে সকাল ১০টার আগে মেডিকেল টেস্টও নাকি এখানে করানো যায় না।
সকাল ১১টায় আল্ট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট হাতে পেয়ে ফোনে এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতালের দায়িত্বশীলরা জানালেন, আমার স্ত্রীকে সিজার করাতে হবে— নরমাল ডেলিভারির দায়িত্ব তারা নেবেন না। অথচ ভর্তির পর থেকে প্রায় ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা কার্যত দেওয়া হয়নি।
যাহোক বিকল্প কোনো উপায় না পেয়ে, রাজি হলাম। একে একে আমার পছন্দের ৩জন সার্জনের নাম দিলাম। তারা কাউকেউ পেলো না। শেষমেষ আরেকজনের নাম দিলে তারা জানালো দুপুর ১২ টায় সিজার করতে পারবেন।
১২টার আগেই সহধর্মিণীকে অপারেশন রোমে নিয়ে গেলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়— সার্জন কখন অপারেশন রোমে ঢুকলেন আর কখন বের হলেন, দেখতেও পাইনি। এমনকি আমার সঙ্গে একটি কথাও হয়নি সার্জনের। সিজার শেষে মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে মা ও নবজাতককে কেবিনে পৌছে দিলো হাসপাতালের লোকজন। মনে হলো এ পর্যন্তই যেন তাদের দায়িত্ব শেষ!
এরপর থেকে নার্সদের দায়িত্ব কেবল টাইমমতো ওষুধ দেওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রইল।
অপারেশনের পর সেবার মান ছিলো করুণ। নার্সদের আচরণ ছিলো যান্ত্রিক, চিকিৎসকদের আন্তরিকতা ছিলো শূন্য। ডিউটি ডাক্তারের থাকেন ৫ম তলায়। ইমার্জেন্সী কল দিলে তিনি আসেন ১০-১৫মিনিট পর।
নবজাতকের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা-পরামর্শও যথাসময়ে দেওয়া হয়নি।
আমার নবজাতক মায়ের বুকের দুধ পাচ্ছে কি না, কেনো এত কান্না করছে, চোখে সমস্যা কিংবা ওজন কমছে কেন— এসব বিষয়ে তাদের দায়সারা ভাব ছিলো। একাধিকবার জানানো সত্ত্বেও ডিউটি ডাক্তার শুধু ‘দেখছি’ বলে দায়িত্ব শেষ করলেন। ফলাফল— তিনদিনের মাথায় আমার সন্তানের জন্ডিস ধরা পড়লো। অথচ যেসব নার্স দায়িত্বে ছিলেন তাদের বেশিরভাগই সদ্য পাশ করা, আর দায়িত্বরত ডাক্তারদের বয়স ২৫-এর নিচে হবে৷
৪র্থ দিন শিশু বিশেষজ্ঞ এক ডাক্তার কল দিয়ে এনে দেখালাম৷ তিনি দেখে বললেন, বাচ্চা ৩দিন ধরে বুকের দুধ পাচ্ছে না সেটা কেনো খেয়াল করা হলো না? এবং জন্মদিন থেকেই বিকল্প উপায়ে দুধ খাওয়ানো উচিত ছিলো।
হতাশ হয়ে বিষয়টি জানালাম হাসপাতালের পরিচালক রতন সাহেবকে। তিনি ম্যানেজারকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিলেন। ম্যানেজার উল্টো আমাকে বললেন, ‘আপনারা অভিযোগ না দিলে বুঝবো কিভাবে যে সেবা পাচ্ছেন না!’— এমন কথা শুনে আরও অবাক হলাম। প্রাইভেট হাসপাতাল কি কোনো সরকারি দপ্তর, যেখানে অভিযোগ না দিলে দায়িত্বশীলতা জাগে না?
এদিকে সোমবার দুপুরে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়ার কথা। দুপুরে দায়িত্বশীল ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলাম বিল কত হয়েছে? তিনি জানালেন ৪৬ হাজার টাকার মতো। পরে আমার সন্তানের রিপোর্টে জন্ডিস ধরা পড়ায় আরেকদিন থাকতে হলো।
পরদিন মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ফটোথেরাপি (১২ ঘন্টা) দিয়ে বাচ্চার জন্ডিস একটু নরমাল আসলো। তাই হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিতে চাইলাম। এবং বিল ধরানো হলো ৬১,৯৩৮ টাকা! ম্যানেজারকে প্রশ্ন করলাম গতকাল বললেন ৪৬ হাজার আর আজ ৬২ হাজার টাকা কেমনে কি ভাই? তিনি বললেন, রতন স্যারের সঙ্গে কথা বলেন। রতন দাদা হিসাব কষে বিল নামিয়ে দিলেন ৪৯ হাজারে। অনেক তর্ক-বিতর্ক শেষে ৪৪ হাজার টাকা দিয়ে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিতে হলো। অথচ মৌলভীবাজারে একই মানের সেবায় অন্য বেসরকারি হাসপাতালে ২৫-৩০ হাজার টাকার মধ্যেই সিজার সম্ভব।
বড় বিল্ডিং, লিফট আর করিডোরে চকচকে আলো দিয়ে তারা নিজেদেরকে নামকরা হাসপাতাল হিসেবে চালালেও বাস্তবে রোগীর সেবা বা চিকিৎসা মান অনেক পিছিয়ে।
আমার অভিজ্ঞতা বলছে— 'লাইফলাইন হাসপাতাল' চাকচিক্যে ভরা হলেও চিকিৎসা সেবায় ভয়াবহভাবে পিছিয়ে। শুধু বিল বাড়ানো আর ব্যবসা করার মানসিকতা ছাড়া আর কিছু নেই এখানে। অথচ পুরোনো ভবনে থাকা অন্য হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার-নার্সদের আন্তরিকতা অনেক বেশি।
শেষ কথায় বলবো— মৌলভীবাজারের মতো একটি জেলায় চিকিৎসার নামে এভাবে লুটপাট চলতে পারে—এটা আমাদের জন্য সত্যিই লজ্জার বিষয়। আমি চাই না আমার আত্মীয়, পরিচিত, বন্ধু কেউই আমার মতো অভিজ্ঞতার শিকার হোক। এখনই এসব বাণিজ্যিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রকে নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি। স্বাস্থ্যসেবাকে শুধু ব্যবসা নয়, মানুষের অধিকার হিসেবে দেখার দাবি করছি।
চকচক করলেই সোনা হয় না।
আর যদি আপনার টাকায় ছিনিমিনি করে তাহলে টাকা দিয়ে আসুন লাইফলাইন হাসি-পাতালে।
© সাংবাদিক তুহিন জুবায়ের
#লাইফলাইন_হাসপাতাল