05/06/2025
গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলেন কিন্তু মিটিং-মিছিল-বিক্ষোভ (গণআন্দোলন) এর পক্ষে কেন?
অনেকে একটা আপত্তি করেন। তারা বলেন, গণআন্দোলন আসলে গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরই অংশ। মিছিল, মিটিং, ঘেরাও, বিক্ষোভ, ধর্মঘট- এসব কর্মসূচী নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশ নেয়া দলগুলোও দিয়ে থাকে। কাজেই গণআন্দোলন আর গণতন্ত্রকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই।
গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বললে গণআন্দোলনের বিরুদ্ধে বলতে হবে। আর গণআন্দোলনকে মেনে নিলে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী রাজনীতিও গ্রহণ করতে হবে।
এই কথা কারো কারো কাছে যৌক্তিক মনে হলেও আসলে ভুল।
লক্ষ্য করুন- যখন মিছিল, মিটিং, ঘেরাও, অসহযোগ, অবরোধ, মার্চ ইত্যাদিকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলা হচ্ছে, তখন গণতন্ত্রকে ঠিক কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে? গণতন্ত্র বলতে কী বোঝানো হচ্ছে?
বাংলার ফরায়েযীরা জমিদারদের কর দিতে অস্বীকার করেছিল। খাসমহল দখল করেছিল, আদালত ঘেরাও করেছিল, নীলকরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল।
কিন্তু গণতন্ত্র নিয়ে তাদের আগ্রহ ছিল না। গণতন্ত্র কী বস্তু, তারা জানতেনও না। সংসদে প্রতিনিধি পাঠানো, নির্বাচন, জনগণের সার্বভৌমত্ব-এসব কোন ধারনাই তাঁদের চিন্তার জগতে ছিল না।
তাঁদের অবস্থান ছিল স্পষ্ট। তারা বিশ্বাস করতেন ইসলামী শাসন ব্যবস্থাকেই একমাত্র বৈধ শাসনব্যবস্থা। কাঙ্ক্ষিত শাসনের যে চিত্র তাঁদের সামনে ছিল আধুনিক লিবেরেল ডেমোক্রেসির মাপকাঠিতে সেটা অগণতান্ত্রিক।
তারা ইসলামী শরীয়াহ চাইতেন, উদার গণতন্ত্র বা বহুত্ববাদ নয়। তাহলে তাঁদের আন্দোলন গণতান্ত্রিক কিভাবে হলো? ঘেরাও, অসহযোগ ইত্যাদি করার কারণে?
আসলে এধরনের আন্দোলন-সংগ্রামকে যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ বলা হয় তখন গণতন্ত্রের খুব ব্যাপক, খুব ঝাপসা এবং খুব ঢিলেঢালা একটা সংজ্ঞা দেয়া হয়। বলা হয়-
"এই আন্দোলনগুলো গণমানুষের চাহিদা, সমস্যা এবং দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়াগুলোতে সাধারণ জনগণ সরাসরি অংশগ্রহণ করে। জনগণ ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে। জনগণের ক্ষমতায়ন ঘটে। এগুলো সবই গণতন্ত্রের অংশ। তাই এগুলো গণতান্ত্রিক আন্দোলন।"
সমস্যা হল এধরণের সংজ্ঞা গ্রহণ করলে যে কোন আদর্শের আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলা সম্ভব। যেসব আদর্শকে গণতন্ত্রের অনুসারিরা অ-গণতান্ত্রিক বলেন, গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলেন, সেগুলোকেও তখন গণতান্ত্রিক বলা যাবে।
যেমন ধরুন, জার্মানির ন ৩সি পার্টি।
তাদের গড়ে তোলা আন্দোলনে গণমানুষের সম্পৃক্ততা ছিল। তৃণমূল মানুষকে সংঘটিত করে তারা সক্রিয় করে তুলেছিল। কিছু প্রান্তিক ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী প্রাথমিকভাবে তাঁদের সমর্থন দিয়েছিল। তাদের আন্দোলনে ছিল সমাজের সামষ্টিক কষ্ট এবং কল্যানের কথা।
গণমানুষকে রাজপথে নামিয়ে তারা বিদ্যমান কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। নিজেদের আন্দোলনকে তারা দেখিয়েছিল বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে।
মিছিল, মিটিং, ঘেরাও, অসহযোগ, অবরোধ, মার্চ- না ৩সি পার্টি এসব পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল। একই ধরণের কথা বলা যায় মুসোলিনির ইটালিয়ান ফ্যাশিস্ট আন্দোলন, ডারতের আরে সেস কিংবা হাল যামানায় ইউরোপের বিভিন্ন শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও।
গণমানুষের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলন করাই যদি গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয় তাহলে বলতে হবে না ৩সি, ফ্যাশিস্ট এবং পশ্চিমের নব্য-ডানপন্থীরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে। এটা কিন্তু কেউই বলে না। বরং উল্টোটা বলে।
বলা হয়, এ আন্দোলনগুলো এমনসব আদর্শকে কেন্দ্র করে হচ্ছে যেগুলো অ-গণতান্ত্রিক। যেহেতু উদ্দেশ্য অগণতান্ত্রিক, তাদের মূল্যবোধ অগণতান্ত্রিক, তাই এসব আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক বলা যাবে না। যদিও তারা এমন সব পদ্ধতি ব্যবহার করে যা গনশক্তিকে কাজে লাগায়। গণআন্দোলনকে কাজে লাগায়।
সহজ ভাষায় বললে: এদের আদর্শ সহিহ না, তাই এদের আন্দোলন গণতান্ত্রিক না।
লক্ষ্য করুন, এখানে এসে কিন্তু ব্যাপারটা বদলে যাচ্ছে।
এক বার বলা হয়, অমুক অমুক পদ্ধতি থাকলে সেই আন্দোলন গণতান্ত্রিক আন্দোলন। ফরায়েযীরা অসহযোগ, অবরোধ, ঘেরাও আন্দোলন করেছে। এগুলো তো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ। তাই তাদের আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলা যায়।
আবার বলা হয়, সঠিক আদর্শ না থাকলে সেই আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক বলা যাবে না, যদিও সেখানে গণশক্তিকে কাজে লাগানো হয়। গণআন্দোলনের পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। যেমন জার্মানির ন|| ৩সি কিংবা ইটালির ফ্যাশিস্টরা।
অর্থাৎ একবার সংজ্ঞা দেয়া হচ্ছে প্রক্রিয়াকে সামনে রেখে, আরেকবার সংজ্ঞা দেয়া হচ্ছে আদর্শকে সামনে রেখে। আসলে গণতন্ত্রকে ইচ্ছেমতো সংজ্ঞায়িত করা হয়।
আদর্শকে সামনে রেখে সংজ্ঞা দিলে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রচলনের আগে ফরায়েযীরাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে যেসব গণআন্দোলন হয়েছে, সেগুলোকে আর গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলা যায় না।
কারণ এসব আন্দোলন গণতন্ত্র কী, সেটাই জানতো না। তাঁদের নানা ধরণের আদর্শ ও উদ্দেশ্য ছিল, যেগুলোর অনেক কিছু 'গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের' সাথে সাংঘর্ষিক।
কাজেই গণআন্দোলনের বিভিন্ন পন্থাকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলা সঠিক না। এগুলো গণতান্ত্রিক কিংবা অগণতান্ত্রিক না। আন্দোলনের পদ্ধতি মাত্র। বিভিন্ন আদর্শ ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠী এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করেছে। এই পন্থাগুলো আদর্শ নিরপেক্ষ-যে কেউ যে কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্য এগুলো ব্যবহার করতে পারে।
দেখুন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (CCP) গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ব্যবহার করেছে। আবার আফগানিস্তানের তালে বান আন্দোলনও গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ব্যবহার করেছেন। এর মানে কি তালেবানের আন্দোলন কমিউনিস্ট ছিল? কিংবা CCP-এর আন্দোলন ইসলামী ছিল? কোন বদ্ধ উন্মাদও এ কথা বলবে না।
একই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করার অর্থ এই নয় যে দুই আন্দোলনের আদর্শ বা লক্ষ্য এক হবে। কেউ গণতন্ত্রের আদর্শ নিয়ে ঘেরাও কর্মসূচী দিতে পারে, কেউ সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর কোন আদর্শ নিয়ে একই কর্মসূচী দিতে পারে। এতে করে তারা এক হয়ে যাচ্ছে না।
কর্মসূচীর সাদৃশ্যই যদি মূল কথা হয় তাহলে কোন দল যদি রাজতন্ত্র, নব্য-সামন্তবাদী শাসন কায়েমের লক্ষ্যে মিটিং-মিছিল, ঘেরাও, অবরোধ, ধর্মঘট ইত্যাদির আয়োজন করে তাহলে সেটাকেও 'গণতান্ত্রিক আন্দোলন' বলতে হবে। যেটা স্পষ্টতই ভুল উপসংহার।
আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রসহ যেকোন সেক্যুলার শাসনের বিরোধিতা করি কারণ সেখানে এমন বেশ কয়েকটি বিষয় থাকে যা ঈমান ও তাওহীদের সাথে সাংঘর্ষিক। যেমন:
আল্লাহ আইনের বদলে অন্য আইনের শাসন
ইসলামী ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে রেখে তার বিপরীতে অন্য আইনী ব্যবস্থা প্রণয়ন
হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করা
মানুষের ওপর গায়রুল্লাহর আইন বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে রাখা
অন্যদিকে গণআন্দোলনে যেহেতু এধরণের বিষয় নেই, এবং মূলগতভাবে এধরণের পদ্ধতি শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক না, তাই এগুলো শর্তসাপেক্ষে গ্রহণ করা যেতে পারে।
Asif Adnan