12/08/2025
শেষ চিঠি
পর্ব ১: হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা
রাফি আজকাল খুব সাধারণভাবে দিন কাটায়—অফিস, বাসা, সামান্য কিছু গান শোনা, আর রাতে ফোনের স্ক্রল। বাইরে থেকে দেখলে তাকে ঠিকঠাকই মনে হয়। সহকর্মীরা বলে, “রাফি, তোর তো লাইফ সেট!” কিন্তু ভিতরে একটা ফাঁকা শব্দ বাজতেই থাকে। শহরের ট্রাফিকের মতোই সেই শব্দ তাকে ঘিরে রাখে—থেমে থেমে, আবার জোরে।
মায়ার কথা সে এখন আর কাউকে বলে না। বললেই মানুষ নানাভাবে বোঝে—কেউ ভাবে, পুরনো প্রেমে আটকে থাকা বোকামি; কেউ আবার ভাব করে গভীর সহানুভূতির। কিন্তু সহানুভূতি তো ঔষধ নয়, যা খেয়ে ব্যথা সেরে যায়। ব্যথা শুধু একটু নরম হয়, তারপর আবার জেগে ওঠে।
সেদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে বৃষ্টি শুরু হলো। রাফি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রিকশার টুপটাপ শব্দ দেখছিল। এমন বৃষ্টিতে মায়া চুপ করে থাকত না। বরং ছাদে টেনে নিয়ে গিয়ে বলত, “ভেজো না, ভেতরে ঠাণ্ডা লাগবে”—কথায় যেন আদেশ, কিন্তু চোখে মোটে আদেশ নেই, সেখানেই ছিল স্নেহ। মায়া হেসে বলত, “তোমার ছাতা তো খুব ছোট, আমরা দু’জন কীভাবে ধরব?” তারপর নিজেই ছাতাটা নামিয়ে দিয়ে দু’জন একসাথে দৌড় দিত। সেই দৌড়ের স্মৃতি এখন রাফির বুকের ভেতর ধীর হাঁটা হয়ে বসে আছে।
বালিশের পাশে আজও একটা ছোট্ট কাগজ রাখে রাফি—পুরনো সিনেমার টিকিট। তারিখটা ঝাপসা হয়ে গেছে, কিন্তু তারা যে সিনেমাটা শেষ পর্যন্ত দেখেনি, সেটা খুব পরিষ্কার মনে আছে। মাঝপথে হল থেকে বেরিয়ে এসে দু’জনে নীরব হয়েছে—কেন যেন আজও ঠিক করে বলতে পারে না। হয়তো তখনই বুঝেছিল, নীরবতারও একটা ভাষা আছে, আর সেই ভাষা শিখতে গেলে মানুষকে খুব কাছে যেতে হয়।
মায়ার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল এক বিকেলে, হালকা বাতাস, শহর যেন একটু থমকে গিয়েছিল। রাফি তখন প্রথম চাকরি পেয়েছে, আর মায়ার পরিবার চাইছিল দূরে গিয়ে পড়তে। তারা বুঝে উঠতে পারেনি কোনটা ঠিক—প্রতিশ্রুতি দেবার মতো বয়স কি হয়েছিল? বয়স কম ছিল, কিন্তু অনুভবগুলো ছিল পাকা। তবু সিদ্ধান্তটা এসেছিল হুট করে। মায়া বলেছিল, “যদি না পারি, আমাকে ঘৃণা কোরো না।” রাফি জবাব দিতে পারেনি—কথা আটকায়নি, শুধু সঠিক শব্দ খুঁজে পায়নি। সেই না-পাওয়া শব্দই আজও তার সাথে থাকে।
পরে অনেক চেষ্টা হয়েছে। ফোনকলের ফাঁকে ফাঁকে উভয়ের সময় মিলেনি, ডেলিভারি বয়ের মতো বার্তা পৌঁছুতে পৌঁছুতে ভুল ঠিকানায় গেছে। একদিন খবর এল—মায়ার পরিবার শহর ছেড়ে দিয়েছে। নতুন নম্বর, নতুন ঠিকানা, নতুন জীবন। রাফি ভাবল, “যা চলে গেছে, তাকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না।” কিন্তু মানুষ কি এভাবে সত্যিই এগিয়ে যায়? সে কাজ করে, হাসে, ছবি তোলে, স্ট্যাটাস দেয়—তবু রাত নামলে একটা ছোট্ট শূন্যতা এসে কানে বলে, “আমি আছি।”
আজ বৃষ্টির রাতে সেই শূন্যতা আবার একটু বেশি কথা বলছিল। রাফি কফির মগটা হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল। ভেজা বাতাসে কফির গন্ধ অদ্ভুতভাবে ভারী হয়ে ওঠে। নিচে এক বাচ্চা ছেলে তার বাবার হাত ধরে পিচ্ছিল রাস্তায় হাঁটছে—ছেলের হাসি, বাবার সতর্কতা—দুটো মিলে একটা নিরাপদ পৃথিবীর ছবি। রাফির মনে হলো, নিরাপত্তা আসলে স্মৃতি দিয়ে তৈরি হয়, আর স্মৃতির দেয়ালে একটু একটু করে শ্যাওলা পড়ে।
রাত বেড়ে গেলে সে বিছানায় শুয়ে ফোনে পুরনো ছবি দেখতে লাগল। এখানে মায়া লাল শাড়িতে, এখানে তারা নদীর ধারে, আর এখানে দু’জন দুই দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে; ছবিতে হাসি নেই, তবু সেই ফ্রেমের ভেতরে যে তাদের দু’জনের নিঃশ্বাস ছিল, সেটা রাফির বুকের ওপর এসে বসে। সে ফোনটা নামিয়ে রাখে। চোখ বন্ধ করলে বৃষ্টির শব্দ নয়, শুনতে পায় মায়ার ফিসফাস—“আচ্ছা রাফি, যদি আবার দেখা হয়, তুমি কি রাগ করবে?”
সে উত্তর দেয় না। কারও প্রশ্নের জবাব নিজের কাছে দিলে তো প্রশ্নটা বদলে যায়। অনেকক্ষণ পরে, প্রায় রাত বারোটা বাজতে চলেছে, তখন ফোনটা আবার হাতে নেয়। নোটিফিকেশন নেই—শুধু নিস্তব্ধ নীল আলো। রাফি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলতে যায়, এমন সময় মেসেঞ্জারের ছোট্ট টং শব্দ।
অচেনা আইডি থেকে একটাই লাইন—“এটাই আমার শেষ চিঠি…”
রাফি থমকে যায়। বুকের ভেতর যেন কেউ আলতো করে দরজায় কড়া নেড়ে বলল, “খুলবে?”
সে স্ক্রিনে আঙুল রাখে। বৃষ্টির শব্দ থেমে নেই, কিন্তু রাফির পৃথিবীতে ঠিক এখনই কিছু একটা শুরু হলো।
(চলবে…)
#পর্ব_গল্প #গল্প_সিরিজ #ভয়ংকর_গল্প #মিস্ট্রি #রহস্য #বাংলা_গল্প