31/07/2025
#মাইলস্টোন_ট্রাজেডি_৫
মাইলস্টোনের এক স্টুডেন্টের মাকে দেখতে গেলাম। জানতে চাইলাম আপা কেমন আছেন? সাথে সাথে উনার কান্না শুরু হয়ে গেল, কাঁদতে কাঁদতে উনি বলল, আমার বাসা এয়ারপোর্টের কাছে, সব সময় বিমানের আওয়াজ পাই। কখনোই ভয় লাগে নাই, এখন বিমানের আওয়াজ শুনলেই আতঙ্কিত হয়ে উঠি। আমি এই এলাকায় আর থাকবো না, এক মাস পরই চলে যাব। বললাম আপা আপনার ঐ দিনের অভিজ্ঞতা একটু বলেন শুনি? আবারো চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছে, কান্নার চাপে কথা বলতে পারছে না, আমারও চোখ ভিজে উঠলো! এরপর আপা বললো, আমার অফিসটা উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এ। আমার ছেলের এক ক্লাসমেটের মা ১টা ২০ মিনিটে আমাকে ফোন দিয়ে বলল, আপা আপনার নীরব কি বাসায় গেছে? আমি বললাম না? ওতো ক্লাস শেষে কোচিং করার কথা? তখন উনি বলল, আপনি খবর পান নাই? ওদের স্কুলের ছাদে একটা বিমান বি/ধ্বস্ত হয়ে আ/গুন জ্ব/লতেছে। আমার আর হুশ নাই, ছেলের মোবাইলে কল দিলাম, কল হইতেছে ধরে না। কয়েকবার চেষ্টা করলাম, কিছুতেই ধরে না। আমি খালি পায়ে দিলাম দৌড়। পায়ে জুতা নেই সেটা ভুলে গেছি। অফিস থেকে বের হয়ে কোন কিছু পাইতেছি না? রাস্তায় জ্যাম! সবাই দেখি দিয়া বাড়ির দিকে দৌড়াইতেছে। প্রায় দুই কিলো রাস্তা আমি খালি পায়ে দৌড়াতে থাকলাম! আমার পায়ে ঢুকলো কাচ ভাঙ্গা, বসে কাচ ভাঙ্গা খুলে আবার দৌড় দিলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় স্কুলের সামনে গিয়ে দেখি আমার ছেলে যে বিল্ডিং এ কোচিং করে, সেই বিল্ডিং ধাউধাউ করে জ্ব/লে অঙ্গার হয়ে যাইতেছে। আমি পাগলের মতো চিৎকার করলাম, ভিতরে ঢুকতে চাইলাম, আর্মিরা কিছুতেই আমারে ঢুকতে দিলো না? আমি কি করবো? কিভাবে ছেলের উদ্ধার করব? মায়ের সামনে ছেলে আ/গুনে জ্বলে যাইতেছে, কোন মা এই দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারে? আবার কান্না আরো বাড়লো আপার। আপাকে সান্তনা দেওয়ার কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না? এরপর আপা বলল, এক ঘন্টার বেশি সময় ধরে আমি পাগলের মত ঘুরলাম, চোখের সামনে পুড়ে যাওয়া বাচ্চাদেরকে বের করে হসপিটালে নিয়ে যাইতেছে, কিন্তু আমার ছেলে নাই? আমি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে কোন দিকে যাব কিছু খুঁজে পাচ্ছি না? অনেকক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করলাম, এক পর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। কে যেন বোতলে করে মাথায় পানি দিলো। আমার মোবাইলে আমি সবাইরে ছবি দেখাইলাম, এটা আমার ছেলে, আপনারা কেউ দেখছেন? কে কার সন্তানের খবর দিবে? প্রত্যেকেইতো তারা নিজেদের সন্তানকে খুঁজে বেড়াইতেছে! তিন ঘন্টা পর হয়ে গেল, আমার আব্বুটার সন্ধান আমি পাইলাম না। একজন বলল আপনি হসপিটাল গুলোতে খোঁজ নেন। কিন্তু এত দূরের রাস্তা আমি যাব কিভাবে? আমার খালি পা, পা কেটে র/ক্ত ঝরতেছে। আমি ব্যগ ছাড়াই দৌড়ে অফিস থেকে বের হয়ে আসছিলাম। সাথে কোন টাকা নাই। একটা রিক্সাওয়ালাকে বললাম, উত্তরা মেডিকেলে যাবেন। সে চাইলো ৫০০ টাকা। আমি টাকা পাবো কই? খালি পায়ে দৌড়াতে শুরু করলাম। খালপাড় চোরাস্তা পর্যন্ত আইলাম, আর পারতেছিনা? রাস্তার উপরে বসে কাঁদতে ছিলাম, হঠাৎ একটা ছেলে বাইক নিয়ে আমার সামনে থামলো, আমারে জিজ্ঞাসা করল কি হইছে? আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম আমার ছেলেরে বুকের ধনরে আমি খুঁজে পাইতেছি না? আর্মিরা বলছে হসপিটালগুলোতে খুঁজতে! ভাইগো আমার সাথে একটা টাকাও নাই? ছেলেটা আমারে বলল, আপনি আমার পিছনে উঠেন। আমার মনে হলো একটা ফেরেশতা আমার জন্য আল্লাহ পাঠাইয়া দিছে। ছেলেটা আমারে নিয়ে প্রথমে গেলে উত্তরা আধুনিক হসপিটাল, এরপর গেল লুবানা হসপিটাল। এরপর গেল মনসুর আলী হসপিটাল, কুয়েত মৈত্রী হসপিটাল। কোথাও খুঁজে পাইলাম না আমার বুকের মানিক রে। কান্নায় আপা কথা বলতে পারছেনা। হঠাৎ আমার মোবাইলে একটা ফোন আইলো, আমারে বলল আপনি কি নিরবের আম্মা? আমি বললাম হ। উনি আমারে বলল আপনি মেট্রো স্টেশনের এখানে আসেন। ওই ফেরেশতা রূপী ভাইটা তার বাইকে করে আমারে নিয়ে উড়াল দিল, মানুষের জ্যামে কোনভাবে সামনে আগানো যাইতেছে না । আমি গিয়ে দেখি আমার ছেলে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। আমার ছেলে বেঁচে আছে, সুস্থ আছে ভালো আছে, এটা দেখে আমি আমার বুকের মানিকরে বুকের সাথে জড়াই ধরে রাখলাম। কতক্ষন জড়িয়ে ধরে রাখছি আমি জানিনা? আমার কলিজা ঠান্ডা হইলো। এরপর বললাম বাবা তুই কই ছিলি? আমি যখন আপার সাথে কথা বলছিলাম, তখন পাশে খাটে শুয়ে ছিল উনার ছেলে নিরব। এ সময় ঘুম থেকে জেগে উঠলো আপার ছেলে নীরব। ট্রমার মধ্যে থাকা ছেলেটা এখনো ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না? কানে ঠিকভাবে শুনতে পায় না, তাকিয়ে থাকে। আমি একটু জোর করে বললাম, মামা তোমার কি মনে পড়ে ওই দিনের ঘটনা? ও বলল একটার সময় ছুটির পর আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে বাইরে দোকানে গেলাম। দুইজনে দুইটা বার্গার নিলাম। ভাবছি ক্লাসে বসে খাব, স্কুলের মাঠে আসতেই বিমানটা আমাদের থেকে একটু দূরে আছড়ে পড়ল, আমি আর আমার বন্ধু দৌড় দিয়ে পিছন দিকে এলাম, আমার একহাতে বার্গার আরেক হাতে মোবাইল, দুটো সেখানে পড়ে গেছে। আমি আমার বন্ধুরে আর খুঁজে পাই নাই, পরে খবর পাইলাম আমার বন্ধু এখন হসপিটালে ভর্তি আছে। ও আমার থেকে একটু সামনে ছিল তো, ওর শরীরের অনেক অংশ পুড়ে গেছে। জানিনা ও বাঁচবে কিনা? আমার বন্ধুর জন্য দোয়া করবেন আঙ্কেল। মা ছেলেকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার ছেলেকে আমার চোখের সামনে থেকে আমি এখন আর কোথাও যেতে দেব না! আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া, আল্লাহ আমার ছেলের বাঁচিয়ে রাখছে। আমার ছেলে পাশে আছে, তাতেও আমি এত কষ্ট পাচ্ছি, এত আতঙ্কের মধ্যে আছি। যেসব মায়েরা সন্তান হারাইছে, আর যাদের সন্তান এখন হসপিটালে মৃ/ত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, তারা যে কিভাবে বেঁচে আছে আমি জানিনা? বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার শব্দে মনে হয় ছেলেটা কানে আঘাত পেয়েছে? আপনারা বাচ্চাটার জন্য দোয়া করবেন, যেন ও এই ট্রমা কাটিয়ে আবার নতুন করে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। ফি আমানিল্লাহ।
©আহসান আলমগীর
নাট্যকার