26/08/2025
১৯৩১ সালে মুম্বাই ও কলকাতায় সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। মুম্বাইয়ে নির্মিত হয় উপমহাদেশের প্রথম সবাক কাহিনীচিত্র ‘আলম আরা’ ও কলকাতায় ম্যাডান থিয়েটার্স কোম্পানির উদ্যোগে নির্মিত হয় প্রথম সবাক বাংলা কাহিনীচিত্র ‘জামাই ষষ্ঠী’। ম্যাডান থিয়েটার্স কোম্পানির উদ্যোগে কলকাতায় প্রথম নির্বাক বাংলা ছবি ‘বিল্বমঙ্গল’ নির্মিত হয় ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে। ম্যাডান থিয়েটারসই ১৯৩০-৩১ সালে প্রথম সবাক বাংলা সিনেমা নির্মানের উদ্যোগ নেয় বাণিজ্যিক কারণে। তখন সুর ভান্ডারীর কাজ করেন নজরুল। ১৯৩১ সালে বাংলা সবাক চিত্র ‘জলসা’য় নজরুল নিজের একটি গান গেয়েছিলেন এবং ‘নারী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন। ১৯৩৩ সালে নির্মিত ‘কপাল কুণ্ডলা’র যুক্ত ছিলেন গীতিকার হিসেবে।
ম্যাডান থিয়েটার্সের অন্যতম অংশীদার ছিলেন মিসেস পিরোজ ম্যাডান। তিনি পায়োনিয়ার ফিল্মস প্রযোজনা সংস্থা স্থাপন করেন ১৯৩৩ সালে। এই প্রযোজনা সংস্থা থেকে ১৯৩৪ সালে ‘ধ্রুব’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা ‘ধ্রুব চরিত’ অবলম্বনে নির্মাণ করা হয় ‘ধ্রুব’ সিনেমাটি। সঙ্গীতবহুল মেলোড্রামা ‘ধ্রুব’ সিনেমাটিতে ১৮টি গানের মধ্যে ১৭টি গান ছিল নজরুলের লেখা এবং তিনি এর সঙ্গীত পরিচালনাও করেন। তিনি দেবর্ষি নারদের চরিত্রে অভিনয় করেন এবং একটি গানে কণ্ঠও দেন। এই ছবিটি সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনাও করেন নজরুল।
স্বর্গের সংবাদবাহক এবং দেবর্ষি নারদের কথা ভাবলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে জটাধারী, লম্বা দাড়ি বিশিষ্ট বৃদ্ধ একজনের চেহারা। আমরা বিভিন্ন সিনেমা বা নাটকে দেবর্ষি নারদকে এই চেহরাতে দেখেই অভ্যস্ত। সেই ইমেজ সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে দেখা গেল এক সুদর্শন যুবককে। চুড়ো করে বাঁধা ঝাকড়া চুল, তাতে ফুলের মালা, ক্লিন শেভড, পরনে সিল্কের লম্বা কুর্তা, গলায় মালা, হাসি হাসি মুখ। চলচ্চিত্রের পর্দায় এভাবেই নারদরূপে আবির্ভূত হলেন নজরুল। সেখানে অনবদ্য অভিনয় করেন কাজী নজরুল। একজন পোড় খাওয়া অভিনেতার থেকে কোন অংশে কম যাননি তিনি। অসাধরণ চোখ মুখের অভিব্যক্তি (এক্সপ্রেশন) দিয়ে অভিনয় করেন নজরুল। ‘ধ্রুব’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি মাসে।
নারদ চরিত্রের পৌরাণিক ইমেজ ভেঙে নতুন রূপ দিয়েছিলেন নজরুল। ফলে নজরুলের সাজসজ্জা নিয়ে পত্রিকায় সমালোচনা হয়।
‘ধ্রুব’ সিনেমাটির নজরুলের মেকআপ ও কস্টিউমের ব্যাপারে বর্ণনা করেছেন সেই সিনেমার সহকারী সঙ্গীত পরিচালক ও অভিনেতা নিত্যানন্দ ঘটক ওরফে নিতাই ঘটক। তিনি বলেছেন,
“বিদ্রোহী কবি এই চিরাচরিত প্রথার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করলেন। তিনি এই অশীতিপর নারদকে আটাশে নামিয়ে আনলেন। এতোদিনের বার্ধক্যপীড়িত নারদ এবার হলেন তরুন যুবক। পরনে তার সিল্কের পাড়ওয়ালা গুটানো ধুতি, গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবী, মাথায় সুদৃশ্য চুড়া, তাতে ফুলের মালা জড়ানো, হাতে একতারা, পায়ে খড়ম – এ এক অপূর্ব নয়ন মনোহারী নারদ; দেখলে আর চোখ ফেরানো যায়না। বইখানি মুক্তি পাবার পর কাগজে আলোচনার ধুম পড়ে গেল।… এ কীরকম নারদ! এ যে দেখি ফিটফাট জামাইবাবু।” (নিতাই ঘটক, চলচ্চিত্রে নজরুলঃ স্মৃতির আলোয়, নজরুল একাডেমি পত্রিকা, হেমন্ত সংখ্যা, ১৯৯৩ ঢাকা)
একজন মুসলমান যুবক নারদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলে সেসময় বেশ বিতর্কও হয়েছিল। তার উপর বৃদ্ধ নারদের চিরাচরিত বেশ ভুষা পরিবর্তন করে দেওয়া। অনেকটা আগুনে ঘি ঢেকে দেওয়ার মত অবস্থা হয়েছিল। তবে নজরুল এইসব উটকো সমালোচনাকে পাত্তা দেননি। নজরুল জবাবে বলেন,
“আমার নতুন সাজে অনেকেই আতঙ্কিত হয়েছেন কিন্তু নারদের বয়সের উল্লেখ কোথাও কি আছে? তাঁকে বৃদ্ধ বৈরাগী বেশে দেখানো হয়েছে কোন প্রমাণের উপর নির্ভর করে? বরং তাঁকে চিরতরুণ রূপেই সকলের জানা আছে। আমি চিরতরুণ ও চির সুন্দর সকলের প্রিয় নারদেরই রূপ দেবার চেষ্টা করেছি।”
‘ধ্রুব’ সিনেমাটির চিত্রনাট্য যাত্রা বা থিয়েটারের ভঙ্গিতে লেখা হয়েছিল। এবং সেই ভঙ্গিমাতেই অভিনয় করা হয়। নজরুল নারদের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সেটাই ছিল সিনেমাটির মূল আকর্ষণ। সিনেমাটি বহুদিন হাউস ফুল ছিল। আর সারওয়ার হোসেন লিখেছেন,
“১৯৩৩ সাল। কলকাতার বড় দিনের আসর মাতিয়ে তুলেছে দেবকী বাবুর ‘চণ্ডীদাস’। দেখতে ছুটে গেলাম দেশ থেকে, পথে দেখলাম বড় একটা প্রচারপত্র তাতে সে যুগের বাংলা ছবি পায়োনিয়ার ফিল্মস-এর ‘ধ্রুব’এর বিজ্ঞাপন দেওয়া। ভুমিকায় কারা ছিলেন ঠিক মনে নেই, যুগ্ম পরিচালক ও নারদের ভূমিকায় কাজী নজরুল ইসলামের নাম কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে। সে যুগে ফিল্মে-রেডিওতে দুরের কথা রেকর্ডেও বাঙ্গালী মুসলমান বলতে করোর নাম ছিল না। দু-একজন যারা ছিলেন তারাও আত্মগোপন করেছিলেন ছদ্মনামে। সুতরাং মুসলমানের সঠিক নাম দেখেই আমার কৌতূহল হল। ‘ধ্রুব’ দেখলাম এবং কাজী সাহেবকেও দেখলাম চিরকুমার নারদ রূপে, মানে ‘ক্লীন সেভড’ নারদ। সে যুগে এ কথাই শুধু মনে হত বাঙ্গালী মুসলমান হয়ে কাজী সাহেব কি করে এতটা সাহস পেলেন।” (চিত্র শিল্পে নজরুল, সিনেমা, মে, ১৯৫৩, ঢাকা।)
সিনেমাটির সহকারী সঙ্গীত পরিচালক ও অভিনেতা নিতাই ঘটক বলেছেন,
“দুটি চুক্তি পত্রই (ধ্রুব ছবির) পড়ে দেখলাম, কবির পত্রে লেখা আছে, যতদিন ছবির মিউজিক গ্রহণের কাজ চলবে তিনি মাসিক ৫০০ টাকা করে পাবেন, আর আমার মাত্র চুক্তি মাসিক ৫০ টাকা মাত্র একই সময়ের জন্য। এরপর এক অদ্ভুত অনুরোধ এল ম্যাডান কোম্পনীর প্রোপাইটার ফ্রামজী ম্যাডান সাহেবের কাছ থেকে; তিনি কবিকে এই ছবিতে ‘নারদ’ এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে বললেন, তার ধারণা এতে বক্স অফিসের আকর্ষণ বাড়বে।”
ম্যাডান থিয়েটার্স প্রযোজনা সংস্থা বিভিন্নভাবে নজরুলের সাথে প্রাপ্য পারিশ্রমিক নিয়ে প্রতারণা করে। ফলে নজরুল ১৯৩৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। এরপর নজরুল আর নির্দিষ্ট প্রযোজনা সংস্থায় আবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা ও গান লেখার কাজে জড়িত হয়ে পড়েন।
বিস্তারিত পড়ুন কমেন্টে: